ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

‘সে গরীব, তাই তদবির করতে পারেনি’

ইলিয়াস সরকার, স্টাফ কসেপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১২
‘সে গরীব, তাই তদবির করতে পারেনি’

ঢাকা: ``ছোট বেলায় তার মা মৃত্যুবরণ করে। সে রাস্তার পাশে কেরোসিন দোকানে কাজ করতো।

তার পিতা শামসুল হক অত্যন্ত গরীব লোক। সে (তার বাবা) পুনরায় বিয়ে করে। জাকির তাই অবহেলার মধ্যে বড় হয়। তারপর জাকির ঢাকায় বয়-বেয়ারার কাজ করতো। সে অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। সে খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল না। গ্রেফতার হওয়ার পর সে গরীব বিধায় কোনো তদবির করতে পারেনি। তদবীর করার সংগতি বা লোকও ছিল না তার। তাই জেলে দিনাতিপাত করছে। ”

শুধু নামের মিল থাকায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জনৈক সামসুল হকের ছেলে মো. জাকিরের জেলখাটা নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করেন জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে সোমবার প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।

এ সময় কাশিমপুর কারাগার থেকে নিয়ে আসা জাকিরও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবার এ বিষয়ে আদেশ দেবেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের বেঞ্চ।

প্রসঙ্গত, ২১ জুন এক জাতীয় দৈনিকে “একজনের যাবজ্জীবন খাটছেন অন্যজন!” শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনলে জাকিরকে জেলে আটক রাখা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত । একইসঙ্গে জাকির হোসেনের আটকের বৈধতা যাচাই করতে তাকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করতে বলেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শুধু নামের মিল থাকায় নির্দোষ হয়েও কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের জনৈক জাকির হোসেন। ’  

এরপর তাকে কয়েক দফা আদালতে হাজির করা হয় এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসিকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয়। ডিসি চলতি মাসের আট তারিখে তদন্ত শেষে প্রতিবেদনটি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে জমা দেন।

ডিসির তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার থানায় প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের ১১ নভেম্বর জেলার আড়াইহাজার থানার ভুলতা সড়কের কাতরা ব্রিজের কাছে জনৈক ভিকচান মিয়া খুন হন। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে সোলেমান বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় একটি মামলা করেন। ওই থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএ রাজ্জাক এবং এসআই মো. খোরশেদ আলম মামলাটির তদন্ত করেন। তদন্ত কর্মকর্তা পরের বছর ১০ মে একই থানার বেপারীপাড়ার সামসুদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেনকে অন্যতম আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। মামলায় নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ মো. ফজলুর রহমানের আদালত জাকিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।

জেলার আদালত পরিদর্শক এর দপ্তরে রাখা  রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চার্জশিটের আসামির নাম জাকির। পিতা-সামসুদ্দিন, সাং-সত্যবান্দী বেপারীপাড়া, থানা আড়াইহাজার। কিন্তু আড়াইহাজার থানার রক্ষিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানার রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৩ সালে যার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় তার নাম জাকির, পিতা- শামসুদ্দিন, সাং-সত্যবান্দী মোল্লাপাড়া, থানা-আড়াই হাজার।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, চার্জশিট ও জিআর রেজিস্ট্রারে আসামির ঠিকানা ছিল সত্যবান্দী বেপারীপাড়া। কিন্তু থানায় রাখা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রেজিস্ট্রারে ঠিকানা হিসেবে সত্যবান্দী মোল্লাপাড়া লেখা হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এই ‘মোল্লাপাড়া’ লেখা হল তা বোধগম্য নয় বলেও মন্তব্য করা হয়েছে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে।

আবার ২০০৪ ও ২০০৫ সালের গ্রেপ্তারি পরেয়ানা রেজিস্ট্রারে আসামির নামের সঙ্গে ‘হোসেন’ শব্দটি যুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালের রেজ্রিস্টারে আসামির নামের আগে ‘মো.’ শব্দ যুক্ত করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদন আরও বলা হয়, আড়াইহাজার থানার তৎকালীন এসআই মো. সহিদুল ইসলাম গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় সাং-‘সত্যনন্দী মোল্লাপাড়া’ উল্লেখ করে সামসুল হকের ছেলে মো. জাকিরকে গেপ্তারের পর কারাগারে পাঠান।
 
তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়, চার্জশিট, জিআর রেজিস্ট্রার, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রেজিস্ট্রারে আসামি জাকিরের পিতার নাম সামসুদ্দিন থাকার পরেও কেন হাটখোলা এলাকার বেপারীপাড়ার সামসুল হকের ছেলে আলোচ্য জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হল? তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনায় ওই গ্রেপ্তার ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সাম্প্রতিক দেওয়া তথ্যে তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, আড়াইহাজারের বেপারীপাড়া এলাকায় সামুসদ্দিনের ছেলে জাকির নামে কোন ভোটার নেই।

তদন্তকালে এবং সরেজমিন পরিদর্শনে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়।

তারা জানান, আড়াইহাজারের হাটখোলা বেপারীপাড়ার সামসুল হকের ছেলে জাকির সম্পূর্ণ নির্দোষ। ছোট বেলায় তার মা মৃত্যুবরণ করে। সে রাস্তার পাশে কেরোসিন দোকানে কাজ করতো। তার পিতা শামসুল হক অত্যন্ত গরীব লোক। সে (তার বাবা) পুনরায় বিয়ে করেন। জাকির তাই অবহেলার মধ্যে বড় হয়। তারপর জাকির বয়-বেয়ারার কাজ করতো। সে অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। সে খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল না। গ্রেফতার হওয়ার পর সে গরীব বিধায় কোনো তদবির করতে পারেনি। তদবির করার সংগতি বা লোকও ছিলনা তার। তাই জেলে দিনাতিপাত করছে। ’

প্রতিবেদনের সার্বিক মন্তব্যে বলা হয়, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া গেছে। চার্জশিট দাখিলকারী পুলিশ পরিদর্শক এম এ রাজ্জাকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এবং জাকিরকে গ্রেপ্তার করা এসআই শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া প্রকৃত খুনি নির্ধারণে পুলিশ বিভাগ কর্তৃক অধিকতর তদন্ত করানো যেতে পারে।

এর আগে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার সাংবাদিকদরে জানান, কাশিমপুর কারাগার-১ এর  সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবিরের রিপোর্টে বলা হয়-নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার সত্যবন্দি মোল্লাপাড়া এলাকার শামসুদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেনকে ১৯৯৬ সালের ৩০ নভেম্বর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ আদেশ অনুযায়ী ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ জেল হাজতে আনা হয়। এরপর নথিপত্রসহ ২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি জাকিরকে কাশিমপুর-১ কারাগারে নেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে জাকিরের বিষয়ে কোন অভিযোগ আসেনি। ’   

বাংলাদেশ সময়:  ২১০১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১২
এমইএস/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।