ওষুধি গাছে ‘সুস্থ’ গ্রাম (ভিডিওসহ)

আসিফ আজিজ ও শুভ্রনীল সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৮:৪৩, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নাটোর থেকে ফিরে: লোকে তাকে আফাজ উদ্দিন নামে নয়, চেনে আফাজ পাগলা নামেই। এই আফাজ পাগলাই ‘পাগল’ করেছেন গ্রামের মানুষকে। লোকে যাকে পাগল নামে চেনেন, সেই পাগলের দেখানো পথেই হাঁটছেন গ্রামের প্রায় সব মানুষ। কৃষিপণ্য ভুলে তারা এখন ওষুধি বাগানের মালিক। আর সেই বাগানের ওষুধি গাছে ‘সুস্থ’ গ্রামের মানুষ।

নাটোর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া। ইউনিয়নের গ্রামগুলোকে এখন তাদের নিজস্ব নামে কেউ চেনে না বললেই চলে। ইব্রাহিমপুর, লক্ষ্মীপুর, খোলাবাড়িয়া, কাঁঠালবাড়িয়া, চুরারিয়, সুলতানপুর, দরাপপুর, টলটলিয়া, পিজ্জিপাড়া গ্রামগুলো মিলে নাম হয়ে গেছে ওষুধি গ্রাম। ওষুধি গাছের চাষ করে এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখন স্বাবলম্বী। অর্থনৈতিকভাবেও সুস্থ।

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক ধরে ১০-১২ কিলোমিটার এগোলেই হবিয়তপুর (হবিতপুর) বাজার। এখানে নেমে ভ্যানগাড়িতে তিন কিলোমিটারের পথ লক্ষ্মীপুর আমিরগঞ্জ বাজারের মোড়। চারপাশের মানুষের কর্মযজ্ঞ, দোকানপাট আর নাকে লাগা বিভিন্ন গাছড়া ওষুধের মিশ্র গন্ধই বলে দেবে, চলে এসেছেন ওষুধি গ্রামে।

বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে ঢুকে যাওয়া রাস্তা ধরে এগোলেই টলটলিয়া গ্রাম। রাস্তার দু’পাশে সবুজ ক্ষেত, ঝোপ-ঝাড়। অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর খেত চোখে পড়ার মতো। বুঝতে বাকি রইলো না, গ্রামের মানুষ ‍ওষুধি বাগানে মজে রয়েছেন। পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, এ গ্রামের আব্দুল কাদেরের কাছে এখন রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ। বড় চাষিও তিনি। কবিরাজি করেন। তার কাছে গেলে সব তথ্য পাওয়া যাবে।

যথারীতি নাটোরের অন্য উপজেলার মানুষের মতো স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করতে এখানেও এগিয়ে এলেন একজন। তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন কাদের কবিরাজের বাড়ি। কিন্তু একটু এগোতেই তার সঙ্গে দেখা। সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন হনহনিয়ে। জরুরি কাজে যাওয়ার তাড়া। ঢাকা থেকে এসেছি শুনে সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে।

আফাজ পাগলার কথা জানালেন তিনিই। ১৯৯০ সালের দিকে কয়েকটি ওষুধি গাছ লাগিয়ে বাগান শুরু করেন আফাজ। কয়েক বছরের মধ্যেই মেলে অভাবনীয় সাফল্য। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই গ্রামের মানুষ যুক্ত হয়েছেন এ কাজে। সফল সবাই। আব্দুল কাদেরের বাগানের বয়সও কম নয়। ২০ বছর ধরে বাগান করছেন। বাড়ির আশপাশে থাকা নিজের ও কিছু জমি ইজারা নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তার কর্মযজ্ঞ।

৬৫ বছর বয়সী কাদের জানান, তার কাছে ৮০ থেকে ১০০ প্রজাতির ওষুধি গাছ রয়েছে। বিশ বছরের সংগ্রহ এগুলো। প্রজাতি সংগ্রহে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের আনাচে-কানাচে। তার বন্ধু এমদাদুল হক। ডা. এমদাদ নামেই তাকে সবাই চেনেন। গ্রাম্য ডাক্তার। তবে ওষুধি গাছ-গাছড়া সম্পর্কে ভালো ধারণা তার।

বাগান ঘুরিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ চেনাচ্ছিলেন আর বলছিলেন গুণাগুণের কথা। আশপাশে লোক জমে যাওয়ায় কখনও চুপ করে গেলেন। বললেন, পরে বলবো। এটি তার রহস্য। গ্রামের সব মানুষ যদি সব গাছের গুণাগুণ জেনে যায় তাহলে তো তার পসার নষ্ট হবে!

আয় রোজগার কীভাবে হয়, কারা ভোক্তা, চাহিদা কেমন- এসব বিষয়ে আলাপ হচ্ছিলো কাদের ও ডাক্তার এমদাদের সঙ্গে।

তারা জানান, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ওষুধি গাছ মানে অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীকে চেনে। এর চাষও বেশি করে সবাই। সহজে চাষযোগ্য ও ফলন ভালো পাওয়া যায় বলে অ্যালোভেরার চাষই বেশি হওয়ার কারণ। মণ হিসেবে পাওয়া যায় ৫শ’ টাকার মতো। শ্যাম্পু, সাবান থেকে শুরু করে শরবতে পর্যন্ত ব্যবহার রয়েছে এর।

বড় ওষুধ কোম্পানির মধ্যে স্কয়ার, একমি ও হামদর্দ এ গ্রামের ওষুধি উপকরণের নিয়মিত ক্রেতা বলে জানান কাদের। তবে তাদের চাহিদা মূলত হারবাল ওষুধ তৈরিতে। অশ্বগন্ধা, বাসক, তুলসি, নিসিন্ধা ও সর্পগন্ধা এসব কোম্পানিতে বেশি চলে। এছাড়া বিভিন্ন হারবাল কোম্পানি পাইকারি উপকরণ কিনে নিয়ে যায়। এলাকায়ও রয়েছেন বেশ কয়েকজন পাইকার। তাদের প্রত্যেকের আবার দোকান রয়েছে লক্ষ্মীপুর বাজারে। নিজেরা ওষুধ তৈরি করে বিক্রির পাশাপাশি পাইকারি দরে কাঁচামালও বিক্রি করেন।

শিমুল মূলের বাগান থেকে তিনি দেখানো শুরু করলেন তার ওষুধি গাছ। শিমুল মূল মানে যে শিমুল তুলার গাছ সেটি বোঝা গেলো পরে। ছোট অবস্থায় গাছটির গোড়ায় যে মূলা আকৃতির মূল হয়, সেটির রয়েছে ভালো ওষুধি গুণ। শারীরিক দুর্বলতা রোধ ও পেট কষায় ভালো কাজ করে এটি।

এরপর একে একে যে গাছগুলো তিনি দেখালেন তার অনেক গাছই আমাদের চারপাশে নিতান্ত অবহেলায় পড়ে থাকে। হয়তো আমরা নাম জানি কিংবা জানি না। পরে পরিচয় করালেন তাবিজ-কবজের কাছে ব্যবহৃত রক্ত তান্ডাল, তুরুপ তান্ডাল, বালিক মূল, বিষ-ব্যথা দূরীকরণের হস্তিপলাশ, আমাশয়ের মহৌষধ কিয়ামূল, ভুই কুমড়া, সাদা লজ্জাবতী, লাল লজ্জাবতী, কালো মেঘ, প্রাণ তুলসি, চান্ডাল, বাইত, নিসিন্ধা, আলকুশি, রাই চান্ডাল, হাড় জোড়া প্রভৃতি গাছের সঙ্গে।

রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির আঙিনা সংলগ্ন দু’টি প্লটে তার আরও রয়েছে দুধরাজ, গরু রসুন, গন্ধভাদালি, গুরু চান্ডাল, আকন্দ, অশ্বগন্ধা, তালমূল, ঈশ্বর মূল, রাজকণ্ঠি, পাথরকুচি, ওলটকম্বল, জোয়ানবীর, বন ঢেঁড়শ, মিরচি দানা, পিপরুল, শতমূল, তেজবল, আমরুল, আপাঙ, পাথরসনা, হিমসাগর, নলিকণ্ঠ, বর্মা চান্ডাল, বাসক, স্বর্ণলতা, ডপ তেরেঙ্গা, জগডুমুর প্রভৃতি। তার বাগানের সবচেয়ে মূল্যবান গাছ ঈশ্বর মূল।

দোঁআশ মাটি এসব গাছ জন্মানোর জন্য ভালো বলে জানান কবিরাজ কাদের। ওষুধি গাছের আবাদ করে তিনি মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেন। আর এজন্য জমি যে খুব বেশি লাগে তাও নয়, তিন বিঘার মতো। গাছের পেছনে খরচও কম। জৈব সার ব্যবহার করেন তিনি। এছাড়া পরিচর্যার জন্য কিছু ব্যয় আছে।

গ্রামের মানুষের অসুখ-বিসুখ নিয়ে কথা হয় ডা. এমদাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছোট-খাটো রোগের জন্য গ্রামের মানুষের শহরে যাওয়া লাগে না। গ্রামের গাছ-গাছড়া থেকে তৈরি ওষুধেই কাজ হয়। অনেক গাছড়া আছে যেগুলো অ্যালোপেথিকের চেয়ে দ্রুত কাজ করে।

আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিনে দেখা যায়, কারও বাড়ির আঙিনা খালি রাখতে নারাজ তারা। অন্য চাষাবাদের পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গেই তারা ওষুধি গাছের চাষ করছেন। বেশি দেখা গেলো ঘৃতকুমারীর চাষাবাদ। এছাড়া শিমুল মূল, শতমূল, বাসক, নিশিন্ধার আবাদও রয়েছে।

এসব গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা কাঁচামাল ও তৈরি আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি ওষুধ বিক্রির বাজার আমিরগঞ্জ গিয়ে দেখা ‍যায় দু’পাশের প্রায় সব দোকানই ওষুধের। যারা চালাচ্ছেন সবাই আবার কবিরাজ। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি বিক্রিও করেন তারা। এছাড়া খুচরা বাজারও বসে।

শিকদার হেকিমী দাওয়াইখানায় গিয়ে দেখা গেলো, দোকানের সামনে ভ্যানে বড় বড় চারটি বস্তা। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, এগুলো তুলসী। হারবাল চা তৈরির জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী।

হেকিম ছালামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনিসহ এখানকার সব দোকানি নিজেরা মিলে গুঁড়া করে অথবা শিলপাটায় বেটে ওষুধ তৈরি করেন। তবে বেশিরভাগ ওষুধই যৌবনশক্তি ও শারীরিক দুর্বলতার।

এছাড়া রয়েছে কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা। তাদের একজন মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা খুচরা বিক্রি করি। শিমুল মূল, শতমূল বেশি বিক্রি হয়। দাম কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা।

ব্যবসায়ী ও চাষি কুদ্দুস বলেন, অন্য ফসলের আবাদ কোরে আগে যে টাকা আয় হোতো, তারচে একন অনেক বেশি রোজগার হচ্চে। ওষুধি গাছেত লাভ মেলা বেশি, খাটনিও কম। দামও মোটামুটি ভালোই পাওয়া যায়।

কথায় সুর মিলিয়ে আ. রাজ্জাক বলেন, গড়ে মুনে করেন পতিদিন শুধু খুচরা বিভিন্নু ওষুধি শতমূল, ঘৃতকুমারী, শিমুল মূল বিক্কিরি হয় ৫০ থেকে ৬০ কেজি। কেজিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টেকা লাভ হয়। অ্যাত আমরা ভালোই আছি।

সবশেষে সবাই গলা মিলিয়ে যেটি বললেন, এরম করে আমারে সোবার গুরু আফাজ পাগলার দেকানো পতেত হাঁইটে আইজ খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের কয়েক গ্রামের মানুষ স্বাবলম্বী। শারীরিকভাবে শুদু না, অর্থনৈতিকভাবেও আমরা ভালো আছি একন। ওভাব কমিছে। সোরকারি সাহায্য, ঋণ-টিন পালে আরেকটি এগায় যাওয়া যাতো।





** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৫)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৪)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৩)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ২)
**  চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ১)
** আমহাটীর চামড়ায় সারাদেশে বাজে ঢাক-ঢোল
** ডুবো সড়কে ডুবছে চলনবিল
** ঝাড়ফুঁক-সাপ ছেড়ে  ইমারতের পেটে!
** বিলের মাছ নেই চলনবিলের বাজারে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলে হাঁস পুষে লাখপতি (ভিডিওসহ)
** হালতি বিলে দাগ কেটে ক্রিকেট, ধুমছে খেলা (ভিডিওসহ)

** ভাসমান স্কুলে হাতেখড়ি, দ্বীপস্কুলে পড়াশোনা
** দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে
** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৬
এএ/এসএস/এটি


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান