মস্কো (রাশিয়া) থেকে: প্রচলিত রয়েছে- প্রস্তাবিত রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দুই ঘণ্টার মধ্যে দশ লাখ লোককে সরিয়ে নিতে হবে? সরাসরি নাকচ করে দিলেন বিষয়টি। বললেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জনসংখ্যার ঘনত্ব কোনো বিষয় না।
প্রশ্ন ছিল রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের (প্রস্তাবিত) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাক্সিম ইয়েচিশেভ’র কাছে। যার তত্ত্বাবধানে চলছে বাংলাদেশের পাবনার রূপপুরের পুরো কর্মযজ্ঞ।
সোমবার (৩০ মে) রুশ ফেডারেশনের রাজধানী মস্কোর গসতিননি দোভর’এ (gostinny dvor) ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম অ্যাটমএক্সপোর’র এক ফাঁকে বাংলাদেশি মিডিয়ার মুখোমুখি হন ম্যাক্সিম ইয়েচিশেভ।
জবাব দিলেন অনেক কৌশলে- `রূপপুরের মতো আরও অনেক জনসংখ্যাধিক্য দেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। চীনের লিজুন শহরের রূপপুরের মতোই জনসংখ্যার ঘনত্ব রয়েছে। সেখানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে সমস্যা না হলে পাবনায় কেন সমস্যা হবে?'
মুখে মৃদু হাসির আভা প্রকাশ করে বললেন, ‘কারা কিসের ভিত্তিতে এসব কথা বলে আমরা জানা নেই। আমরা বলতে পারি, এ কথার ভিত্তি নেই। আমরা যা বলছি, সিসমিক সার্ভের ওপর ভিত্তি করেই বলছি। এখানে যদি কখনও দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই’।
‘জনসংখ্যার ঘনত্ব এখানে কোন বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটার ওপর। রূপপুরে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই’ বলেও মন্তব্য করেন ম্যাক্সিম ইয়েচিশেভ।
তিনি বলেন, ‘আমরা চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর অনেক বেশি সতর্ক। ওই ঘটনা কঠোরভাবে মনিটরিং করেছি। সেখানে প্রযুক্তির যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, সেগুলোকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে’।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহাসচিব ড. আব্দুল মতিন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন- ‘জনশ্রুতি রয়েছে, বাংলাদেশে যে মডেলের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে, একই মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতে করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই প্রস্তাব ভারত ফিরিয়ে দিয়েছে’।
এ প্রশ্নের জবাবে ম্যাক্সিম ইয়েচিশেভ বলেন, ‘এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। ভারতে একই মডেলের ৬টি ইউনিট নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে’।
ঘুরে-ফিরে অনেকের প্রশ্ন ছিল, ‘কতো টাকা খরচ হচ্ছে? রসাটম অনেক দেশেইতো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে স্থাপন ব্যয় কম না-কি বেশি হচ্ছে? আবার প্রশ্ন ছিল, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য কতো পড়তে পারে?
এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি ম্যাক্সিম ইয়েচিশেভ। বলেছেন, ‘নির্মাণ ব্যয়ের বিষয়টি অপারেশন ব্যয়, স্থান, প্রযুক্তি ও মডেলের ওপর নির্ভর করে। তাই একটির সঙ্গে অন্যটির তুলনা চলে না। প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ কতো হবে সেটিও এখনই বলার সময় আসেনি। এটি নির্মাণ শেষে অপারেশনাল খরচ দেখে বলা যাবে’।
‘চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বর্জ্য রাশিয়ার নেওয়ার কথা। বাইচান্স কোনো সময়ে যদি রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তাহলে এ চুক্তি কতোটুকু কার্যকর থাকবে? তখন বাংলাদেশের সংকটের মুখে পড়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি-না?’
জবাবে খানিকটা হেসে নিয়ে বলেন, ‘ভূ-রাজনীতির কারণে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। কিন্তু আমরা চুক্তি অনুযায়ী বর্জ্য নিয়ে যাচ্ছি। তাই এ নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আর রাশিয়া কখনও ওয়াদার বরখেলাপ করে না’।
আলাপচারিতায় প্রশ্ন উঠেছিল ফুকুশিমা দুর্ঘটনা নিয়েও। ‘উন্নত দেশ জাপান যেখানে বিপর্যয় মোকাবেলা করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ দুযোর্গ মোকাবেলায় কতোটুকু প্রস্তুত?’
এর উত্তরেও উন্নত ও নিরাপদ প্রযুক্তির কথাই জানালেন রূপপুর প্রকল্পের এই কর্মকর্তা। তিনি বললেন, ‘ওই ঘটনা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেমে নেই। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দেশ যুক্ত হচ্ছে এর সঙ্গে’।
ইয়েচিশেভ’র কাছে প্রশ্ন ছিল- ‘বাংলাদেশে যে প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে, সে প্রযুক্তি একেবারেই নতুন। বলা চলে পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। রাশিয়ায় একই মডেলের যে কেন্দ্রটির বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে গত মাসে (এপ্রিল)। তাই অপ্রমাণিত এ প্রযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে’।
জবাবে ইয়েচিশেভ বলেন, ‘এটি পুরনো প্রযুক্তির রিভাইস ভার্সন, নট রেভুলেন্ট। এতে দুযোর্গ মোকাবেলায় বাড়তি প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে। এ নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণে নেই’।
‘বাংলাদেশ কি হাইটেক প্রযুক্তির এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করার মতো দক্ষতা অর্জন করেছে?’ জবাবে বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ছাত্র রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু নিয়ে পড়ালেখা করছেন। তারা অনেক মেধাবী ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। জনবলের কোনো সংকট হবে বলে আমরা মনে করি না’।
এর আগে গত বছরের ৩ অক্টোবর ঢাকায় বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন ইয়েচিশেভ। তখন বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের নিজেদের দেশে (রাশিয়া) একই মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। এছাড়া এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৭২ ঘণ্টা নিরাপদ থাকবে। যা পুরনো মডেলের বিদ্যুৎ ইউনিটগুলোতে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ছিল’।
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট ছিল। এখানে যে দু’টি ইউনিট স্থাপন করা হবে, এর একেকটির উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে এক হাজার একশ’ ৯৮ দশমিক ৮ মেগাওয়াট। সে হিসেবে রূপপুরের উৎপাদন ক্ষমতা হবে প্রায় ২ হাজার ৪শ’ মেগাওয়াট’।
‘পনের বছরের মধ্যে বিনিয়োগ উঠে আসবে। আর এর লাইফটাইম হবে ৬০ বছর। রাশিয়া একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপারেশন চালাবে। এরপর বাংলাদেশের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হবে। এজন্য বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশি তরুণরা অনেক দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন’।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ইয়েচিশেভ বলেন, ‘পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি জটিল বিষয় হলেও সরকার অত্যন্ত দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে’।
এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার । ২০২৩ সালে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
এসআই/এএসআর