‘বন্ধুরা যখন পরীক্ষা দিবে, আমার মেয়ে তখন কবরে ঘুমাবে’

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৯:২৭, জানুয়ারি ২৮, ২০১৭
বন্ধুরা যখন পরীক্ষা দিবে, আমার মেয়ে তখন কবরে ঘুমাবে। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বন্ধুরা যখন পরীক্ষা দিবে, আমার মেয়ে তখন কবরে ঘুমাবে। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: একদিন আগেই বিদ্যালয়ের বিদায় অনুষ্ঠানে দেওয়া ফুলের মালা নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরেছিল মেয়েটি। সেটাই শেষ সুখস্মৃতি। বিস্ফারণে পুড়ে পরদিন সকালে তার প্রায় ‘অসাড় শরীর’টি যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ঢুকলো আর ফিরলই না। মধ্যরাতে থেমে গেছে তনিমা আফরিন ইপ্তির বেঁচে থাকার সব আয়োজন।

যাওয়ার বেলায় ঝলসানো শরীরটা অস্ফুট উচ্চারণে কয়েকটা শব্দই বলে গিয়েছিল মায়ের দিকে তাকিয়ে-‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা আমি বাঁচতে চাই। আমি ভালো হয়ে পরীক্ষা দিতে চাই।’

তারপরই সব শেষ। ঘড়ির কাঁটা তখন শুক্রবার রাত একটার আশেপাশে। বন্ধুমহলে দাপিয়ে বেড়ানো, ঘরদোর মাতিয়ে রাখা বাড়ির ছোট মেয়েটা একেবারেই নির্জীব হয়ে গেল, আর চোখ ফিরে তাকালো না। বছর ১৬তেই থেমে গেল জীবন প্রদীপ।

শনিবার (২৮ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ইপ্তির শেষ কথাগুলো বলছিলেন আত্মীয় মোহাম্মদ ইসমাইল।

তনিমা আফরিন ইপ্তি নগরীর কুসুম কুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল তার। পরীক্ষার ভালো ফল করার তাগাদায় শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) ভোরেই ঘুম থেকে উঠছিল সে। তারপর কিছু একটা রান্না করতে গিয়েছিল চুলার কাছে। আগুন ধরাতেই ভয়ংকর বিস্ফোরণ। এরপরেরটা সবার জানা।

এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ইপ্তির দাদি ছামেদা খাতুনও (৭০)। মা ও মেয়ের মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বজনদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন শোকস্তব্ধ আব্দুল মোতলেব চৌধুরী।

এসময় তিনি বলেন, ‘আমার তো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমি তো ছিলাম না বাসায়। আমার মা-মেয়ে আর ছেলেরা ছিল। সবাই ধারণা করছে গ্যাস থেকেই এ ঘটনা ঘটেছে। তারপর তাদের গায়ে আগুন লাগলে তারা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’

বলতে বলতে চোখ বেয়ে পড়তে থাকে জল। নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না আর। আব্দুল মোতলেব চৌধুরীর স্মৃতিতে যেন ভেসে ভেসে আসছিল মেয়ের খন্ড খন্ড স্মৃতিগুলো।

‘আমার মেয়ের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। টেস্ট পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেছিল ও। মেয়ে আমাকে সবসময় বলতো, ‘‘আব্বু আমার জন্য পরীক্ষার সব সাজেশন নিয়ে আসবে’’। প্রতি উত্তরে আমি বলতাম, আম্মু আনবো। আজ কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই মেয়ে? ওর বন্ধুরা যখন পরীক্ষা দিবে, আমার মেয়ে তখন কবরে ঘুমাবে।’

বৃহস্পতিবার বিদায় অনুষ্ঠানে স্কুল থেকে দেওয়া ফুলের মালাটি বাসায় নিয়ে এসেছিল ইপ্তি। বাবার স্মৃতিতে সেটিও বেশ পরিস্কার।

‘বিদায় অনুষ্ঠান থেকে ফুলের মালা নিয়ে এসেছিল। তারপর সেটি আমাকে দিয়েছিল। বলেছিল আব্বু এটা তোমার জন্য।’ কথা নয় যেন শোক বের হচ্ছিল আব্দুল মোতালেবের কণ্ঠ থেকে।

আত্মীয়-স্বজনরা চেষ্টা করছিলেন আব্দুল মোতলেব চৌধুরীকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু কোনোভাবেই আহাজারি থামছিল না তার। থামবেই বা কেন? একদিকে নিজের মাকে হারালেন, অন্যদিকে ‘মা’ এর মতো মেয়েকেও হারালেন। সান্ত্বনা আবেগের সঙ্গে পেরেছে কবে?

মর্গের সামনে ভিড় করেছিল ইপ্তির সহপাঠীরাও। শেষবারের মতো যদি একনজর প্রিয় বান্ধবীকে দেখা যায়। ছিলেন তাদের মায়েরাও। এসেছেন ইপ্তির পরিবারের চেনা আধচেনা অনেকেই।

সহপাঠীদের চোখে জল। বন্ধু হারানোর শোক। দুদিন আগেও বিদায় অনুষ্ঠানে যার সঙ্গে এত আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন, শেষ বেলায় যাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন- সে আজ নীরব-নিস্তব্ধ। না কোনোভাবেই বন্ধুর এমন চলে যাওয়া মানতে পারছে না তারা।

তাদের একজন বললো, ‘স্কুলে আমাদের সবসময় মাতিয়ে রাখতো সে। সবসময় হাসিখুশি থাকতো। খুব মিস করবো তাকে।’

আরেকজনের বক্তব্য, ‘খুবই মনোযোগী ছাত্রী ছিল। পুরোটা জুড়েই ছিল পরীক্ষার চিন্তা। আমাকে প্রায় সময় ফোন করে বলতো, ‘‘দোস্ত কি পড়ছিস। রাতে কতক্ষণ পড়িস, ভোরো কয়টায় উঠিস।’’

তারা যখন কথা বলছিল ইপ্তি তখন শুয়ে আছে অদূরের মর্গ কক্ষে। পাশে প্রিয় দাদি। সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া দুটি নিথর শরীর।

সামনে পরীক্ষা বলে অনেকদিন ধরে গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়ার আমিরাবাদে যাওয়া হয় না ইপ্তির। পরীক্ষা শেষেই ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল তার। শনিবার দুপুরে গ্রামের পথে যাত্রা শুরু করে সে ও তার দাদিকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স।

একটু আগেভাগেই যেন ফিরে গেল গ্রামের বাড়িতে। একটু আগেই যেন ছুটি পেয় গেল সে!

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৭

টিএইচ/আইএসএ/টিসি

**বিস্ফোরণে দগ্ধ দাদি-নাতনির মৃত্যু

**স্থির হয়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা বলছে বিস্ফোরণের সময়!

**লণ্ডভণ্ড ৩৫ ফ্ল্যাট, পুলিশ বলছে গ্যাস বিস্ফোরণ

**‘চোখ মেলে দেখি খাটের চারপাশে আগুন’

** ছয়তলা ভবনে রহস্যজনক বিস্ফোরণ, আহত ৪


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান