ঢাকা: গভীর সমুদ্র অর্থাৎ মহীসোপানের মালিকানার জন্য জাতিসংঘ থেকে চূড়ান্ত রায় পেতে বাংলাদেশকে ২০১৪ সাল নয়, বরং ২০২০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়াল অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বুধবার সমুদ্রসীমার অধিকার আদায় বিষয়ে বাংলানিউজকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে একথা বলেন।
সমুদ্রতট থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং ৩৬০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেকার এলাকাই গভীর সমুদ্র বা মহীসোপান।
তবে মহীসোপানে বাংলাদেশের দাবির ব্যাপারে রায় পেতে সময় বেশি লাগলেও বেশি বেগ পেতে হবে না বলে মনে করেন তিনি। কারণ, মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্ধারণে যে রায় বাংলাদেশ পেয়েছে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে যে রায় আসবে তার ওপর ওপর ভিত্তি করেই জাতিসংঘ চূড়ান্ত রায় দেবে।
তিনি বলেন, গভীর সমুদ্র বা মহীসোপানের মালিকানা পেতে জাতিসংঘে এ পর্যন্ত ৬১টি দেশ আবেদন করেছে। বাংলাদেশ রয়েছে ৫৫ নম্বরে। এখন ৩৮নং সিরিয়ালের একটি দেশের শুনানি চলছে। তাই বাংলাদেশের এ রায় পেতে অনেক সময় লাগবে।
মিয়ানমার ইটলসে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে
খুরশেদ বলেন, অর্থনেতিক অঞ্চলের অধিকার পেতে ২০০৯ সালে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সালিশি আদালতে যায়। পরবর্তীকালে মিয়ানমার সমুদ্র আইনবিষয়ক আদালত- ইটলসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাংলাদেশ তাতে সম্মত হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘‘মিয়ানমার ইটলসে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের এই লাভ হয়েছে যে, ২৮ মাসের মধ্যে আমরা রায় পেয়ে গেছি। মোটামুটিভাবে মিয়ামারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা এখন নির্ধারিত। এ রায়ের ফলে সমুদ্রসীমার ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে আমরা আমাদের অধিকার অর্জন করেছি। যেখানে আমরা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে আমাদের চাহিদা সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম। ’’
তিনি বলেন, ‘‘অনেকে বলেছেন, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। তবে আমি বলতে চাই, এখানে শুভঙ্করের কোনো ফাঁকি নেই। কারণ, শুভঙ্কর ভদ্রলোক পাটিগণিত করতেন। আর এটি হলো জ্যামিতি। ’’
‘‘দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ভারতের সঙ্গেও পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন (স্থায়ী সালিশ আদালত) চালু রয়েছে। দুই কোর্টের রুলস অব প্রসিডিওর আলাদা। আলাদা হওয়ার কারণে এখানে সময় বেশি লাগবে। আমরা আমাদের মেমোরিয়াল কোর্টে সাবমিট করেছি। এর পর মেমোরিয়াল দেবে ভারত। তারপর এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত কাউন্টার মেমোরিয়াল দেবে। ’’
ভারতের সঙ্গে রায় ২০১৪ সালে
অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আশা করে, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই এ কোর্টের রায় আমরা পেয়ে যাবো। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশ রয়েছে, আর তিন দিকের সীমানা কিভাবে হবে, তাও ঠিক হয়ে যাবে। ’’
‘‘এ সীমানা নির্ধারণ করা হলে বাংলাদেশের যে লাভ হবে তা হলো- সমুদ্রগর্ভে যে জ্বালানি রয়েছে তা অর্জনে আমরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবো। মৎস্য আহরণে কি কি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। কারণ, দুশ’ মাইলের ওপরে মাছ ধরতে গেলে যে ধরনের বড় জাহাজের প্রয়োজন, তা এখনও বাংলাদেশের নেই। ’’
সর্বোপরি এর ফলে দু’টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে উত্তেজনা, সমস্যা ছিলো তারও নিরসন হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আগে যা কিছু ঘটেছে, তা পেছনে ফেলে দিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। ’’
তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এসব রায়ের পরে কন্টিনেন্টাল সেলফ (মহাদেশীয় সোপান) জোড়া লেগে যাবে এবং আমরা বদ্ধ হয়ে যাবো। কিন্তু আমি বলতে চাই, কন্টিনেন্টাল সেলফের পর কোনো অঞ্চল আর কোস্টাল কান্ট্রির কাছে থাকে না। সাড়ে তিনশ’ মাইলের পরে কোনো দেশেরই আইনগত অধিকার সাগরে নেই। সাড়ে তিনশ’ মাইলের পরে এলাকা ‘কমন হেরিটেজ অব ম্যান কাইন্ড’। এখানে যে কোনো দেশ এমনকি নেপাল-ভুটানের মতো দেশও সেখানে গিয়ে খনিজ সম্পদ আহরণ করতে পারবে। ’’
ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটি’র সদস্য হলো বাংলাদেশ
‘ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটি’র সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। গত মাসে এ কাউন্সিলের নির্বাচন হয়। বিশ্বের ১৬২াট সদস্য দেশ ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে।
এশিয়া থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, জাপান ও চীন নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ জানুয়রি পর্যন্ত মেয়াদ থাকবে।
খুরশেদ জানান, সাড়ে তিনশ’ মাইলের পর সমুদ্রের দেখাশোনা করে ‘ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটি’। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় জ্যামাইকার কিংসটনে। ইটলসের মত এটিও একটি সংস্থা যার ‘লিগ্যাল’ ও ‘কাউন্সিল” নামে দুটি বডি রয়েছে।
তিনি জানান, এ কাউন্সিলের কাজ হলো, গভীর সমুদ্র থেকে কেউ যদি কবালবেস্ট ক্রেস্ট, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, নিকেল, কোবাল্ট প্রভৃতি খনিজ তুলতে চান তা হলে ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটি থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী এ সমস্ত সম্পদ তুলে যে অর্থ আয় হবে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোও পাবে। এ বিষয়ে এবারই আইন তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৭টি বেসরকারি সংস্থাকে এ জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে জানে না, সমুদ্রে তার কি খনিজ রয়েছে
খুরশেদ বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় কি ধরনের খনিজ রয়েছে, তার সার্ভে এখনও হয়নি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো পরিকাঠামো নেই সার্ভে করার। শুধু জানলেই হবে না, এ জন্য বড় জাহাজসহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগবে।
তিনি বলেন, ‘‘সাগরে এক ধরনের গ্যাস বল থাকে। সেটি তুলে আনতে পারলেই আমরা গ্যাস পাবো। সেটি তুলতেও যন্ত্র দরকার। বলগুলো ভাঙলেই গ্যাস বের হয়। ’’
সমুদ্র বিষয়ে উচ্চশিক্ষা
খুরশেদ বলেন, ‘‘ভারতের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিষয়ে পড়ানো হয়। চলতি বছর থেকে বাংলাদেশে সমুদ্র বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শুরু হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওশেনোগ্রাফি (সমুদ্রবিদ্যা)নামে একটি ডিগ্রি কোর্স খোলা হয়েছে। সমুদ্রবিদ্যা সম্পর্কে কিছু বিদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জনকারী শিক্ষক সেখানে পাঠ দান করবেন। এখান থেকে যারা বের হবেন, সেই দক্ষ জনশক্তি দিয়েই আমরা সার্ভের কাজ করতে পারবো। ’’
তিনি জানান, সমুদ্র বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় চারটি ভাগ রয়েছে। সেগুলো হল জিওলোজিক্যাল, ফিজিক্যাল, বাওলোজিক্যাল এবং কেমিক্যাল ওশেনোগ্রাফি।
অবকাঠামো দাঁড় করার চেষ্টা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
তিনি জানান, সমুদ্রসীমানার অধিকার অর্জন শুধু নয়, এটিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অবকাঠামোরও দরকার রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে, একটি অবকাঠামো দাঁড় করানোর । নিরাপত্তার জন্য সরকার নৌ-বাহিনীকে আরো যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে। বাদবাকি পদক্ষেপ নেবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাও এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশের গ্যাস ব্লক ছিলোই একটি
খুরশেদ আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের গ্যাস ব্লক ছিলোই একটি। সেখানে আমরা কাজ করতে দিয়েছিলাম কনকো ফিলিপসকে। এটি ছিলো ১০ নম্বর ব্লকে। এর আগে বাংলাদেশ সাগরে ব্লক দিয়েছে। কিন্ত ব্লক দিলেইতো হবে না, তা আন্তর্জাতিক আইনে নিজের এলাকায় হতে হবে। না হলে তা টিকবে না। ’’
তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশ এ বিষয়ে গেজেট করে ফেলেছে। নতুন আইন করার ফলে সরকার নতুন করে ব্লক তৈরি করছে। মিয়ানমার এ অঞ্চলে ১৭টি ব্লক দাবি করেছিলো। এখন রায়ের ফলে আমরা হারাবো ৫টি ব্লক। কিন্তু মিয়ানমার তাদের অঞ্চলের ৫০ শতাংশ ব্লকই হারাবে। ’’
বাংলাদেশ সময়: ২০২৬ ঘন্টা, আগস্ট ০৮, ২০১২
কেজেড/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর/এমএমকে; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]