
আল্লাহ সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু
ঈমানদারদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। “যিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। যাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্ত তাঁরই। কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে? তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। তাঁর ‘কুরসী’ আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত; এদের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না। আর তিনি মহান ও শ্রেষ্ঠ।” যিনি “বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।” যিনি অনস্তিত্ব হতে যা খুশী তাই অস্তিত্বে আনতে সক্ষম। “তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও’ এবং তা হয়ে যায়” “তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।” মু’মিনদের জীবনের সকল তৎপরতা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। মু’মিন কখনও আল্লাহর উপর আস্থাহীন হয় না। আল্লাহর উপর নির্ভরকারী মু’মিনকে কখনও কোনো মূর্তির আর্শীবাদের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করার পরও যারা আল্লাহর উপর আস্থা রাখার বিষয় প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন কিংবা কোনো মূর্তির আর্শীবাদ অন্বেষণে গৌরববোধ করেন তখন তার ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি স্বতঃই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবে মুসলিম বলে দাবীদার সে মানুষটি নিজেকে নিজেই অপমানিত করেন। নিজের মর্যাদাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকেন। প্রকারান্তরে মুসলিম বলে দাবীটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন।
এমন একটি বিকৃত ও হীনমন্য [ইনফেরিয়রটি কমপ্লেক্স] মানসিকতার প্রাধান্য বিরাজমান অবস্থায় এবারে ঈদুল আজহা বা কুরবানীর ঈদ আমাদের মাঝে সমুপস্থিত।
গুরুত্বপূর্ণ দশটি দিন
যিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের যে কোনো নেক আমল আল্লাহ তা’আলার নিকট খুবই প্রিয়।
“সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোনো আমল নেই। তারা [সাহাবীগণ] প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করা কি তার চেয়ে প্রিয় নয়? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন : না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল অত:পর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এল না।”
“সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : আল্লাহ তা’আলার কাছে সবচেয়ে উত্তম দিন হল কুরবানীর দিন তারপর কুরবানী পরবর্তী মিনায় অবস্থানের দিনগুলো।”
সামগ্রিক বিচারে যিলহজ মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমজানের শেষ দশকের দিবস সমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমজানের শেষ দশকের রাতসমূহ যিলহজ মাসের প্রথম দশকের রাতসমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদর হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন। দিন ও রাতের এই মর্যাদার অনুভূতি কেবল মু’মিনের কাছেই। যার কর্মকাণ্ড আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
কুরবানীর দিন
১০ যিলহজ কুরবানীর দিন বা ইয়াওমুন নহ্র। আল্লাহ তা’আলা রাসূল সা.-কে কুরবানী করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন : “আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানী করুন।” আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত, “রাসূলে কারীম সা. বলেছেন : আল্লাহর নিকট দিবস সমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হলো কুরবানীর দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন।” এই দিনগুলোর নাম আইয়ামুত-তাশরীক। আইয়ামুত-তাশরীক সম্পর্কে রাসূল সা. বলেন, “আইয়ামুত-তাশরীক হলো খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহর যিকিরের দিন।” বিভিন্ন হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহর যিকির আদায় পদ্ধতি নি¤œরূপ :
০১. সালাতের পর এবং সালাত ছাড়াও তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে।
০২. কুরবানীর পশু বা হজের হাদী যবেহ করার সময় আল্লাহ তা’আলার নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করা।
০৩. কুরবানীর গোসতো খাওয়া-দাওয়ার শুরু ও শেষে বিশেষভাবে আল্লাহর স্মরণ নেয়া, কৃতজ্ঞতা জানানো।
০৪. হাজীদের ক্ষেত্রে কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহ তা’আলার তাকবীর পাঠ করা।
০৫. এমনিভাবে সকল কাজ-কর্মে ও সকাল সন্ধ্যার যিকিরগুলোর প্রতি যতœবান হওয়া।
এ হলো ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. কর্তৃক অনুমোদিত কর্মকাণ্ড।
যদি ইতিহাসে ফিরে দেখি, কিভাবে এইদিনটি মুসলিম উম্মাহর উৎসবে যুক্ত হলো, তাহলে তার জবাব কুরআন হতেই আমরা পাই। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যখন সে [ইসমাঈল আ.] তার সাথে [ইবরাহীম আ.] চলাফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহীম তাকে বলল, ‘প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে কুরবানী করছি। তোমার অভিমত কি? সে বলল, ‘আব্বা, আপনি আল্লাহর হুকুম কার্যকর করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম স্বীয় পুত্রকে কাত করে শোয়ালো, তখন তাকে আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহীম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে।’ এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করি। নিশ্চয়ই এটি ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কুরবানীর বিনিময়ে। আর পরবর্তী লোকদের মাঝে একথা স্থায়ী করে দিলাম যে, ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
আল্লাহর নির্দেশ পালনকে সহজাত সন্তান বাৎসল্যের উপরে অগ্রাধিকার দেবার এবং নিজের জীবনের চেয়ে আল্লাহর আদেশকে শিরোধার্য করার পিতা-পুত্রের এই আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত প্রমাণ করছে : ০১. আল্লাহর আদেশ পালনে কে কতটুকু তৎপর প্রত্যেকের জীবনে এ পরীক্ষা অবশ্যম্ভাবী ০২. নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছু আল্লাহর জন্য ভালোবাসার সামনে তুচ্ছ, ০৩. এমনকি আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় জীবন উৎসর্গ করাও তুচ্ছ। আল্লাহর জন্য ভালোবাসার এই স্মারকই ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ। আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করার প্রত্যয় যে হৃদয়ে স্থান পায়, সে হৃদয়তো কখনো আল্লাহর উপর আস্থাহীন হতে পারে না কিংবা কোনো মূর্তির আর্শীবাদ অন্বেষণে গৌরববোধ করে না। আল্লাহ অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কাজ হতে প্রাণপন বেচে থাকারই চেষ্টা করে। এভাবে একজন ঈমানদার মানুষ নিজের চাওয়া-পাওয়া, ধন-সম্পদ আল্লাহর অনুমোদিত পন্থায় কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই জীবনের পরম লক্ষ্য নির্ধারণ করে। ঈমানদার ব্যক্তির আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় সবকিছু উৎসর্গ করার সেই অনুভূতিই তাকওয়া। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এ সকল পশুর গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। এগুলোর রক্তও পৌঁছেনা। বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
বাস্তবতা ও আমাদের ঈদ কালচার
কেস স্টাডি-১
“বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামের দুই সন্তানের মা ডালিমন খাতুন ঈদের দিনে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। স্বামী রজব আলী নিঃস্ব দিনমজুর। আয় রোজগার নেই বলে ঈদের আগে তিনদিন পরিবারশুদ্ধ সবার অনাহারে কেটেছে। স্বামী ঈদের নামাজ পড়তে গেছে। সন্তান দুটি কাছাকাছি কোথাও আছে। এ অবকাশে ডালিমন খাতুন আতœহত্যা নয়, যেন কোরবানির ঈদে সে নিজেকেই কোরবানি দিলো।”
কেস স্টাডি-২
“খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়বে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর অতিক্রম করেছে, এতে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। এর ওপর আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব ধরণের পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে।”
কেস স্টাডি-৩
“মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। তারা আয়-ব্যয়ের সাথে সমন্বয় করতে পারছেন না। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকায় হাত দিচ্ছেন। এতে ব্যাংকিং খাতে এ শ্রেণীর মানুষের আমানতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, এক বছর কম সময়ের জন্য রাখা ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি কমে ১৮ শতাংশে নেমেছে। আগের বছর একই সময়ে ছিল ৪০ শতাংশ।”
কেস স্টাডি-৪
“ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে দেশে অবাধে ভারতীয় গরু আসছে। এতে করে দেশের গরু খামারি এবং ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে মোটাতাজা করণ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশংকা করা হচ্ছে। রাজধানীর বড় গরুর হাট গাবতলীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারে আসা ৫টি গরুর মধ্যে ৪টি গরুই ভারতীয়।”
কেস স্টাডি-৫
জাবের রা. বলেন, ইয়ামান থেকে আলী রা. কর্তৃক আনিত হাদী এবং মদীনা থেকে রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক আনিত হাদীর মোট সংখ্যা ছিল একশত উট। জাবের রা. আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. তাশরীকের সব দিনেই সূর্য হেলে যাওয়ার পরে কংকর নিক্ষেপ করলেন। তিনি বড় জামরাতে কংকর নিক্ষেপকালে সুরাকা তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন। অতপর বললেন : “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এটা কি খাস করে আমাদের জন্য? তিনি বললেন, না বরং সবসময়ের জন্য।” অতপর তিনি পশু যবেহের স্থানে গেলেন। তারপর নিজ হাতে তেষট্টিটি উট যবেহ করলেন। অতপর তিনি আলী রা.-কে অবশিষ্টগুলো যবেহ করার দায়িত্ব দিলেন। তিনি তাকে নিজের হাদীতে শরীক রাখলেন।
১ম কেসস্টাডিটি ১৯৯৫ সালের। হৃদয় বিদারক এক ঘটনা, যেখানে সহানুভূতির ভাষাও বোবা হয়ে যায়। অন্যদিকে আমাদের ঈদ কালচার পর্যালোচনা করলে তাতে তা এক ধরণের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা মনে হয়। ড. আনোয়ার তাঁর একটি প্রবন্ধে যার চিত্র এঁকেছেন এভাবে - “কোরবানির গরু কেনার প্রতিযোগিতা ধনী ব্যক্তির রেসের ঘোড়ার মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। কে কতো বেশি দামে গরু কিনতে পারে, কার বাড়িতে কতো বড়ো পানাহার পার্টি হবে, ঈদ উপলক্ষে কে কতো টাকার দামী আসবাবপত্র কিনতে পারে, কে কতো দূরবর্তী মহানগর থেকে জমকালো পোশাক-প্রসাধনী ও অলংকার কিনতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা চলে আমাদের দেশে। .......ঈদ উপলক্ষে দেড় দুই লাখ টাকার শুধু গরুই কিনবে না, এরা বউ ছেলে-মেয়ের জন্য কিনবে লেটেষ্ট মডেলের গাড়ী। কেউ ঈদ উপলক্ষে মেয়ে জামাইকে উপহার দেবে প্রাসাদোপম বাড়ি। এই ঈদুল আযহার পবিত্র ধর্মীয় উৎসবে বাংলাদেশের রাজধানীসহ কয়েকটি মহানগরীর বেশকিছু বাড়ীতে সারা রাতব্যাপী পানাহার চলবে। তবে অন্যান্য দিনের সঙ্গে ঈদের দিনের পার্থক্য হলো, ধর্মীয় রীতি অনুসারে ঈদের দিনে বিসমিল্লাহ বলে তারা গ্লাস মুখে নেবেন।”
১৯৯৫ সালের ঘটনা কেন ২০১১ সালে তুলে আনলাম? ২য় থেকে ৪র্থ কেসস্টাডিতে যা তুলে ধরা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই যে ১৯৯৫ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ২০১১ সালে ঘটা সম্ভব তা প্রতীয়মান হয়। সার্বিক পরিস্থিতি ১৯৯৫ সালের “ডালিমন”-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনাকে প্রকট করে তুলে। তাই দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিম্নবিত্ত মানুষকে যেন “ডালিমন”-এর পরিণতি বরণে উদ্বুদ্ধ না করে সে জন্যই ১৯৯৫ সালের ঘটনার অবতারণা।
মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বযাত্রা, ডলারের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, আকাশছোয়া পণ্যমূল্য, সরকারের রের্কড পরিমাণ ব্যাংক ঋণ গ্রহণ, দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, প্রতিশ্র“তি সত্ত্বেও বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য না পাওয়া, ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রলম্বিত সমস্যা,অস্থির পুঁজিবাজার প্রভৃতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কতটা নাজুক করেছে তা অর্থনীতিবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। অর্থনীতির আলোচনা আমার এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এদেশের দরিদ্র মানুষের যেন ক্ষুধার তাড়নায় “ডালিমন” হতে না হয় বাংলাদেশের বিত্তবানদের মমত্ববোধের কাছে সে আবেদনই প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।
ইসলাম সেই দাবীদারকে প্রকৃত ঈমানদার স্বীকার করেনি, যিনি তার প্রতিবেশীকে [ধর্মবর্ণবংশ নির্বিশেষে] অভুক্ত রেখে নিজে আহারের বিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “ যে ব্যক্তি নিজে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে প্রকৃত ঈমানদার নয়।”
অধিকারের দিক দিয়ে প্রতিবেশীকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে:
০১. যার তিনটি হক রয়েছে। মুসলমান আত্মীয় প্রতিবেশী। : ক] মুসলমান হিসেবে; খ] আত্মীয় হিসেবে; গ] প্রতিবেশী হিসেবে।
০২. যার দুটি হক রয়েছে। মুসলমান প্রতিবেশী : ক] মুসলমান হিসেবে; খ] প্রতিবেশী হিসেবে।
০৩. যার একটিমাত্র হক রয়েছে। মুসলিম নন এমন প্রতিবেশী। তিনি প্রতিবেশীর হক প্রাপ্য হবেন।
তাই ঈমানদার বিত্তবান ভাই-বোনদের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই, লক্ষ টাকায় ১টি কুরবানীর পশু না কিনে ৩/৪টি কিনেন। সম্ভব হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত ১০০টি কুরবানীর পশু ক্রয় করুন। দরিদ্র ও বিত্তহীন, দিনমজুরদের মাঝে তা বিতরণের উ প যু ক্ত ব্য ব স্থা নিন। ৫ম কেসস্টাডিতে নবী সা.-এর কুরবানীর বিষয়টি একথা সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে যে একজন বিত্তবান ঈমানদার কখনও কোরবানির গরু কেনার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।
উপসংহার
পরিশেষে এদেশের স্বল্প আয়ের গরীব খামারিরা বা গৃহস্থরা সারা বছর যতœ করে কুরবানীর যে পশু পালন করেন ঈদুল আযহার সময় বিক্রি করার লক্ষ্যে তাদের দিকে লক্ষ্য রাখাও কুরবানী দেয়ার সামর্থ্যের অধিকারী সব ভাইবোনদের মনে রাখা দরকার। আর এতে দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে।
ভারতীয় গরুর বিষয়টি ৪ নং কেসস্টাডিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের গরু ক্রয়ের মাধ্যমে আপনি কিভাবে ভারতের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার যোগানের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছেন তার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট সুশীল বুদ্ধিজীবি জনাব বদরুদ্দীন উমর। তাঁর ভাষায় শুনুন : “ভারতের পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যায় যে, সেখানে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলেও প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব সেখানে যথেষ্ট এবং এদিক দিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকাও অবহেলা করার মত নয়। চাকরি ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিবেচনাতো গুরুত্বপূর্ণ বটেই, এমনকি এই বিবেচনা অহিন্দুদের খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত বিস্তৃত। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের রাজধানী নূতন দিল্লীতে গোমাংস ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ রাখায় বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে যতই তুচ্ছ মনে হোক, আসলে তা সংখ্যালঘু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর এক নিকৃষ্ট সাম্প্রদায়িক হামলা ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। কারণ, ভারতে গোমাংস না খেতে দেওয়ার পেছনে কোনো অর্থনৈতিক কারণ নেই। উপরন্তু, অর্থনৈতিক কারণেই তার পথ খোলা রাখা দরকার। তাছাড়া, বিদেশীমুদ্রা অর্জনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার টন গোমাংস রপ্তানি যখন ধর্মসিদ্ধ তখন দেশীয় মুসলমানদেরকে তা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মধ্যে কোনো অর্থনৈতিক কারণ যে নিহিত নেই, তা বলাই বাহুল্য। পরিস্থিতি এদিক দিয়ে এমনই সংকটজনক যে এই অধিকার পুনরুদ্ধার দাবী জানিয়ে আজ পর্যন্ত ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টে সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা দায়ের করতে সাহসী হয়েছেন বলে শোনা যায়নি! ........লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ভারতের সরকারী, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা আজ যথেষ্ট প্রবল। পশ্চিম বাংলা, মিজোরাম, নাগাল্যাণ্ড, ত্রিপুরা ইত্যাদি সামান্য কয়েকটি অঞ্চল বাদ দিয়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি সম্প্রতি ঘটেছে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ভারতে কোনো শক্তিশালী আন্দোলন আজ নেই। .......বক্তৃতা-বিবৃতিতে ও দেয়ালের লেখায় কিছু বক্তব্য থাকলেও তাকে মনে হয় নিতান্তই একটা দায়সারা ব্যাপার।”
ডালিমনদের প্রতি ঈমানদার বিত্তবানরা তাদের মানবিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আসুন বাংলাদেশকে একটি বাসযোগ্য সৎপ্রতিবেশী সুলভ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে অবদান রাখি। ঈদ মুবারক।
সূরা বাকারাঃ ২৫৫
সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭
সূরা আলে ইমরানঃ ৪৭
সূরা ইখলাসঃ ০৪
বুখারী-৯৬৯, তিরমিজি-৭৫৭
আবু দাউদ-১৭৬৫
সূরা কাওসারঃ ০২।
আবু দাউদ-১৮৬৫।
মুসলিম-১১৪১।
ফায়সাল বিন আলী আল বাদানি ও আবু আনাস খায়রুল্লাহ, জিলহজ, ঈদ ও কোরবানি, আবহাস এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, পৃ/ ৩৯।
সূরা সাফফাতঃ ১০২-১১১।
সূরা হাজঃ ৩৭।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ সংকট-সংলাপের রাজনীতি, ডালিমন খাতুনের কোরবানীর ঈদ, ভোরের কাগজ ২৯ মে ১৯৯৫, পৃ./৬২।
আশরাফুল ইসলাম, বিদ্যুতের দাম বুদ্ধি জনদুর্ভোগকে চরমে নেবে, নয়া দিগন্ত, ৭ অক্টোবর ২০১১, পৃ./০১।
আশরাফুল ইসলাম, মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা আমানত তুলে ফেলছেন ব্যাংক থেকে, নয়া দিগন্ত, ২৯ অক্টোবর ২০১১, পৃ./০১।
আহমদ নাহ্ল, ভারত থেকে অবাধে গরু আসছে, সোনার বাংলা, ২৮ অক্টোবর ২০১১, পৃ./১২।
দারমী।
বুখারী, মুসলিম।
ইবনে মাযাহ
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, প্রাগুক্ত।
বদরুদ্দীন উমর, বাঙলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, পল্লব পাবলিশার্স, পৃ./৪২-৪৩।