ঢাকা, রবিবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ জুন ২০২৪, ০৮ জিলহজ ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

এক যে ছিলো রাখাল বালক | সোলায়মান সুমন

ব্যঙ্গরচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
এক যে ছিলো রাখাল বালক | সোলায়মান সুমন

** প্রথম পর্বের পর…(প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন)
একদিন যায়, দু’দিন যায়, তিন দিন যায়- খোঁজ আর পাওয়া যায় না। রাজন্যরা বলেন, স্বপ্নে দেখা নগরের সন্ধান বাস্তবে কি পাওয়া সম্ভব! কিন্তু এ কথা সাহস করে রাজা বীরেন সিংকে কেউ বলতে পারে না।

সবাই কানাঘুষা করে, দুশ্চিন্তায় রাজার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এমন অদ্ভুত গ্রামের নাম তারা কোথাও শোনেনি।

কিন্তু রাজা বীরেন সিংহের বিশ্বাস, তার স্বপ্ন শতভাগ সত্য। কারণ, সেদিন এক দরবেশ যে তার সঙ্গে দেখা করতে দরবারে আসতে চেয়েছিলেন সেটা তো সত্যি। তাছাড়া স্বপ্নটা রাজার মোটেও স্বপ্ন মনে হয়নি। মনে হয়েছে বাস্তব ঘটনা। তিনি যেনো জেগেই ছিলেন।

যাক সে কথা। এরই মধ্যে রাক্ষস আরও একবার আক্রমণ করে বসে। আবার শত শত নিরীহ প্রজার প্রাণ যায়। এরপরও অনেক দিন কেটে যায়। খোঁজ চলতে থাকে। খোঁজ মেলে না। অবশেষে প্রসূন নগরের সন্ধান পায় রাজার গুপ্তচরেরা। দেশের শেষ প্রান্তে পাহাড় দিয়ে ঘেরা নিভৃত ছোট্ট এক নগর। রাজ্যের একেবারে সীমান্তে সে নগরটি অবস্থিত। স্থানীয় মানুষের কাছে সেটি প্রসূন নগর হিসেবে পরিচিত। তাদের ভাষা সংস্কৃতি একেবারে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। দেরি না করে রাজা নিজে সে নগরে যাবার প্রস্তুতি নেন। সে কী দীর্ঘ যাত্রা! পাঁচ দিন পাঁচ রাত কেটে যায়। তারপর রাজা বীরেন সিং পৌঁছান পাহাড়ের ছায়াঘেরা স্বর্গের মতো সুন্দর এক নগরে। এই সেই নগর যার নাম প্রসূন। এক নগরবাসী গাছের তলায় বসে আপন মনে মাটির পুতুল বানাচ্ছিলেন। রাজা ও রাজার সফরসঙ্গীকে দেখেও তিনি এতোটুকু বিচলিত হলেন না। আপন মনে নিজের কাজ করে চলেছেন। এতে রাজা মনোক্ষুণ্ন হলেও কিছু বললেন না। এখন অবাক বালক আইজানকে খুঁজে বের করাই তার একমাত্র কাজ। মৃৎশিল্পীকে আইজানের কথা জিজ্ঞেস করাতেই তিনি দূর পাহাড়ের চূড়া দেখিয়ে দেন। রাজা বুঝতে পারেন, আইজান সত্যিই এ নগরে সবার প্রিয় একটি বালক। সবাই তাকে চেনে। রাজার সফরসঙ্গীরা তার সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় যেতে চাইলেও তিনি সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যান।

রাজা বীরেন সিং পাহাড়ে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সূর্যালোক ক্ষীণ হতে হতে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। রাজা যখন হাফাতে হাফাতে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেন। চূড়ায় সন্ধ্যার নীলাভ আবছা আলোর খেলা। কী যে মনোরম সে দৃশ্য! নানা রঙের ফুল আর পাতাবাহারে ভরে রয়েছে চারপাশ। পাহাড়ি ভেড়া আর ছাগলের পাল নিশ্চিন্তে চারদিকে চরছে। গাছে গাছে বাড়িফেরা পাখিদের উদ্বেল কণ্ঠের মিষ্টি কোরাস। রাজা বীরেন সিং এক বুক মুগ্ধতা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সমস্ত ক্লান্তি যেনো তার নিমেষেই দূর হয়ে গেছে। মখমলের গালিচার মতো সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাজা ভাবেন, নগরের রাজা প্রাসাদটিকে স্বর্গের মতো সুন্দর করার জন্য কতো কী না করেছেন। শ্বেতপাথরের ইমারতকে স্বর্ণ, হীরা, চুনি,পান্না, মুক্তা দিয়ে সাজিয়েছেন। কতো শিল্পী, শ্রমিক দিনের পর দিন কাজ করেছেন। রাজকোষ মনে হয় ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রাসাদের কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য প্রজাদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হয়েছে। তারপরও কী এমন সুন্দর হয়েছে তার প্রাসাদ? হয়নি। আসলে বিধাতার মতো সুন্দর সৃজন আর কারও দ্বারা কি সম্ভব! ঘাসের বুকে ফুটে থাকা নানা রঙের ফুলগুলোর উপর রাজা আদরের স্পর্শ বুলিয়ে দেন। দূর থেকে মিষ্টি বাতাস এসে রাজার প্রাণ জুড়িয়ে দিলো। চূড়া থেকে নিচের নগরটিকে মনে হচ্ছে শিল্পীর আঁকা স্বর্গের ছবি। হঠাৎ দূর থেকে বাঁশির সুমধুর সুর ভেসে এলো। রাজা ভাবলেন, এ নিশ্চয় রাখাল বালক আইজানের বাঁশির সুর। এতো সুমধুর সুরে বাঁশি বাজানো তারই দ্বারা সম্ভব। হ্যাঁ, ওই তো দূরে একটা বিশাল বটগাছ দেখা যাচ্ছে। বাঁশির সুরের টানে ভেড়ার পাল গাছটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজা এগিয়ে গিয়ে এক রাখাল বালককে গাছের নিচে বসে মনের আনন্দে বাঁশি বাজাতে দেখলেন।

রাজা বালকটির কাছে গেলে বালকটি বাঁশি বাজানো বন্ধ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো, ‘আপনি আমাকে কিছু বলবেন?’
‘হুম। ’ রাজা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘তোমার নাম আইজান?’
‘হ্যাঁ। ’


‘তুমি নিশ্চয় জানো, দেশে একটা রাক্ষসের উপদ্রব শুরু হয়েছে। সে রাতের আঁধারে বেরিয়ে এসে প্রজাদের ক্ষতি করে আবার কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। ’
‘শুনেছি, কিন্তু আমি কী করতে পারি? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি এদেশের রাজা?’


‘ঠিক অনুমানটাই করেছ। আমিই এদেশের রাজা কিন্তু আমি ওই রাক্ষসকে মারতে ব্যর্থ হয়েছি। এভাবে যদি দিনে দিনে আমার প্রজারা শেষ হয়ে যায়, আমি শাসন করবো কাদের? আমার স্তূতি করবে কারা। কারা আমাকে খাজনা দেবে? রাজ্য শাসনের সুখ কি তখন আমার থাকবে?’ রাজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

আইজান রাজার কথায় হাসে। ‘সেতো ঠিক কথা। কিন্তু আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’
রাজা বীরেন সিং বালকের হাসি দেখে বিরক্ত হন। ‘তুমিই সব পারো। আমি তোমাকে দেখেই বুঝেছি, তুমিই সেই আইজান। এক দরবেশবাবা স্বপ্নযোগে আমাকে বলেছেন, তুমি পারো ওই রাক্ষসটাকে হত্যা করতে। ’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার দ্বারা সম্ভব, এতোটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?
‘তোমার দ্বারাই সম্ভব। ওই রাক্ষসকে মারার জন্য যে শক্তি দরকার তা তোমার মধ্যে আছে। দরবেশ বাবার স্বপ্নের কথা হুবহু সব মিলে যাচ্ছে। তুমিই পারবে। বিনিময়ে তুমি যতো সম্পদ চাও তাই পাবে। ’
‘আমার সম্পদের উপর কোনো লোভ নেই। কিন্তু আমার দ্বারা যদি দেশের মানুষের উপকার হয় আমি তা করবো। তাতে আমার জীবন যাবে যাক। ’
‘তাহলে চলো রাজপ্রাসাদে। ’
‘হ্যাঁ, চলেন। ’ রাখাল যুবক নতুন বাঁশি বাজাতে শুরু করলো। পালে পালে গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল উপত্যকার ঝোপ-ঝাড় থেকে বেরিয়ে এসে সারি বেঁধে দাঁড়াতে লাগলো। ওরা আইজানকে অনুসরণ করে পাহাড়ের উপত্যকা বেয়ে নিচে নামতে থাকে। রাজা অবাক হলেন আইজানের তেলেসমাতি কাণ্ড দেখে।

চলবে…



বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।