ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

হুমায়ুন আজাদের লড়াই

চঞ্চল আশরাফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১০
হুমায়ুন আজাদের লড়াই

‘আমরা আসলে যে-সমাজে বাস করছি এই সমাজ এক ধরনের রাজতান্ত্রিক সমাজ। যদিও আমরা একে গণতন্ত্র বলে থাকি।

যদিও আমরা তথাকথিত নির্বাচনের আয়োজন করছি। ... আমরা জানি আমাদের যে প্রধানমন্ত্রী তিনি আসলে রাজা; আমাদের যে মন্ত্রিসভা এরা রাজার পারিষদ। রাষ্ট্রের সমস্ত অধিকার তারা ভোগ করতে চায়। ... এখানে সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার নেই। ’

থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হসপিটাল থেকে চিকিৎসাফেরত হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) জার্মানি যাওয়ার আগে অর্থাৎ মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ‘মানবাধিকার ও লেখকের স্বাধীনতা : প্রেতি বাংলাদেশ’  নামে দেওয়া তাঁর শেষ বক্তৃতায় এই কথা বলেছিলেন। আরও অনেক কথা বলেছিলেন, সেগুলোর প্রতিটিই কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একটা ভীতিকর চেহারা সে-সবের মধ্যে সহজেই দেখা যায়। স্বাধীনতার পর সেই সময়টি ছিল ভয়ঙ্কর, সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন : সারা দেশে লুটপাট, সন্ত্রাস, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা খুব চলেছিল আর মতাসীনদের তাতে বেশ উৎসাহ ছিল। এখন সব তথ্য বের হতে চলেছে, আরও হবে; সেই ভয়াবহ অন্ধকারের কোনও-কোনও কারিগরের মুখ আমরা দেখতে পাচ্ছি, আরও দেখতে পাবো। যত দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, তত মনে হচ্ছে, হুমায়ুন আজাদ ওই অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এমন এক সময়, যখন তিনি কার্যত নিঃসঙ্গ; বুদ্ধিজীবীরাও তাঁর পাশে দাঁড়ান নি; এই যুদ্ধকে এক অসম প্রতিরোধ ছাড়া কিছুই বলা যায় না। এই লড়াই তিনি করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। কোনও হুমকি, নিঃসঙ্গতা, প্রলোভন তাঁর এই সক্রিয়তায় ব্যাঘাত ঘটাতে বা তাঁকে বিচলিত করতে পারে নি।

আমরা জেনে এসেছি হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী লেখক। অবশ্যই তিনি তা-ই, এবং এটি ছিল সর্বব্যাপী অন্ধকারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিরোধ। ফলে অপরাজনীতি, ধর্ম, মৌলবাদ, কুসংস্কার, প্রথা, অধিকারহীনতাÑ সবই তাঁর ল্যবস্তু হয়েছে। এগুলোর পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় তিনি আক্রমণ করেছেন রাষ্ট্র, সরকার এবং এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। তথাকথিত সুশীল সমাজও বাদ পড়ে নি তাঁর আক্রমণ থেকে। শেষ বক্তৃতার একটা অংশে তিনি জানিয়েছেন যে, সুশীল সমাজের কাজ কেবল ইস্ত্রি-করা পোশাক-পরে বক্তৃতা ও বিবৃতি দেওয়া; এই ভদ্রলোকদের দিয়ে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে গেলে অশীল হতে হবে; যুগে-যুগে সমাজের পরিবর্তন ঘটিয়েছে অশীলরাই। সেই অর্থে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ‘অশীল’; কিন্তু তাঁর পে সমাজকে বদলানো সম্ভব হয় নি। একার লড়াইয়ে এবং চটজলদি তা সম্ভব নয়। তবে তিনি পথ দেখিয়েছেন লড়াইয়ের এবং বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন আমরা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে আছি এবং এটি ণস্থায়ী। ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭) অন্ধকার আর কুসংস্কারের কারাগার থেকে মুক্তির পথ দেখায় আমাদের, যদিও তিনি তাতে জানিয়ে দেন, প্রতিটি মানুষের পথ তার নিজস্ব।

তাঁরও ছিল নিজস্ব পথ এবং ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫) দিয়ে এই পরিক্রমার শুরু যা একেবারে তীক্ষè, পরিহাসময়, প্রকাশ্য হয়ে ওঠে ‘প্রবচনগুচ্ছ’ (১৯৯৩)-র মধ্য দিয়ে। বইটি ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে’ যাওয়ার ভবিষ্যতশঙ্কাটি খুব অল্পকালের মধ্যে সমকালীন সমাজে সত্য হয়ে পড়ার প্রতিক্রিয়াকে হাজির করে। একটি বা দু-তিনটি বাক্যে পতনোন্মুখ কিংবা পতিত সমাজের তীè এবং পরিহাসময় সমালোচনা আর কোনও লেখকের পে সম্ভব হয়েছে কি-না, আমার জানা নেই। সমাজ তখন পতনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে; অথবা দীর্ঘকালের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মানুষ প্রথাকে জীবনের অপরিহার্য ও প্রশ্নোর্ধ্ব উপাদানে পরিণত করেছে; এই অবস্থায় হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে নিন্দাধ্বনি উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর নামের আগে ‘বিতর্কিত’ শব্দটি অনিবার্য হয়ে গেল। মিথ্যা ও কপটতার সমাজে সত্য সব সময় বিতর্কিতÑ কথাটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বহুবার তিনি বলেছেন। সত্য এই এবং আজ ইতিহাসওÑ প্রতিরোধের প্রকাশ্য শুরু হুমায়ুন আজাদের তখন থেকেই। তবে এর বীজ তাঁর আধুনিক সংবেদনশীল চিত্তে, যা কবুল করে প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ধর্ম এদেশে প্রথা, অপরাজনীতি এখানকার সংস্কৃতি; দুটোর বিরুদ্ধেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন। এরপর মৌলবাদ তাঁর আক্রমণের বিষয় হয়েছে। শুরু থেকেই অপবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতায় আঘাত হেনেছেন তিনি। এ-আঘাত সহ্য করা কঠিন হয়ে ওঠে সমাজের প,ে কেননা, দীর্ঘদিনের লালন-করা বিশ্বাস ও অভ্যাসকে পশ্চাৎপদরা আঁকড়ে থাকতে চায় এবং সংখ্যায় এরা বিপুল ও গরিষ্ঠ। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্র এবং তার সংগঠনগুলো এদের পইে কাজ করে থাকে। আমাদের সমাজে রাষ্ট্র মানে রাজনৈতিক দল, যে মতার মালিক। এরা বিপুল ধর্মান্ধ মানুষের পে কাজ করে, এদের খুব দরকার ভোটের; কেননা, মতা ছাড়া তারা অসহায়। সেই নিরাপত্তাহীনতা থেকে তারা অপবিশ্বাসের পৃষ্ঠপোষকতা করে। হুমায়ুন আজাদ এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ফলে, খোদ সরকারই হয়ে উঠেছে তাঁর শত্র“।  

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের রাজনীতি ধর্মভিত্তিক; কিন্তু ধর্মেরই কোনও ভিত্তি নেই; ধর্ম চলে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে; এই আবেগ মানুষ পায় পরিবার থেকে। পৌরাণিক চরিত্র আর অলৌকিকে বিশ্বাস, ভীতি, প্রলোভন ইত্যাদি ধর্মীয় আবেগের মূলে। এই আবেগের পরিচর্যায় সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতি আর ধর্মভিত্তিক থাকবে না; ধর্মই হয়ে উঠবে রাজনীতিভিত্তিক। তার ইশারা এখনই দেখা যাচ্ছে। যা-ই হোক, হুমায়ুন আজাদ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেও আক্রমণ করেছেন। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) এর উজ্জ্বল উদাহরণ। কেবল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, মৌলবাদ, ধর্মব্যবসা, ধর্মের নামে লাম্পট্য ও নিষ্ঠুরতাÑ সবই উপন্যাসটির ল্যবস্তু হয়েছে।

অনেকেরই ধারণা, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ লেখার কারণেই ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে সাতাশে ফেব্র“আরি ওই হামলাটি চালিয়েছিল। সত্য হলো, ‘প্রবচনগুচ্ছ’, বিশেষত ‘নারী’ (১৯৯২) প্রকাশের পর থেকে তিনি সমাজের গরিষ্ঠ প্রথাগত অংশের শত্র“তে পরিণত হন। তাঁর একেকটি রচনার প্রতিক্রিয়ায় ধর্মব্যসায়ীদের আক্রোশ ও প্রতিহিংসা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। ‘নারী’ নিষিদ্ধ হয়, এতেও তাঁর প্রতি আক্রোশ কমে না; তারা মরিয়া হয়ে ওঠে তাঁকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে। হমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ধরন থেকে বোঝা যায়, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান কতোটা কঠিন ও তীব্র ছিল। হামলাকারীদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর (অধিকাংশের) মনোভাব এবং হামলার পরের আচরণ দেখে বোঝা যায়, হুমায়ুন আজাদ তাদের পে নিরাপদ ছিলেন না। আমাদের দেশে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই; তাদের প্রতিও ধর্মব্যবসায়ীদের আক্রোশ আছে; কিন্তু কেউ হুমায়ুন আজাদের মতো তীè ও আপসহীন নন। নইলে একই পরিণতি আরও অনেকের হতো। আমাদের প্রায় সব বুদ্ধিজীবী কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক দলের তল্পি বহন করেন। কেননা, তাঁরা খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, যেমন ভোগে রাজনৈতিক দল; মতায় থাকলে আরও বেশি ভোগে, বিপুল ধর্মান্ধ মানুষ যদি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়! ধর্মব্যবসায়ীরা এ-সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে আসছে বছরের পর বছর।

রাজনৈতিক দল আর নিরাপত্তাকামী বুদ্ধিজীবীদের বিপওে অবস্থান নিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ। নিতে গিয়ে নিজেই হারিয়েছেন নিরাপত্তা; শেষ পর্যন্ত বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। বিপন্ন হয়েও তিনি অন্ধকারের সঙ্গে আপস করেন নি। আবার তাঁর শেষ বক্তৃতার একটি অংশ : ‘বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা, তাতে একে একটি বর্বর রাষ্ট্র বলা যায়। এখানে কোনো রকম অধিকারকে স্বীকার করা হয় না, এখানে কারও অধিকারকে মান্য করা হয় না। শুধু সরকারিভাবে মতাপ্রাপ্ত কিছু মানুষ সেই অধিকার ভোগ করে থাকে। এখানে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অসহায়। ’ বলা বাহুল্য নয়, মৌলবাদের হাত-ধরাধরি করে পেছাতে-থাকা এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হুমায়ুন আজাদের অবস্থান ছিল যুক্তিমনস্ক, ব্যাখ্যামূলক ও সৃষ্টিশীল। একদিকে তিনি লিখেছেন কলাম, প্রবন্ধ ও গদ্য; অন্যদিকে কবিতা আর উপন্যাস; চিন্তা আর সৃষ্টি নিয়ে এর বিপে দাঁড়ানোর রসদ ছিল না তাঁর প্রতিপরে; না-থাকলে অবধারিত হয়ে পড়ে বলপ্রয়োগের পথ। ধর্ম আর পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র টিকে থাকে গায়ের জোরেই; কিন্তু বেশি দিনের জন্যে নয়। কেননা, মানুষ এবং তার সংস্কৃতি স্থবির নয়, এগিয়ে চলাই তার ধর্ম। তথাকথিত ধর্মগুলো স্থির; আর মৌলবাদ তার অপরিবর্তনীয়তাকে প্রাণপণ আঁকড়ে-থাকার অবলম্বন। জ্ঞানের সমাজে, মানুষের জগতে এর কোনও স্থান হতে পারে না। সেই সমাজ আর জগতের পে হুমায়ুন আজাদ এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম।                                      

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪১৫, আগস্ট ১১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।