ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাংলা ছোটগল্পে শিক্ষাভাবনা : পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতা

ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১০
বাংলা ছোটগল্পে শিক্ষাভাবনা : পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতা

সাহিত্য যেহেতু সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে অথবা অন্যভাবে বললে বলা চলে, যেহেতু সাহিত্য-শিল্পে সমাজ এবং মানুষের প্রতিফলন ঘটে, তাই অনায়াসে শিক্ষাব্যবস্থাও জায়গা করে নিয়েছে সাহিত্যের-শিল্পের নানান মাধ্যমে। গল্প কিংবা উপন্যাস অথবা নাটকের মতো শিল্পমাধ্যম যখন শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আলোক প্রক্ষেপণ করে, তখন তা অনেকাংশেই বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করে থাকে; আর যদি তা হয় আমাদেরই পরিচিত প্রসঙ্গে ঘেরা, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

বাংলা ছোটগল্পে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার যে ছবি আভাসিত হয়েছে, তা থেকে আমরা যেমন পাঠ নিতে পারি, তেমনি দেখে নিতে পারি আমাদের গলদগুলো। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্যও তা হবে পারে দিকনির্দেশক।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ঔপন্যাসিক, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) তাঁর ‘পাঠশালার পণ্ডিতমশায়’ গল্পে স্কুলশিক্ষকের মিথ্যা পাণ্ডিত্যের অহমিকা আর শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অপ্রাসঙ্গিকতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন কৌতুকাবহ কহিনীর মাধ্যমে। ব্যাকরণের প্রতি পণ্ডিতের গভীর অনুরাগ আর সীমিত জ্ঞাননির্ভর আভিজাত্য যে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম ঐতিহ্য, তার পরিচয় মেলে বঙ্কিমের এই গল্পটির ক্যানভাসে। ভাষার প্রতি আমরা যে কত উদাসীন, শিক্ষাপদ্ধতিও যে বাংলাভাষাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন করেনি, তা আমরা গল্পকারের উপলব্ধি থেকে জানতে পারি। পণ্ডিতের এক বোকা ছাত্রের মা জানতে চান, তিনি এত বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও তার ছেলেকে মারপিট করেন কেন? জবাবে পণ্ডিত জানান, “আরে বেটি, তোর ছেলেকে এমনই বিদ্যান করিব বলিয়াই মারি। না মারিলে কি বিদ্যা হয়?” অবশ্য শিক্ষার্থীর মা পণ্ডিতের এই যুক্তিতে আস্থা রাখেননি; মানুষ গড়ার কারিগরটিকে গৃহিণী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তার কথা ঠিক নয়। লাঠির তাড়া খেয়ে শেষ পর্যন্ত পণ্ডিতকে আমরা  উচিত শিক্ষা লাভ করতে দেখি।

‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের (১৮৬০-১৯৩৯) ‘আরে অর্থাৎ’ গল্পটি আমাদের এই পাঠ দেয় যে, শিক্ষককে অবশ্যই ভাষাপ্রয়োগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হয়। কথা গুছিয়ে বলতে না-পারা কিংবা কথার মাঝে বারবার অপ্রাসঙ্গিক শব্দ বলার অভ্যাসের কারণে শিক্ষকের জীবনে কী দুর্গতি নামতে পারে, তার উদাহরণ গল্পটি। প্রসঙ্গত লেখক শিক্ষকদের মুদ্রাদোষের দিকে পাঠকের নজর আকর্ষণ করেছেন। পাণ্ডিত্য থাকলেও  কেবল মুদ্রাদোষের কারণে একজন শিক্ষককে কী খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, তার বিবরণ জানা যায় শ্রীরাম বিদ্যাভূষণের পরিণতি দেখে। চাকুরিচ্যুত এই পণ্ডিতের কথা বলার বিশেষ ভঙ্গিটি উদ্ধৃত করছি : “যেখানেই- আরে অর্থাৎ- পণ্ডিতির চেষ্টা করি, সেইখানেই পূর্ব চাকুরির- আরে অর্থাৎ- কথা বলতে গিয়ে তোমাদের স্কুলের কথা বলি। মিথ্যা কথাটা- আরে অর্থাৎ- বলতে পারিনে। কেন তোমাদের স্কুলের- আরে অর্থাৎ- চাকুরিটা গেল-, তাও কাজেই বলতে হয়; তাই কেউ আর আমায় নিযুক্ত করতে চান না। এই দুই মাস- আরে অর্থাৎ- দেখলুম; এখন মনে করেছি- আরে অর্থাৎ- দেশে গিয়ে- আরে অর্থাৎ যা হয় করব। গরিব মানুষ, বসে থাকলে- আরে অর্থাৎ- চলে না। ” গল্পটিতে অনুষঙ্গ হিসেবে প্রবেশ করেছে গুরুর সাথে শিষ্যের বেয়াদবি এবং পরবর্তীকালে প্রায়শ্চিত্যের কিঞ্চিৎ নমুনা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো ব্যক্তির মধ্যে একটি বিশেষ নেতিবাচক প্রবণতা ল্যক্ষ করা যায়; তা হলো কারো নামকে বিকৃত করে অথবা অন্য কোনো নাম দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয়ের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য বিরাজ করতে দেখা যায়। বাংলা ছোটগল্পের প্রাণদাতা¡ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এ রকম একটি পরিস্থিতির সাথে গল্পপাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘গিন্নি’ গল্পে। নাম পাল্টে বিকৃত কোনো নামে ডাকলে যে ব্যক্তিমাত্রেই কাতর ও অসহায় বোধ করে; লজ্জাও পায়- সে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন রবিবাবু। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : “বালকদের পীড়ন করিবার জন্য আমাদের শিবনাথ পণ্ডিতের একটি অস্ত্র ছিল, সেটি শুনিতে যৎসামান্য কিন্তু প্রকৃতপে অত্যন্ত নিদারুণ। তিনি ছেলেদের নতুন নামকরণ করিতেন। নাম জিনিসটা যদিচ শব্দ বৈ আর কিছুই নয়, কিন্তু সাধারণত লোকে আপনার চেয়ে আপনার নামটা বেশি ভালোবাসে; নিজের নাম রাষ্ট্র করিবার জন্য লোকে কী কষ্টই না স্বীকার করে, এমনকী, নামটিকে বাঁচাইবার জন্য লোকে আপনি মরিতে কুণ্ঠিত হয় না। এমন নামপ্রিয় মানবের নাম বিকৃত করিয়া দিলে তাহার প্রাণের চেয়ে প্রিয়তম স্থানে আঘাত করা হয়। এমনকী, যাহার নাম ভূতনাথ তাহাকে নলিনীকান্ত বলিলে তাহার অসহ্য বোধ হয়। ”

শিক্ষা মানে গাদা গাদা পুস্তকের বুলি কণ্ঠস্থ করা নয়; মানুষের ভেতরের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে, সৃজনশীল প্রবণতাকে প্রকাশ করতে আর মানবতাকে উজ্জ্বলতর করতে জোরালো ভূমিকা রাখে শিক্ষা। পশুত্বের ওপর দেবত্বের বা কল্যাণবোধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা- এই নিরেট সত্য উপলব্ধির স্বচ্ছ প্রকাশ দেখি যোগীন্দ্রনাথ সরকারের (১৮৬৬-১৯৩৭) ‘জয়-পরাজয়’ গল্পে। গ্রামে শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ সমাপ্ত করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সবাইকে শহরমুখী হতে হয়; ফলে পড়ালেখা এবং জীবন-জীবিকাও হয়ে পড়ে শহরনির্ভর। চাকরির সুবিধা না থাকায় গ্রাম শিক্ষিত লোককে আকর্ষণ করতে পারে না। সম্প্রতি উন্নয়ন সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানির কিছু শাখা অফিস গ্রাম পর্যন্ত গড়িয়েছে বটে; কিন্তু সে সংখ্যা নেহায়েত নগণ্য। শিক্ষিত জনরা গ্রামবিমুখ হয়ে পড়ায় গ্রামের পশ্চাৎপদতাও ঘোচে না সহজে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের গল্পে আমরা এর কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ করি। গ্রামের ছেলে নেপাল পড়ালেখা শেষ করে ওকালতি আরম্ভ করে গ্রামে একটি পাঠাগার স্থাপন করে। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো, আমাদের দেশে এখনও বিপুল সংখ্যক লোক লাইব্রেরি শব্দের তাৎপর্য বোঝে না; শব্দের আভিধানিক অর্থও অনেক সময় পাল্টে গুলিয়ে ফেলে-- বইয়ের দোকান আর পাঠাগার দুটোকেই লাইব্রেরি ভাবা হয়; প্রকৃত অর্থে বুকশপ আর লাইব্রেরি আলাদা জায়গা। পাঠাগারে নানান বিষয়ের বই পড়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনারও সুযোগ থাকে; মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব এবং উপলব্ধি বৃদ্ধিতে পাঠাগার তাই বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। অবশ্য এ ধরনের কাজে অনেক প্রতিকূলতাও মোকাবিলা করতে হয়। তবু থেমে থাকার অবসর আমাদের কোথায়! গল্পকার জানাচ্ছেন : “নেপাল ওকালতি আরম্ভ করিয়া, সর্বপ্রথমেই গ্রামস্থ বালকগণের জন্য নিজ বাড়িতে একটি পুস্তকালয় স্থাপন করিল। সপ্তাহে সপ্তাহে সেখানে নানা সদ্বিষয়ের আলোচনা হইতে লাগিল!” পিছিয়ে-পড়া গ্রামসমাজকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন লেখক; তিনি জানেন জয়-পরাজয় নিয়েই জীবন পদপে আর ব্যর্থতা-সফলতাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় অগ্রগতির ব্যাপারাদি-- নির্মিত হতে থাকে সভ্যতার প্রয়োজনীয় ধাপগুলি। এই গল্পে বর্ণিত ঘটনা থেকে আমরা আরো জানতে পারি, তৎকালে শিশুরা অধিক বয়সে স্কুলগামী হতো; অবশ্য বর্তমানে যে শিশুকে ঘুম না ভাঙতে কোলে করে কিংবা টেনে-হেঁচড়ে স্কুলঘরে পৌঁছে দেওয়ার কালচার চালু হয়েছে, তাও কল্যাণকর নয়। ‘জয়-পরাজয়’ গল্পের কথকের বিবৃতি এরকম : “তখন অঅমার বয়স বারো বৎসর। একদিন মা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘মোহনলাল দেখতে দেখতে তুই বড়ো হয়ে উঠলি। আর হেসে-খেলে সময় নষ্ট করলে চলবে না। কালই তোকে স্কুলে ভরতি করে দেব’। ” এ কথা ঠিক যে, শিক্ষাপলিসি কিংবা ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকলে তা হয় জাতির জন্য ভয়াবহ বিপজ্জনক। যে শিশুকে পাঠ দিতে হবে, তার ধারণমতা বিবেচনায় না-নেওয়ার প্রবণতা অবশ্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না; একগাদা ভারি ও দুর্বোধ্য বই (বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার বই) শিশুর প্রাথমিক পাঠের আনন্দকে চিরতরে বিনষ্ট করার পথ সুগম রেখে জাতিকে আর যাই হোক শিক্ষিত ও নির্ভরশীল করে গড়ে তোলা যায় না।

ছাত্ররাজনীতি (ছাত্রীরাও এর সাথে সম্পৃক্ত! তবে শব্দটি ‘শিক্ষার্থী-রাজনীতি’ হলে মন্দ হতো না) আমাদের দেশে একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ল্যকে সামনে রেখে সচেতনভাবে সভা-সমিতি করতো। যেহেতু শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য অনেক ভূমিকা রাখবে এমনটিই বিশ্বাস করা হয়, তাই তাদের সমাজ-রাজনীতিবিষয়ক সচেতনতার উপলব্ধি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু কালক্রমে শিক্ষার্থীসমাজ রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে রূপান্তরিত হয়ে পড়ায় লেজুড়বৃত্তি আর দলীয় সংকীর্ণতাই হয়ে উঠেছে তাদের আদর্শ। কাজেই আমাদের দেশের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ হয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিত্তশালী এবং রাজনীতি-অধিকর্তারা তাদের সন্তানাদিকে এ নষ্ট পরিবেশ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে (বিদেশের ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; আর বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রভৃতি) তাদের হীনস্বার্থে ব্যবহার করছেন দেশের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। বিদ্যাপীঠে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতি বছর প্রাণ দিচ্ছে বহু তাজা তরুণ। সেশনজটে আটকে পড়ে শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়ছে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা; হতাশা, কান্তি আর অবসাদ দিন দিন গ্রাস করছে তরুণসমাজকে-- কখনও কখনও বিপথেও ঠেলে দিচ্ছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সরকার দুঃখজনকভাবে নির্বিকার!  অথচ, এখনও সময় আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার কেন্দ্রভূমি হিসেবে দাঁড় করাবার। এ প্রসঙ্গে আমরা জেনে নিতে পারি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের রূপকথা-ব্রতকথার অসাধারণ সংগ্রাহক-সংকলক ‘ঠাকুরমা’র ঝুলি’  খ্যাত দক্ষিণরঞ্জন মিত্রমজুমদারের (১৮৭৭-১৯৫৭) ’অখিলেশ’ গল্পটির ক্যানভাস-পরিসরের বক্তব্য। গল্পকথক জানাচ্ছেন : “আমাদের কাসে একটা ‘সখাসমিতি’ আছে। কাসের ছেলে হলেই তাকে তার সদস্য, মানে সভ্য হতে হবে। মাসে চাঁদা এক পয়সা থেকে চার আনা। কাসে যদি কোনো ছেলে বই, খাতা, এমনকী জামা-কাপড়ও কোনো কারণে কিনে উঠতে না পারে, তবে আমাদের ‘সখাসমিতি’ থেকে যতটুকু পারা যায়, তাকে তার জন্য টাকা নিতে বলা হয়। তা ছাড়া ভালো কোনো বইও সমিতি থেকে, সম্ভব হলে, কেনা হতে পারে। ” বিত্তশালীদের সন্তানরাও যে এ ধরনের সমিতির সদস্য হতেন এবং আজীবন সদস্য কিংবা দাতা (ডোনার) হতেন সে কথা অনুমান করা যায় বর্তমান গল্পে চারটে কয়লাখনির মালিকের পুত্র অখিলেশের জীবনসদস্য হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে।

একসময় এ দেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের পাঠে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য কর্তৃপরে ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক ফলাফলের ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদানের রীতি প্রচলিত ছিল। বর্তমানেও চালু আছে বৃত্তি প্রভৃতি কার্যক্রম; কিন্তু তা প্রয়োজন ও শিক্ষার্থী-অনুপাতে এতই নগণ্য হয়ে পড়েছে যে, তা আর চোখে পড়ে না। প্রতি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা অথবা একেক বছর একেক বিষয়ের জন্য সেরা শিক্ষার্থীকে পুরস্কারের বিধান রেখে পড়ালেখার যে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা হতো, তাতে শিক্ষার্থীর মনে লেখাপড়া বিষয়ে ক্লান্তির বদলে যোগ হতো আনন্দ ও সম্ভাবনা। সব বিষয়কে সমান গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটিও প্রতিষ্ঠিত হতো। বাংলা সাহিত্যে রম্যরচনার জন্য বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) তাঁর ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’ গল্পে এই ধারণা ও বাস্তবতার অবতারণা করেছেন। কোনো বিষয়কে বেশি আর কোনোটিকে কম গুরুত্ব দিলে কী পরিণতি হতে পারে, তার নজির স্থাপিত হয়েছে এ গল্পের নন্দলালের ভাগ্যে : “কে জানিত এবার ইতিহাসের জন্য প্রাইজ থাকিবে, আর সংস্কৃতের জন্য থাকিবে না। ইতিহাসের মেডেলটা তো সে অনায়াসেই পাইতে পারিত। ”

আমাদের দেশে শিশুর ইচ্ছা ও ঝোঁক অনুযায়ী তার লেখাপড়ার ল্ক্ষ্য নির্ধারণ করার রীতি কিংবা নীতি কোনোটাই প্রতিষ্ঠা করা যায়নি আজ অবধি। যে হতে চায় শিল্পী, তাকে আমরা ডাক্তার বানিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি কিংবা শিক্ষক হতে চাওয়া পুত্র বা কন্যাকে বানাই ইঞ্জিনিয়ার অথবা পাইলট। কত ছেলেকে যে স্কুলঘর থেকে বের করে দোকানদার বানানো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ শিশুর সৃজনশীল প্রবণতা আর আগ্রহের দিকটাতে গুরুত্ব দেওয়া শিক্ষাতত্ত্বের অন্যতম কৌশল বলে সারা দুনিয়ায় সর্বকালে বিবেচিত হয়ে আসছে। শিশুসাহিত্যিক হেমন্তকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) তাঁর ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন গোয়েন্দা হতে চাওয়া বালককে সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষা গিলতে ঠেলে পাঠানোর অশুভ পরিণতি। গল্পটির শুরুর পাঠটুকু থেকেই আমরা এ বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারি। হেমন্তকুমার লিখছেন : “বিধু বলত, ‘ম্যাট্রিক পাশ করেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হব। ’ বিধু যে ম্যাট্রিকের ফটক পেরোতে পারবে, এত বড়ো দুরাশার জন্ম অসম্ভব। বিড়ালের কাছে কুকুর যেমন, তার কাছে স্কুলের বইগুলোও ছিল তেমনি চুশূল। দিনরাত পড়ত খালি গোয়েন্দা কাহিনী। ” ডিকেটিভের দায়িত্ব ও গুণাবলি আয়ত্ত ও অধিকার করতেই সে ব্যয় করতো বেশিরভাগ সময়; ঘটনার সূত্র আবিষ্কার করার মতা, সর্বদা সবকিছুতে সতর্ক নজর রাখা, অসীম সাহসে বিপদ-আপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, উপস্থিত বুদ্ধি খাটানো প্রভৃতির চর্চাই ছিল বিধুর প্রধান কাজ। সে মনে করতো : “যত হাঁদারাম গিয়ে বাংলাদেশের পুলিশের দলে ভরতি হয়েছে! চোর-ডাকাত ধরবার আসল ফন্দিই তারা জানে না। শার্লক হোমসের মতো পাকা ডিটেকটিভ এখানে নেই। ” তাই সে হতে চেয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম শার্লক হোমস; কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন না থাকায় বিধুর সে স্বপ্ন অচিরেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতা একটি পরিচিত চিত্র। পিছিয়ে-পড়া গ্রামীণ পরিবারগুলো যদিও পারিবারিক আয়-ব্যয়, জমিজমা, ফসল-ফলাদি, ধার-দেনা-পাওনা প্রভৃতির হিসাব-নিকাশের জন্য শিক্ষা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, কিন্তু রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা এবং কাদাজল ও ধূলাবালির পথ পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য রীতিমতো এক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৫০) বলছেন সেই অসুবিধার কথা, তাঁর ‘হারুন-অর-রশীদের বিপদ’ নামক গল্পে। তিনি লিখছেন : “জানিপুর থেকে দুটি ছেলে পড়তে আসে ইস্কুলে। এ অঞ্চলে আর ইস্কুল নেই, ওদের বাড়ির অবস্থা ভালো, যদিও সাতপুরুষের মধ্যে অরপরিচয় নেই, তবুও বাপ-মায়ের ইচ্ছে, যখন ধান বেচে কিছু টাকা পাওয়া গেল, তখন ছেলেরা লেখাপড়া শিখুক। চাষা লোকদের জন্যেও লেখাপড়ার দরকার আছে বৈকি! ধানের হিসেব, জনমজুরের হিসেব রাখাও তো চলবে। ” প্রসঙ্গত লেখক পাঠকেন্দ্রের কয়েকটি অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন : ইন্সপেক্টর বাবুর স্কুল পরিদর্শন, বিদ্যালয়ে পাঠ-কার্যক্রমের বেহাল অবস্থা, পড়া ফাঁকি দিয়ে প্রহার থেকে রেহাই পাবার জন্য শিক্ষককে উপঢৌকন প্রদান এবং শিক্ষকের পপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যাপীঠে নিয়মিত অ্যাকাডেমিক মনিটরিং এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তুত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ যে কত প্রয়োজন, তা অনুধাবন করা যায় বর্তমান গল্পের পাঠ থেকে। বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গনের প্রায়-অচলাবস্থার পেছনেও এই মনিটরিং ব্যবস্থার অভাবই মূলত দায়ী; বছর বছর কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধিভুক্তি আর বেতন প্রদান করলেই শিক্ষাপ্রশাসনের দায় ও দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না-- যে প্রতিষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্র তার জনগণের রাজস্ব থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, তার কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে তদারকি থাকা বিশেষ দরকার। আর তা করা না গেলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান অস্থিরতা-দুর্নীতি-অদতা ও ব্যর্থতার পরিমাণ বাড়তে থাকবে; পরিণামে জাতিকে গুনতে হবে অপরিমেয় মাশুল।

‘আদু ভাই’ গল্পটির সাথে বাঙালির বিশেষ পরিচয় আছে। সম্ভবত এটিই বাংলাসাহিত্যে সর্বাধিক আলোচিত স্কুল-বিষয়ক গল্প।   কোনো শিক্ষার্থী একই শ্রেণিতে দীর্ঘকাল লেখাপড়া করতে থাকলে আদু ভাই পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য বর্তমান বাংলাদেশে সেশনজট নামক যন্ত্রণাও অনেককে তথাকথিত আদু ভাই করে তুলছে; জাতির মাথায় চেপে বসছে অবমাননার ভার। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৮৯) রচিত ’আদু ভাই’ গল্পে এই কিংবদন্তি চরিত্রটির (বলা বাহুল্য, এই কিংবদন্তির স্রষ্টা তিনিই) পরিচয় জানাচ্ছেন এভাবে : “আদু ভাই কাস সেভেনে পড়তেন। ঠিক পড়তেন না বলে পড়ে থাকতেন বলাই ভাল। কারণ, ঐ বিশেষ শ্রেণী ব্যতীত আর কোন শ্রেণীতে তিনি কখনো পড়েছেন কি-না, পড়ে থাকলে ঠিক কবে পড়েছেন সে কথা ছাত্ররা কেউ জানত না। শিক্ষকরাও অনেকে জানত না বলেই বোধ হত। ”

আদু ভাই অত্যন্ত নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী ছিলেন-- রোজ পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে স্কুল করতেন, ঝড়বৃষ্টি-অসুখবিসুখ কিছুতেই তিনি স্কুল কামাই করতেন না। আচার-ব্যবহারেও তিনি সকলের প্রিয় ছিলেন। নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত থাকা আর ভালোস্বভাবের জন্য দুটো পুরস্কার তিনি প্রতি বছর পেয়ে আসছেন। প্রমোশন না পেলেও তার কোনো দুঃখ ছিল না; অবশ্য ডিমোশন যে হয়নি বছর বছর, তাও কম কিসে! আর তিনি মনে করতেন : “জ্ঞান লাভের জন্যই আমরা স্কুলে পড়ি, প্রমোশন লাভের জন্য পড়ি না। ”-- আদু ভাইয়ের এই চিন্তা ও বিশ্বাস নিশ্চয়ই আমাদের সার্টিফিকেটসর্বস্ব পাঠপদ্ধতির পিঠে এক কড়া চপেটাঘাত। তার অন্যান্য গুণাবলির কথাও আমরা জানতে পারি-- স্কুলের সাপ্তাহিক সভায় বক্তৃতা করা আর কবিতা আবৃত্তি করায় তার কোনো জুড়ি ছিল না। (এ রকম সভা কি আর আজকাল অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়!-- অথচ শিক্ষার্থীর মন ও মেধার বিকাশের জন্য তা কতই না উপযোগী!) প্রমোশনের লোভে আদু ভাই কখনও কোনো শিক্ষককে নম্বর বাড়িয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেননি। তিনি উত্তরপত্রে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতেন; যেমন একবার তার ভূগোলের খাতায় পাওয়া গেল-- পৃথিবী গোলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না।

কিন্তু এই দৃঢ়চেতা শিক্ষার্থীকে একবার ভীষণ বিচলিত দেখা গেল, যে বার তার পুত্র প্রমোশন পেয়ে কাস সেভেনে উঠলো। “নিজের ছেলের প্রতি আদু ভাইয়ের কোনো ঈর্ষা নেই। কাজেই ছেলের সঙ্গে এক শ্রেণীতে পড়ায় তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু আদু ভাইয়ের স্ত্রীর তাতে গুরুতর আপত্তি আছে। ফলে, হয় আদুভাইকে সেবার প্রমোশন পেতে হবে, নয়তো পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আদু ভাই বাঁচবেন কি নিয়ে?” তাই দিনরাত পড়াশোনা শুরু করলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন; কিন্তু লেখাপড়া ছাড়লেন না। প্রধান শিকক্ষ তাকে প্রমোশনের আশ্বাস দিলেন, আদু ভাই অসুস্থ অবস্থায় পালকিতে চড়ে পরীক্ষা দিলেন, কথামতো তাকে প্রমোশনও দেয়া হলো, কিন্তু সব প্রত্যাশাকে মাটি চাপা দিয়ে আদু ভাই মৃত্যুবরণ করলেন। তার কবরে খোদাই করে মারবেল পাথরে লেখা হলো :  Here sleeps Adu Miah who was promoted from class 7 to 8.

গল্পটিতে আবেগ আছে, অধ্যবসায়ের উদাহরণ আছে; কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে অপ্রকাশিত-অজানা কিছু প্রশ্ন। এতদিন একজন শিক্ষার্থী একই শ্রেণীতে পড়ার সুযোগ পায় কোন নিয়ম অনুযায়ী? পেছনের ছয়টি শ্রেণীতে কীভাবে সে প্রমোশন পেল, আর যদি আগের প্রমোশনগুলো যোগ্যতাবলেই পেয়ে থাকে, তাহলে হঠাৎ এমন কী ঘটনা ঘটলো যে, প্রমোশন নামক সোনার হরিণের নাগাল সে কিছুতেই লাভ করতে পারছে না? তার সংসার প্রভৃতির কি কোনো দায়িত্ব ছিল না? নাকি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রয়ে গেছে এমন কিছু গলদ, যার কারণে আদু ভাই নামক গল্পের সৃষ্টি!

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৭১) ‘হেডমাস্টার’ গল্পে স্থান পেয়েছে শিক্ষার্থী-আন্দোলন, মতার লোভ ও দলবাজি, আদর্শ ও মূল্যবোধবিষয়ক চিন্তার পার্থক্য, লেখাপড়ার চেয়ে টাকাকড়ি উপার্জনের নেশায় পেয়ে বসা, শিক্ষাসম্পূরক কার্যাবলি বিষয়ে ভিন্নমত, ত্যাগের চেয়ে ভোগের নীতিকে মান্য করার আধুনিক প্রবণতা আর পুরনোর ওপর নতুনদের অনাস্থা এবং সবকিছুকে পায়ে দলে বিজ্ঞানের গতিতে জীবনের যাত্রাপথকে শামিল করার বাসনা।

চন্দ্রভূষণ বিএ পাস করে একুশ বছর বয়সে গ্রামে একটি স্কুল বানিয়ে তার লালন ও পরিচর্যা করছেন ঊনপঞ্চাশ বছর ধরে। সরকারি চাকরির ইচ্ছা পরিত্যাগ করেছিলেন নিজ গ্রামের অন্ধকার দূর করে শিক্ষার আলোক প্রতিষ্ঠা করবার অভিপ্রায়ে! কিন্তু প্রায় তিন প্রজন্ম পরে তিনি পড়লেন এক মহাসংকটে; তার আদর্শ ও নীতিকে মানতে চাইছে না এ প্রজন্মের ছেলেরা, এমনকি কোনো কোনো মাস্টারও! তারা পরিবর্তনের বারতা নিয়ে পুরনো সবকিছুকে মিথ্যা ও অপ্রয়োজনীয় বলে চন্দ্রভূষণের আদর্শ ও প্রেরণাকে পরিত্যাগ করতে উদ্যত। স্কুলে নিয়মিত সাপ্তাহিক ধর্মসভার আয়োজন হয়ে আসছিল; ছেলেদের ধর্মপ্রীতি ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিল এ ব্যবস্থা; দীর্ঘদিন বিনা বাধায় চালুও ছিল। বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার নতুন আদর্শে অনুপ্রাণিত ছেলেরা স্তোত্রপাঠ ও ধর্মসভাকে শিক্ষাবিভাগ প্রবর্তিত পাঠসূচির বাইরের বিষয় বলে অভিহিত করে তা পরিহার করার পক্ষে মত দিচ্ছে; দুঃখকে আনন্দে পরিণত করার প্রবণতা কিংবা ত্যাগ স্বীকার করার মহত্ত্ববাণী পরিহার করে কৃচ্ছ্রসাধনের চেয়ে অর্জনের গৌরবকে আয়ত্ত করতে চায়। তারা যখন স্কুল বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন চন্দ্রবাবু নতুন বারতাকে স্বাগত জানালেন; রেজিগনেশন লেটার লিখে স্কুল সেক্রেটারিকে তিনি বলেন : “ছেলেরা ফিরে আসুক- স্কুল বাঁচুক। আমার আদর্শ ওরা মানছে না, আমার কাল গত হয়েছে। আমি চলে যাচ্ছি- স্কুল বাঁচুক। ” গল্পটিতে পরিবর্তিত সময়ের প্রয়োজন এবং অন্যদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেবার মতো উদার ও গণতান্ত্রিক চেতনার বাণী প্রকাশিত হয়েছে।

বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯) ‘যোগেন পণ্ডিত’ গল্পে স্কুলশিক্ষকের আদর্শ, ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষার্থীদের শাসন ও স্নেহ করবার প্রবণতার কথা স্থান পেয়েছে; জায়গা করে নিয়েছে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশের প্রাসঙ্গিকতা। পাশাপাশি নতুন যুগের পরিবর্তনের হাওয়া পুরনো ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থার গায়ে যে চপেটাঘাত হেনেছে, তর ছবিও আভাসিত হয়েছে। যোগেন পণ্ডিত বিদ্যালয়ে পাঠদান করতে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেন; পড়া না পারলে বেতও মারেন। শেষ বয়সে তার পরিণতির ইঙ্গিত গল্পটির শুরুতে লেখক পরিবেশন করেছেন এভাবে : “হরিপুরের লোয়ার প্রাইমারি স্কুলের যোগেন পণ্ডিত বড়োই মর্মাহত হলেন বৃদ্ধবয়সে। নূতন যুগের নূতন চালচলনের সঙ্গে কিছুতেই তিনি মানিয়ে চলতে পারলেন না। এখনো তিনি ছেলেদের পড়া মুখস্ত করতে বলেন, না পারলে শাস্তি দেন। ...তিনি ছেলেদের মারতেন বটে, কিন্তু ভালোও বাসতেন। কতই-বা মাইনে পান, কিন্তু তার থেকেই তিনি ভালো ছেলেদের পুরস্কার দিতেন, গরিব ছেলেদের বই কিনে দিতেন। কারো অসুখ হলে, বারবার গিয়ে খোঁজ নিতেন তার বাড়িতে। দরকার হলে সেবাও করতেন। ” পণ্ডিতজীর কাণ্ড দেখে বলতে ইচ্ছে করে, ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। ’ পণ্ডিতকে অবশ্য নতুনের বাতাসের কাছে পরাজয় মানতে হয়েছিল! আমাদের দুর্ভাগ্য শিক্ষকের সেবাপ্রবণতা আজ প্রায় বিলীন হয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী আজ যেন প্রতিপ হয়ে দাঁড়িয়েছে!

শিক্ষকদের নানান নেতিবাচক প্রবণতা নিয়ে রম্যকাহিনী কিংবা রম্যরচনা তৈরির কথা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটি বিষয়। আর আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পাশাপাশি মারামারি কম্পিটিশানও একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল এদেশে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০) ‘জেনারেল ন্যাপলা’ এরকম বাস্তবতা বিবরণের একটি গল্প। প্রসঙ্গত এ গল্পের একটি ছড়া উদ্ধৃত করছি :
“মাস্টারবাবু হরি ঘোষ
মাথায় টাক কী ভীষণ
গোঁফ দেখে হয় পরিতোষ
যেন রে সুন্দরবন।
গোঁফে যদি যেত টাক ঢাকা
কী শোভা হত মরি মরি!
ঘুমুরেই শুরু নাক ডাকা
ঘড়র ঘোঁৎ-- হরি হরি!”
প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান গল্পে আরেকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা অবগত হই, তা হলো অভিধান ব্যবহারের তাগিদ। কঠিন ও দুর্বোধ্য শব্দের অর্থ-উদ্ধারের জন্য যে অভিধান দেখার প্রয়োজন পড়ে, তা বাঙালির উপলব্ধির প্রায় অনেকটা বাইরেই রয়ে গেছে; অভিধান ঘরে রয়েছে এমন পরিবারের সংখ্যাও নেহায়েত হাতেগোনা! শিক্ষার রুচি কিংবা অভিরুচি যা-ই বলি না কেনো অভিধানের সম্পৃক্ততা কিন্তু বাদ দেওয়া চলে না কিছুতেই।

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-১৯৭৬) রচিত ‘আমাদের সেকেন্ড পণ্ডিত’ গল্পটিতে প্রকাশ পেয়েছে শিক্ষকের বিদ্যাস্বল্পতা, আর্থিক অসচ্ছলতা, টাকাকড়ির প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক প্রভৃতি বিষয়। আর আছে ভাষাদতার প্রসঙ্গ। শিক্ষককে সম্মান এবং সম্মানী দিতে আমাদের যে কার্পণ্য সে কথাও পরিবেশিত হয়েছে।

এছাড়া শিক্ষাপরিসর, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকের নানান প্রবণতা আর বাস্তবতার নিরিখে কিছু তথ্য ও পরামর্শ পাওয়া যাবে সুনির্মল বসু (১৯০২-১৯৫৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯০৯-১৯৬৯), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-১৯৯৫), আশালতা সিংহ (১৯১১-১৯৮৩), সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২), শঙ্খ ঘোষ (জন্ম : ১৯৩২), জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২), আমজাদ হোসেন (জন্ম : ১৯৪২) প্রমুখ গল্পনির্মাতার কল্পনাবিন্যাসে।

গল্পকে আমরা যদি কেবল গল্প না ধরে সমাজের দেয়াল কিংবা পাটাতন ভেবে বিবেচনার চোখ প্রসারিত করি, তাহলে দেখবো বাংলা গল্পে তৎকালীন ভারত কিংবা পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালের বাংলাদেশের শিক্ষাভুবনের যে ছবি আভাসিত হয়েছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ পথ ও পাথেয় নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উপাদান সরবরাহ করতে পারে। এখন প্রয়োজন শুধু অনুধাবন করার শক্তি আর গ্রহণ করার ও প্রয়োগ করার মানসিকতা এবং সামর্থ্য।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।