যেভাবে কার্যকর নিজামীর ফাঁসি

বাংলানিউজ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৮:৫১, মে ১১, ২০১৬

ঢাকা: জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরে মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) বিকেলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারাগারে পৌঁছায় সরকারের নির্বাহী আদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে আদেশও তাকে পড়ে শোনানো হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।

রাতেই নিজামীর স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে শেষবারের মতো তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৭টা ৫০ মিনিট থেকে ৯টা ২২ মিনিট পর্যন্ত ২৬ জন স্বজন কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শেষ সাক্ষাৎ করেন।

এরপর কনডেম সেলে গিয়ে নিজামীকে গোসল করিয়ে রাতের খাবার দেওয়া হয়।

স্বজনদের সাক্ষাতের পর কারাগারে মওলানার মাধ্যমে তওবা পড়িয়ে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছ থেকে তার শেষ কোনো কথা থাকলে তাও শুনে নেন কারা কর্মকর্তারা।
এরপর ধর্মীয় রীতি অনুসারে নিজামীকে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগারের পুকুরপাড় জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। এর আগেই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কান্তি পাল ও ডা. আহসান হাবীব।

সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির রাতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে নিজামীকে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, এটাই আপনার শেষ রাত। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।
 
মওলানা মনির হোসেন তাকে বলেন, আপনার কৃতকর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃতকর্মের জন্য তওবা করেন।
 
এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট চারেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন।

রাত পৌনে বারটার দিকে তারা নিজামীকে নিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চে। আগে থেকেই মঞ্চের পাশে রাখা ছিল মরদেহ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স।
ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার পর তার মাথায় পরানো হয় একটি কালো রংয়ের টুপি। এই টুপিটিকে বলা হয় ‘যমটুপি’।

ফাঁসির মঞ্চে তোলার পর নিজামীর দুই হাত পেছন দিকে বাধা হয়। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন কারা কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসির মঞ্চে প্রস্তুত ছিলেন জল্লাদও। মঞ্চে তোলার পর তার দুই পাও বাধা হয়। পরানো হয় ফাঁসির দড়ি।

কারা কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল একটি রুমাল। রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই  জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। লিভারটি টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁসির মঞ্চের নিচে চলে যান নিজামী। এ সময় তিনি মাটি থেকে ৪-৫ ফুট শূন্যে ঝুলে থাকেন। এতে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়।


মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মরদেহ তোলার পর কারা চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কুমার ও ডা. আহসান হাবিব, ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবদুল মালেক মৃধার তত্ত্বাবধানে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করেন। এ সময় তার ঘাড়ের রগ কাটা হয়।

নিজামীর ফাঁসির লিভারে টান দিয়ে ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করেন প্রধান জল্লাদ রাজু। অন্য দু’জন জল্লাদ ছিলেন তার সহযোগী। জল্লাদ রাজু এর আগে মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরেও জল্লাদের ভূমিকা পালন করেন।

ফাঁসি কার্যকর করার সময় ফাঁসির মঞ্চে ও কারাগারের ভেতরে ছিলেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. ইকবাল, ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) মো. সালাউদ্দিন, ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মালেক মৃধা, ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ, কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলম, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) শেখ নাজমুল আলম, র‍্যাবের পক্ষ থেকে একজন এবং ডেপুটি জেলার। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শেখ মারুফ হাসানের নেতৃত্বে পুলিশের ১২ সদস্যের দলও ছিলেন কারাগারের ভেতরে-বাইরে।  

নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সন্ধ্যায় জেলখানার মূল ফটক ঘিরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চারদিকে তিন স্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়।

পুরো কারাফটক জুড়ে ছিলেন ২২ প্লাটুনের মতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। পুলিশের পাশাপাশি ছিলেন র‌্যাব এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। বন্ধ করে দেওয়া হয় কারাগারের সামনের সড়কে সাধারণ যান চলাচল ও আশেপাশের সমস্ত দোকানপাট।


ফাঁসির রায় যেভাবে
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৩ নভেম্বর আপিল করেন নিজামী। ছয় হাজার ২শ’ ৫২ পৃষ্ঠার আপিলে মোট ১শ’ ৬৮টি কারণ দেখিয়ে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছিলেন তিনি। তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

ওই আপিলের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ০৬ জানুয়ারি সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

গত ১৫ মার্চ আপিল মামলাটির ১৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

রায়টি রাতেই বিচারিক আদালতে গেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর পর পরই মৃত্যু পরোয়ানাসহ পূর্ণাঙ্গ রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
পরদিন ১৬ মার্চ সকালে কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর কনডেম সেলে থাকা নিজামীকে মৃত্যু পরোয়ানা ও পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে শোনানো হয়।

গত ২৯ মার্চ রায়ের বিরুদ্ধে ৭০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন করেন নিজামী। এতে মোট ৪৬টি কারণ দেখিয়ে আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় বাতিল করে খালাস ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আরজি জানানো হয়। শুনানি শেষে গত ০৫ মে রিভিউ খারিজ ও ফাঁসি বহালের সর্বশেষ রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। ০৯ মে এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই রাতেই ট্রাইব্যুনাল হয়ে রায় কারাগারে গেলে কনডেম সেলে থাকা নিজামীকে তা পদে শোনানো হয়।

রিভিউ রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ফাঁসি দড়ি এড়াতে নিজামীর সামনে একটাই পথ ছিলো রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। কিন্তু নিজামী ক্ষমা না চাওয়ায় মঙ্গলবার রাতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৭ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৬
জেডএম/


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান