প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ডুবে আছে ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানের এসব অনিয়ম তুলে আনতে সরেজমিন অনুসন্ধানে যায় বাংলানিউজ।
আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকেই বেতন ভাতা ও বাড়ি ভাড়া পেয়ে থাকেন। কবি নজুরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. গিয়াসউদ্দীনও বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে বিধি অনুযায়ী সমস্ত বেতন ভাতা ও বাড়িভাড়া উত্তোলন করেন। এরপরও তার ঢাকার নিজস্ব বাসভবনের বিদ্যুত বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, টেলিফোন বিল ও আয়ার বেতন বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে পরিশোধ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত বাসার সকল বিলও বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়। ভিসি ড. গিয়াসউদ্দিন নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত ড্রাইভার ঢাকায় তার স্ত্রীর সার্বক্ষণিক গাড়িচালক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় স্টোর থেকে প্রতি সপ্তাহে তার ঢাকার বাসায় ব্যবহারের জন্য এয়ার ফ্রেশনার, সাবান, তোয়ালে, টিস্যু পেপার, কলম, পেনসিল ও সবধরণের ক্রোকারিজ নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যম্পাসের বাসায় এসি থাকা সত্ত্বেও তার ঢাকার ব্যক্তিগত বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় প্রত্যেক রুমে এসি, টিভি, ফ্রিজ ও কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। আর্থিক বিধি অনুযায়ী যা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এছাড়াও তার ঢাকার বাসার সমস্ত আপ্যায়ন ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়। এছাড়া ভিসি তার বেতনের সাথে দীর্ঘ দুই বছর ধরে প্রতি মাসে ১০০০/- টাকা আপ্যায়ন ভাতা গ্রহণ করেছেন।
অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদটি অনারারি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক লাভজনক পদে যেমন দুইটি অনুষদের ডিন, পরিবহন প্রশাসক, স্বাস্থ্য কমিটির প্রধান ইত্যাকার পদে থেকে অবৈধভাবে দায়িত্বভাতা তুলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক আবুল বাসার।
ট্রেজারারের নামে ক্যাম্পাসে একটি বাসা বরাদ্দ রয়েছে এবং সেই বাসার বিদ্যুত বিল, গ্যাস বিল, বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে পরিশোধ করার পরও ট্রেজারার তার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনে (তার সাবেক কর্মস্থল, সেখান থেকে ১ বছর ১ মাস আগে অবসর নিয়ে চলে এলেও সেখানকার বাসায় এখনও থাকছেন) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় টিভি, ফ্রিজ, এসি কিনে লাগিয়েছেন। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসার বিদ্যুত বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, টেলিফোন বিল বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে পরিশোধ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, অডিট আপত্তির কারণে পূর্ববর্তী ট্রেজারার তার বাসার টেলিফোন বিল বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে জমা দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় অর্গানোগ্রাম মোতাবেক তিনি পিক অ্যান্ড ড্রপ গাড়ি পাবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিলাসবহুল গাড়ি তিনি সার্বক্ষণিক নিয়ে রেখেছেন এবং তা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা হয়।
পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি খরচও বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল হতে পরিশোধ করা হয়।
নিচের পদে কোনো দায়িত্বভাতা নেওয়ার বা দেওয়ার বিধান না থাকলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অহরহ ঘটছে। ডেপুটি রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীর পিএসটু ভিসি’র (তার নিচের পদ) দায়িত্বে থেকে দায়িত্বভাতা তুলেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আব্দুল হালিমও পিএসটু ভিসির (তার নিচের পদ) দায়িত্বে থেকে দায়িত্বভাতা তুলেছেন।
এছাড়া রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলামকে আদালতের নিদের্শে পূর্ণ বেতন দেওয়ার পরও তাকে দায়িত্ব না দিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীরকে রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব দিয়ে তাকে দায়িত্বভাতা দেয়া হচ্ছে। সহকারী রেজিস্ট্রার আনিছুর রহমান তার নিচের পদে স্টোর অফিসারের দায়িত্বে থেকে ০৩ বছরের অধিককাল ধরে দায়িত্বভাতা তুলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-এ পরিস্কার উল্লেখ আছে “ভাইস-চ্যান্সেলরের সুপারিশক্রমে শিক্ষা প্রশাসন ও হিসাব কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ন্যূনতম সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকগণের মধ্য থেকে সিন্ডিকেট কর্তৃক দুই বৎসরের জন্য পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) নিযুক্ত হইবেন। ” কিন্তু ভিসি তার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি আড়াল রাখার জন্যই অদ্যাবধি এই পদে কাউকে নিয়োগ দেননি।
উপরন্তু উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম পরিচালকের দায়িত্ব না পেয়েও পরিচালকের মর্যাদায় বিভিন্ন সভা যেমন এফসি মিটিং, নিয়োগ বোর্ডে সদস্য হিসেবে (সাচিবিক দায়িত্ব পালনের জন্য সচিব হিসেবে নয়) উপস্থিত থেকে টিএ/ডিএসহ সভার সম্মানী বাবদ ভাতা উত্তোলন করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হুমায়ুন কবীর সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “এ ধরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ”
তিনি বলেন, “অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আমার এক কথায় জবাব-- এসব হয়নি। সরকার ও ইউজিসি কর্তৃক নির্দেশিত সবকিছু অনুসরণ করেই সব কিছু হয়েছে। ”
ট্রেজারার আবুল বাসার বলেন, “ভিসি স্যার বা আমি আমাদের নিয়মের মধ্যেই চলি। ইচ্ছা করলে আমরা আরো সুবিধা নিতে পারি, আইনে সে সুবিধা দেওয়াও আছে। কিন্তু আমরা তা করি না। ”
তিনি বলেন, “ভিসির কোনো বাসভবন নেই। ভিসি কোথায় থাকবেন, কত টাকা ভাড়া দিয়ে থাকবেন সেটা নিয়মে রয়েছে। স্যার নিয়মের ব্যত্যয় কিছু ঘটাননি। ”
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলাম বলেন, “হাইকোর্টে আমার স্টে অর্ডারের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দু’বার আপিল করে। কিন্তু আমার পক্ষের রায়ই বহাল রয়েছে। ”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “দু’তিনবার দরখাস্ত করার পরেও কর্তৃপক্ষ আমাকে ফুল বেতন দেয়নি। ২০১২ সালের ৫ মার্চ অফিসকে উকিল নোটিশ পাঠাই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার বেতন ভাতা বুঝিয়ে দেয়। আমার মোবাইল ভাতা ৮’শ টাকা ডেপুটি রেজিস্ট্রার নেয়। ”
তিনি বলেন, “আমার দায়িত্ব ও কাজ বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না। আমি টানা ৬ মাস রিক্রিয়েশন ভাতা পাচ্ছি না। ”
তিনি বলেন, “আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেয়ায় এখন যা ঘটছে তার দায়ভার আমার ওপর বর্তায় না। এসব নিয়োগে কী হয়েছে তা আমার জানা নেই। ”
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির পেছনে কোটি টাকার ভর্তি-বাণিজ্য
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্টে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও খোদ শিক্ষকরাই এ নিয়ম মানছেন না। ছাত্র রাজনীতি শুরুর আগেই তারা জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। নিজেরাই শিক্ষক সমিতির ব্যানারে শুরু করেন রাজনীতি। এ শিক্ষক সমিতি বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের। আর এর মূল উদ্দেশ্য রাজনীতির আড়ালে ভর্তিবাণিজ্য। গত বছরও শিক্ষক-ছাত্র সিন্ডিকেট ভর্তি-বাণিজ্যের মাধ্যমে লুটে নিয়েছে ৭০ লাখ টাকা। এ বছর তারা কোটি টাকার টার্গেট ঠিক করেছে বলে জানা গেছে।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সর্বপ্রথম নেতৃত্বে আসেন সুব্রত কুমার দে ও ড. ইমদাদুল হুদা। এক বছর পর এ কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নেতৃত্বে আসেন অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান ড. হাবিবুর রহমান ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রধান এএইচএম কামাল। প্রথম কমিটির সভাপতি সুব্রত কুমার দে’র বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের একটি পক্ষকে শেল্টার দেওয়ার গুঞ্জন থাকলেও ড. ইমদাদুল হুদার বিরুদ্ধে এ ধরণের কোনো অভিযোগ নেই।
অনেকের ধারণা, মনে মনে বিএনপিপন্থি হলেও ড. হুদা এখনো নিজের তরিকা ঠিক করতে না পারায় এক প্রকার বিপদেই আছেন।
ছাত্রলীগের ভেঙে দেয়া প্রথম কমিটির সভাপতি ইব্রাহিম খলিল শান্ত ও সাধারণ সম্পাদক আলামিন বাঁধনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ও প্রক্টর ড. হাবিবুর রহমান। ইব্রাহিম খলিল শান্ত প্রক্টর হাবিবুর রহমানের ছাত্র হওয়ায় তিনি বাড়তি সুবিধা পান। হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে ইব্রাহিম খলিল শান্তের সাথে যোগাযোগ না রাখলেও মুঠোফোনে, ত্রিশাল সদরে কিংবা ময়মনসিংহ শহরে গোপন সমঝোতা বৈঠক চালাতেন বলেও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ওই কমিটির বিরোধীরা প্রচার করতো।
তবে পরিস্থিতি এখন আর সেই কেবল রাজনীতির ঘোরে নেই। ভিসির মদদপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি নাট্যকলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রুহুল আমিন বর্তমানে এ রাজনীতিকে নিয়ে গেছেন অর্থনৈতিক অনিয়মের দিকে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি জাকিবুল হাসান রনি’র সাথে রুহুল আমিনের নিবিড় সখ্য রয়েছে। এ সখ্য কাজে লাগিয়ে রুহুল আমিন গড়ে তোলেন ভর্তি-বাণিজ্যের এক সিন্ডিকেট। এতে আরো আছেন সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক জাহিদুল কবির ও ছাত্রলীগের শিবলি, রিমন ও ছাত্রদলের শাহাবুল।
তবে ছাত্রদল নেতা শাহাবুল নিজের সম্পৃত্ততার কথা অস্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেছেন, আমি বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায় ক্যাম্পাসেই যেতে পারিনা। এটি আমার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।
এই সিন্ডিকেট ২০১১ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রাকটিক্যাল খাতা জালিয়াতিসহ নানা কায়দায় ৭০ লাখ টাকার ‘বাণিজ্য’ করে। এ বছর তাদের টার্গেট এক কোটি টাকা।
ভিসির প্রশ্রয়ে থেকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দেখভাল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক রেজোয়ান আহমেদ শুভ্র (ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন)। ভিসির সঙ্গে যোগসূত্রের কারণে প্রশাসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তার আধিপত্য বেশি।
এ ব্যাপারে ভিসি ড. গিয়াসউদ্দিনের বক্তব্য জানতে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার নাগাল পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, ১৪ আগস্ট, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]