We know not through our intellect but through our experience.
― Maurice Merleau-Ponty, Phenomenology of Perception
বস্তুর সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক দুই সুতো। এক সুতোয় বস্তু মাত্র আকার।
রিপন সাহা নবীন প্রতিভাবান বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পী। কারণ তিনি বাস্তবকে বাস্তব আকারে হাজির করেন না। বাস্তবকে অপর বাস্তবে হাজির করেন শিল্পে। শিল্পীর আবেগ এখানে বাহ্য। শিল্পী বস্তু বা আকার দিয়ে তাড়িত। এই তাড়না রাজনীতির। রাজনীতি মানে শিল্পীর নীতিশাস্ত্র। এই নীতি শিল্পীকে বস্তু বা দৃশ্যের প্রক্রিয়ার দারস্থ করে। শিল্পী বস্তু বা দৃশ্যের কী নিচ্ছেন আর কী বাদ দিচ্ছেন না সেটাই মূখ্য। শিল্পীর এই বাছাই প্রক্রিয়াকে আমরা বলছি বুদ্ধির খেলা।
যে বস্তু বা দৃশ্য শিল্পীকে তাড়িত করে, শিল্পী তার ওপর সওয়ার হন। শিল্পী প্রক্রিয়াগতভাবে এমন ইমেজ হাজির করেন যা বস্তুত সমাজে বাস্তব কাঠামোয় কার্যকর থাকে বা দৃশ্যমান থাকে। এই ইমেজের মধ্যে কখনও কার্ল মার্কস, কখনও মুক্ত বাজারি পণ্য, কখনও পশু, কখনও বিজ্ঞানের সূত্র, কখনও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ, কখনও রক্তাক্ত মানুষ, কখনও সশস্ত্র রূপ, কখনও শিল্পী নিজেই নানা ভঙ্গিমায় উপস্থিত হন। এই দৃশ্যকল্প নিরীহ নয়। পুরাটাই রাজনৈতিক কাঙ্ক্ষার ওপর নির্ভরশীল। শিল্পী যেই কাঙ্ক্ষার ওপর রাষ্ট্র বা সমাজকে দেখতে চান তা পরাদস্তুর। ফলে ইমেজে কখনও জাতীয়তাবাদ বা কখনও আন্তর্জাতিকতার সূত্র খোঁজেন। সেটা কেমন?
সামাজিক আর রাজনৈতিক বর্তমান তার কাছে ভাড়ামির নামান্তর। ফলে ক্যানভাসের উপস্থাপনার রীতি কখনও বাস্তব রূপককে বাস্তব আকারে রাখেন না। যেমন তার একটি শিল্পকর্মের নাম ‘সর্ট স্টোরি বা ‘ছোট গল্প’। এই শিল্পকর্মে দেখা মিলছে, নানান ইমেজের বুদ্ধিবৃত্তিক রগঢ়। বিজ্ঞানের উপাদান যেমন মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ আছে, তেমনি আছে শিল্পী সুলতানের বৃক্ষ রোপণ থেকে জৈবিক বদহজমের দৃশ্য। এই দৃশ্যকল্প সংঘাতপূর্ণ নয়, আছে আলাদা আলাদা ভর কেন্দ্রে। সমাজের সমন্বয়হীনতা শিল্পীর কাছে প্রতীক রূপে জায়মান।
অপর এক শিল্পকর্মের নাম ‘দি গেম’ বা ‘খেলা’। ক্যানভাসে দেখা যাচ্ছে, দাবার ঘরের নানা ছকে নানা ধরনের মানুষ। বিমূর্ত ধাঁচের এক মূর্ত মানুষ গুটির ছকে মানুষকে নিয়ে খেলছে। এরা কেউ ঘরের রেখা ভাঙতে পারছে না। কিন্তু দাবা ঘরের মাঝখানে আহত একজন পড়ে আছে। দেখলে মনে হতে পারে আহত এই ব্যক্তি শিল্পী নিজেই। ছক ভাঙলেই ব্যক্তির অস্তিত্ব নাই হয়ে যায়। তবে শিল্পকর্মে দাবার ছকের সহিংসতার আদল স্পষ্ট। সেটা কী?
শিল্পী রিপন সাহা তিন পদের উপর দাঁড়িয়ে শিল্পের আকার দেন। পহেলা পদে, শিল্পের উপাদান হিসেবে রিপন যে সব প্রতীক হাজির করেন সেটা নিছক ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নয়। যা ধারণাগত রাজনীতি। দোসরা, এই সব ইমেজ কী ফলাফল বা ক্রিয়া সৃষ্টি করে। তার উপস্থাপনায় এই ফল ‘বিষণ্ণ সুন্দর’। কারণ তার প্রায় সকল ক্যানভাসে কালো ছায়া আর রক্তাভ রং আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তেসরা, রিপন সহিংস রূপের সাথে সুন্দরের একটা সম্পর্ক তৈরি করেন। ফলে ক্যানভাসের দৃশ্যপটে সহিংসতা অসহনীয় মনে হয় না।
শিল্পী রিপন সাহার এই দর্শনীর নাম ‘উদযাপিত সহিংসতা ৩’। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান ও কাহকেশা সাবাহ এই দর্শনীর কিউরেটর। ধারাবাহিকভাবে তার কাজটি করে আসছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সহিংসতা কি উদযাপনের জিনিস? এককথায়, রাষ্ট্র আর পুঁজি সহিংসতাকে সামাজিক করে তুলছে। ক্ষমতার কেন্দ্র হতে এটা বিচ্ছিন্ন কোনও বাস্তবতা নয়। সহিংসতা যেখানে সম্ভব তখন সেটাই বাস্তব। তার রাজনৈতিক আর সামাজিক ফল শিল্পে ধারণ করাকে বলা যায় উদযাপন। শিল্পের নিছক সৌন্দর্যবোধে সহিংসতা আরামদায়ক নয়। বরং প্রশ্নতাড়িত সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা সেই পথকে উস্কে দেয়।
রিপন সাহা প্রথম একক প্রদর্শনী হয় চট্টগ্রামে ২০১৪ সালে। তার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী ‘উদযাপিত সহিংসতা’। রাজধানীর কলাকেন্দ্রে প্রদর্শনী চলে ২৩ মে পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫