পেঁয়াজ সংরক্ষণে ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ 

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১১:৩১, আগস্ট ২৮, ২০২২

ফরিদপুর: প্রতিবছর ৩৩ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন করেন দেশের কৃষকরা। তবে সংরক্ষণের অভাবে এর এক-চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাহিদার ঘাটতি মেটাতে গিয়ে আমদানির দরজা খুলে দিতে হয় সরকারকে। এ কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন স্থানীয় চাষিরা।

পেঁয়াজ নিয়ে এই সংকট মোকাবিলায় আশার আলো দেখাচ্ছে ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’। ইতোমধ্যেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের কাছে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে পেঁয়াজের এসি হিসেবে। সুফল মেলায় খুশি সংশ্লিষ্ট সবাই।

পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতার জেরে নেওয়া পদক্ষেপের সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েকবছর ধরে ক্রমাগত উৎপাদন বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ।

এরপরও ঘাটতি মেটাতে আমদানি করতে হচ্ছে বছর বছর। চাহিদার বেশি আমদানি হলে প্রভাব পড়ে বাজারে। দাম পড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক। তবে ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পেঁয়াজের অপচয় বা নষ্ট হওয়াকে।

জেলা কৃষিবিভাগ বলছে, সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমদানির কারণে দেশের অর্থ যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনি ভালো দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা।

সাধারণত প্রচলিত পদ্ধতিতে (সনাতন) বাঁশের মাচায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হলেও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অধিক তাপমাত্রায় ও অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পে পচন ধরে যায়। এ প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবন হলো ‘বায়ু প্রবাহ যন্ত্রের মাধ্যমে পেঁয়াজ সংরক্ষণ’ প্রযুক্তি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সমন্বিত পানি সম্পদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প-২য় পর্যায়ের পরামর্শক দলের উদ্ভাবিত ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ ব্যবহার হচ্ছে ফরিদপুরের বিভিন্ন গ্রামে। একটি মেশিন স্থাপনে খরচ মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

সরেজমিনে ফরিদপুরের সালথা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বেশ কিছু পেঁয়াজ চাষিকে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ পদ্ধতিতে করতে দেখা গেছে। একটি ছাদযুক্ত টিনের কিংবা ইটের ঘরের মেঝেতে ইট দিয়ে মাচা তৈরির পর মাদুর বা বানা দিয়ে ঢেকে তারমধ্যে এই যন্ত্রটি স্থাপন করে তারা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। একশো বর্গফুট জুড়ে তৈরি এমন একটি স্থানে প্রায় তিনশো মণ পেঁয়াজ তারা রাখছেন বছরের আট থেকে নয় মাস জুড়ে। এতে তাদের মাসে পাঁচশ থেকে ছয়শ টাকার বিদ্যুত খরচের বাইরে আর কোনো অতিরিক্ত ব্যয় নেই।

চাষিরা জানিয়েছেন, সাধারণত বাজারে নতুন পেঁয়াজ ওঠার পরেই দাম কমতে থাকে। এজন্য কিছুদিন সংরক্ষণ না করতে পারলে পেঁয়াজ চাষির লাভ মেলে না। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশের মাচা বা চাঙে পেঁয়াজ সংরক্ষণে অধিক তাপমাত্রায় ঘেমে যাওয়া, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পে পচন ধরা ও রং নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেন তারা।

জেলার কয়েকটি উপজেলাতে গিয়ে ঘুরে দেখা গেছে, ছাদযুক্ত টিনের কিংবা ইটের ঘরের মেঝেতে ইট দিয়ে মাচা তৈরির পর ছিদ্রযুক্ত মাদুর বা বানা দিয়ে ঢেকে তারমধ্যে সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ও ১৪ ইঞ্চি চওড়া একটি ভার্টিকাল সিলিন্ডার বসানো হয়েছে। এক হর্স পাওয়ারের একটি বৈদ্যুতিক মোটরযুক্ত করে পাখার সাহায্যে ওপর থেকে বাতাস টেনে নামিয়ে নেওয়ার পর আটকে থাকা বাতাস পেঁয়াজের মধ্যে দিয়ে বের হচ্ছে। ছোট্ট একটি কক্ষে এভাবে বাতাস প্রবাহ করে মজুদকৃত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

ফরিদপুরের নগরকান্দার বিলনালীয়ার পেঁয়াজ চাষি অহিদুজ্জামান বলেন, এই পদ্ধতিতে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে পেঁয়াজ রাখতে পারছি। নিজের প্রয়োজন মতো সময়ে বিক্রি করছি। এভাবে রেখে এখন ১৫শ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছি। নাহলে এই পেঁয়াজ ১২শ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হতো।

একই কথা শোনালেন সদর উপজেলার কৈজুড়ী ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আব্দুর রহিম শেখ (৬০) বলেন, তিনি তিনশ মণেরও বেশি পেঁয়াজ পেয়েছেন এবার। আগে চাঙে খামাল দিয়ে পেঁয়াজ রাখতেন। কিন্তু অনেক পেঁয়াজ পচে নষ্ট হত। এ বছর এই মেশিন দিয়ে পেঁয়াজ রাখার পর আলহামদুলিল্লাহ পেঁয়াজ আর আগের মতো পচে না। আগের চেয়ে অনেক সুবিধা হয়েছে এই মেশিনে।

সালথার গট্টি ইউনিয়নের লাহরিপাড়া গ্রামের আবজাল হোসাইন বলেন, এই মেশিনে পেঁয়াজ রাখলে খুব সুন্দর বীজ হয়। গজায় কম। ঘাটতিও কম। পেঁয়াজের রং এবং গুণগত মান ভালো থাকে। ফলে এই পদ্ধতির প্রতি তাদের নির্ভরতার কারণে অন্যরাও ঝুঁকে পড়ছেন এর প্রতি। 

তিনি জানান, প্রতি মণে আগে চার থেকে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ পচে যেত। কিন্তু এভাবে পেঁয়াজ রেখে আমি সাড়ে তিনশ মণ পেঁয়াজ বের করে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার কেজি পেঁয়াজ পচা পেয়েছি। পেঁয়াজে দাগও হয় নাই। পেঁয়াজের জিল থাকে ভালো। এই কারণে আমরা এর নাম দিয়েছি ‘কৃষকের এসি’।

এই প্রকল্পের ভ্যালু চেইন স্পেশালিস্ট গাজি মো. আব্দুল্লাহ মাহদী জানান, ‘একটি ভার্টিকাল সিলিন্ডারে মোটর সংযুক্ত করে ছোট একটি কক্ষে এই পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়। এই মেশিনের মাধ্যমে নিচে বাতাস টেনে আটকে দেওয়া হয়। পরে সেই বাতাস পেঁয়াজের ভেতর দিয়ে বের হতে বাধ্য হয়। এতে পেঁয়াজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং পেঁয়াজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে। এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ পচে না। কোনো পেঁয়াজ নষ্ট থাকলে সেটি নিজেই শুকিয়ে যায়, পাশের পেঁয়াজকে নষ্ট করে না।

তিনি আরও জানান, সনাতন পদ্ধতিতে পেয়াজ সংরক্ষণ করলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়, আর এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে মাত্র ১০ শতাংশ নষ্ট হয়। এতে চাষিরা লাভবান হয়।

ফরিদপুর অঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসএমও স্পেশালাইজড ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালে মোহাম্মদ তোফায়েল চৌধুরী বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের এই প্রযুক্তিটি প্রথম বছরেই অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। বছরের ৮ মাস এভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায়। এর মাধ্যমে সংরক্ষিত পেঁয়াজের ওজন হ্রাস শতকরা ত্রিশ শতাংশ এবং পচন প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। এর ফলে আমরা নিজস্ব উৎপাদন দিয়েই পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে পারবো এবং আমদানির বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হবে না।

ফরিদপুর চেম্বার অব কর্মাসের প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘পেঁয়াজ সংরক্ষণে ‘এয়ার ফ্লো মেশিন’ চাষিদের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে। কারণ আমাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যেত তাহলে এই পণ্যটি আমদানি করতে হত না। এতে চাষিরা যেমন লাভবান হতেন তেমনি ফরেন কারেন্সি সেভ হত।’

বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০২২
আরএ


সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান