পাটগ্রাম (লালমনিরহাট) থেকে: “হামরা পাথর খাই না, কিন্তুক পাথরই হামাক খাওয়ায়। ’ এভাবেই জীবনের সঙ্গে পাথরের সম্পৃক্ততা বর্ণনা করলেন দহগ্রামের বুড়িমারী সীমান্তবর্তী এলাকার পাথর শ্রমিক আফসার আলী।
অন্য কোন প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করেন- ‘এত থ্যাকার (এখানকার) বেশি মানুষই কামাই করে পাথর থাকিই। তালে কন গো নানা, পাথর হামাক খাওয়ায় কি না?’
সরেজমিনে পাটগ্রাম ঘুরে আফসার আলীর এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। উপজেলার বুড়িমারী, ইসলামপুর, শ্রীরামপুর, কুচলিবাড়ি, কদমা, ঝালঙ্গি, রহিমপুরসহ সবক’টি গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকার প্রধান উৎস পাথর।
পাথর উত্তোলনের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নেওয়া হয় । উত্তোলিত পাথর চালুনির মাধ্যমে ছাঁকা এবং পরিষ্কার করা হয়। এসব পাথর আবার বিক্রির জন্য বিভিন্ন শ্রেণিতে আলাদা করে রাখা হয়। পাইকাররা এখান থেকেই পাথর সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকেন।
তবে অনেক কৃষকেরই পাথর উত্তোলনের সামর্থ্য না থাকায় জমি লিজ দিয়ে নিজের জমিতেই শ্রমিকের কাজ করেন। পাথর ভাঙা, স্থানান্তর, পরিষ্কার করাসহ শ্রমিকরা এখানে বিভিন্ন স্তরে কাজ করেন। এসব শ্রমিক আবার এখানকার দালালদের হাতে জিম্মি। দালালদের দেওয়া তালিকা ছাড়া শ্রমিকদের কাজে নেননা পাথর ব্যবসায়ীরা।
শ্রমিকরা জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাদের টানা কাজ করতে হয়। সারাবেলা কাজ করে পারিশ্রমিক জোটে মাত্র ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
পাথর ভাঙা শ্রমিক কাওছার জানান, এক ফুট সাইজের একটি বাক্স দিয়ে ভাঙা পাথর পরিমাপ করা হয়। এক বাক্স পাথর ভাঙলে পাওয়া যায় ৬ টাকা। সারা দিন পাথর ভেঙে তার আয় হয় ৬০ টাকা। এ দিয়েই তাকে সংসার চালাতে হয়।
আরেক পাথর ভাঙা শ্রমিক রমিজা বলেন, “সারাদিন খাটনি করি যে পয়সা পাই তাত সংসার চলে না। তাই স্কুলের পর ছাওয়ালটাকো বসি দেই। ওদের বাপও পাথর ধোয়ার কাম করে। ”
ব্যবসায়ীরা পাথর উত্তোলনে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে সম্প্রতি ‘বোমা মেশিন’ নামে একপ্রকার ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করছেন। এটি দিয়ে মাটির ৬০ থেকে ৭০ মিটার গভীর থেকে পাথর তোলা যায়। এর ফলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এ এলাকার মাটির নিচের স্তর।
কৃষকদের অভিযোগ, বোমা মেশিনে পাথর তুললে পরবর্তী সাত-আট বছর জমিতে চাষাবাদ করা যায় না। তবে বেশী লাভের আশায় জমির তোয়াক্কা করে না ব্যবসায়ীরা। এমনকি মানে না সরকারি বিধি নিষেধও। কৃষি জমি ছাড়াও এ অঞ্চলের ধরলা, সানিয়াজান, সিংগীমারী নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলো প্রায় গতিহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া উত্তোলিত পাথরের সিএফটি প্রতি দুই টাকা রয়্যালিটি দেয়ার কথা থাকলেও সেটিও দেন না ব্যবসায়ীরা। অথচ মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় জমি লিজ নিয়ে সারা বছর কয়েক লক্ষ টাকার পাথর উত্তোলন করে তারা।
এ ব্যাপারে পাথর ব্যবসায়ী আলী হোসেন জানান তার তিনটি ড্রেজার মেশিন আছে। প্রতিটি মেশিন তিন থেকে চার লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা। এসব মেশিন আনতে প্রশাসনের অনুমতি লাগেনি। লাভের আশায় অনেকেই এখন বোমা মেশিন নিয়ে আসছে।
এ ব্যবসায় লাভ খুব সীমিত বলেই দাবি করে তিনি বলেন, “এ ব্যবসায় লাভ যেমন আছে তেমনি লোকসানও আছে। জমি লিজ নিয়ে তাতে পাথর পাওয়া না গেলে সপ্তাহে লাখ টাকাও লোকসান হয়। ”
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন বলেন, “ভবিষ্যতে পাটগ্রাম চরে পরিণত হবে। কারণ, জমি থেকে পাথর উত্তোলন করার সময় প্রচুর বালু উঠে আসে। এ বালু জমির বা নদীর পাশেই স্তুপ করে রাখা হয়। এভাবে জমিগুলো সব চরে পরিণত হচ্ছে। তবে এতে টনক নড়ছে না প্রসাশনের। ”
এ বিষয়ে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, “বোমা মেশিন নামে যে ড্রেজারমেশিন পাথর ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে তা কৃষি সামগ্রীই বলা যায়। স্যালো মেশিন বা চাষের কাজে ব্যবহৃত মেশিনগুলো আপগ্রেড করে তারা পাথর উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করে। এ কারণে এগুলোর আমদানি নিষিদ্ধ করা যায় না। তবে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কিছু মেশিন আটক করা হয়। অবৈধ উপায়ে উত্তোলিত পাথরের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত চেয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা চিঠি দিয়েছি। তাদের একটি দল এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। আশা করছি শিগাগিরই আমরা নির্দেশনা পাব।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১২
সম্পাদনা : শাহেদ হোসেন, নিউজরুম এডিটর/ জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর