ঢাকা: ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর থেকে জাতীয় সংসদে প্রায় ১০ হাজার মুলতবি প্রস্তাব জমা পড়লেও আলোচনা হয়েছে মাত্র চারটির ওপর। আর এই চারটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে ৫ম জাতীয় সংসদে।
সংসদীয় রাজনীতি বিশ্লেষক ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানরা মনে করছেন সরকারের ‘অহেতুক ভীতি’র কারণেই মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হয় না। তারা বলছেন, সংসদ কার্যকর করতে সরকার ও বিরোধী দলের মতের মিল না হওয়ায় মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। সরকারের অসহিষ্ণু মনোভাবও মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ না হওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে, বর্তমান স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট মনে করেন, ৫ম সংসদে সরকারি ও বিরোধীদলগুলোর মধ্যে সংসদকেন্দ্রিক সমঝোতা ছিল বলেই মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। ৫ম সংসদের পর থেকে এই সমঝোতা কমে এসেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষায়, মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণকে বিশেষ ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতার দায়ে তিরষ্কার মনে করা হয়। মুলতবি প্রস্তাব গৃহীত হলে কোনো একটি বিশেষ দিনে নির্ধারিত সব কার্যক্রম বাদ দিয়ে প্রস্তাবিত বিষয়ের ওপর ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা আলোচনা করেন।
কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনের একক ক্ষমতা স্পিকারের। তবে ‘ক্ষমতাসীন দলের অসম্মতির’ কারণে বিগত চারটি সংসদের কোনো স্পিকারই এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি। অন্যদিকে প্রস্তাবকারী সদস্যরাও অনেকসময় বিধি অনুযায়ী নোটিশ দিতে পারেননি। সেকারণেও অনেক প্রস্তাব বাতিল হয়।
জাতীয় সংসদে কার্যপ্রণালি বিধির ৬২ বিধিতে মুলতবি প্রস্তাবের বিষয়ে বলা রয়েছে। জরুরি ও জনগুরুত্বপুর্ণ বিবেচনায় সংসদের যেকোন সদস্য দিনের অন্য কাজ মুলতবি রেখে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব রাখতে পারেন।
সংসদ সচিবালয়ের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, চলতি নবম জাতীয় সংসদের সর্বশেষ ১৪তম অধিবেশন পর্যন্ত ৭৭৯টি মুলতবি প্রস্তাব জমা পড়েছে। এসব মুলতবি প্রস্তাবের মধ্যে ৬৮৩টি প্রস্তাব বাতিল হয়। আর তামাদি হয় ৯৬টি প্রস্তাব। অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে চলতি সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিল।
এসব মুলতবি প্রস্তাবের বিষয় ছিল- সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, বিডিআর বিদ্রোহ, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসসহ অন্যান্য প্রসঙ্গ।
স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বাংলানিউজকে বলেন, “বিরোধী দল মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণের দাবি জানালেও সংসদে অনুপস্থিত থাকেন, তারা সংসদে আসেন না। উপস্থিত থেকে দাবি জানালে প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। ”
বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট নেতৃত্বাধীন ৮ম জাতীয় সংসদের ২৩টি অধিবেশনে ২ হাজার ৫৩০টি মুলতবি প্রস্তাব জমা পড়ে। এ সংসদে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। বাতিল হয় ২ হাজার ৩৬৩টি প্রস্তাব, তামাদি হয় ৪৩টি প্রস্তাব। আর প্রত্যাহার করা হয় ৮টি প্রস্তাব।
৮ম জাতীয় সংসদে জমা পড়া মুলতবি প্রস্তাবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো ছিল- তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগ, বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে সংসদে আলোচনার প্রতিবাদ, আদমজী পাটকল বন্ধ, গ্যাস রফতানি, একুশে টিভি বন্ধ, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় শেখ হাসিনা গাড়ি বহরে হামলা, সেনা হেফাজতে মৃত্যু, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলা, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলা, সিনেমা হলে বোমা হামলা, ক্রসফায়ার, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে গ্রেনেড হামলা করে হত্যা, ১৭ আগস্ট সারাদেশে বোমা হামলা, আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলায় বিচারক হত্যা, কানসাটে পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষ হত্যাসহ অন্যান্য প্রসঙ্গে।
সংসদের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, অষ্টম সংসদে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ না হওয়ায় ১৩তম অধিবেশনে দুই দিন দুইবার ওয়াক আউট করে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। তৎকালীন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বিষয়টি বিচারাধীন বিবেচনায় ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।
সংসদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেনেড হামলা বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ না করতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপির পক্ষ থেকে স্পিকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলানিউজকে বলেন, “মুলতবি প্রস্তাব হচ্ছে সেনশিরশিপ টু দ্য গভর্মেন্ট। এটি বিরোধী দলের একটি ধারালো অস্ত্র। কারণ জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সংসদের সকল কাজ বন্ধ রেখে আলোচনা করতেই এ প্রস্তাব করা হয়। ”
তিনি বলেন, “এটা নিয়ে প্রত্যেকটি সরকারের অহেতুক ভীতি কাজ করে। যার ফলে অনেক সময় স্পিকারও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। ”
৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে মাত্র ৩টি মুলতবি প্রস্তাব জমা পড়ে। যার মধ্যে ২টি প্রস্তাব বাতিল হয়। একটি নোটিশ ৬৮ বিধিতে গ্রহণ করা হয়। প্রসঙ্গত, এ সংসদ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৭ম জাতীয় সংসদে চার হাজার ৮৮৪টি মুলতবি প্রস্তাব পাওয়া যায়। এ সংসদে দুই হাজার ৩৯৬টি মুলতবি প্রস্তাব বাতিল হয়। তামাদি হয় দুই হাজার ৪৬টি প্রস্তাব। প্রস্তাবকারী সংসদ সদস্য কর্তৃক ৩টি প্রস্তাব প্রত্যাহার হয়। এই সংসদের ১৬তম, ১৭তম, ১৯তম, ২১তম ও ২২তম অধিবেশনে কোনো প্রস্তাব পাওয়া যায়নি।
৫ম সংসদ জাতীয় সংসদে মুলতবি প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। এ সংসদের ২২টি অধিবেশনে মোট এক হাজার ৮০৩টি প্রস্তাব জমা পড়ে। এ সংসদের ১৭তম থেকে ২২তম অধিবেশন পর্যন্ত কোনো নোটিশ পাওয়া যায়নি। এক হাজার ৭৩৫টি প্রস্তাব বাতিল হয়।
আলোচিত চার মুলতবি প্রস্তাব
৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পর থেকে একমাত্র ৫ম জাতীয় সংসদে ৪টি মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সংসদে আলোচিত হওয়া মুলতবি প্রস্তাবগুলো হলো- ৯১ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম অধিবেশনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৬) উত্থাপিত ‘মেহেরপুর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে বিডিআর জওয়ানসহ ৪ বাংলাদেশি নিহত হওয়া সম্পর্কে’; ২৮ অক্টোবর তৃতীয় অধিবেশনে রাশেদ খান মেনন (বাখরগঞ্জ-২) উত্থাপিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইদল ছাত্রের বন্দুকযুদ্ধে উদ্ভুত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে’; চতুর্থ অধিবেশনে ৯২ সালের ৮ ও ১২ জানুয়ারি মো. শামসুল হক (ময়মনসিংহ-২) উত্থাপিত ‘পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান নির্বাচন প্রসঙ্গে’; এবং একাদশ অধিবেশনে ৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রফিকুল ইসলামের (যশোর-২) ‘গভীর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র হামলায় একজন নিহত ও দু’শতাধিক আহত হওয়া’ প্রসঙ্গে।
সংসদের কার্যবিবরণীতে দেখা গেছে এই চারটি মুলতবি প্রস্তাবের ওপর তৎকালীন স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী দুই ঘণ্টা আলোচনার সুযোগ দেন। সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর সদস্যরা এসব প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন।
৫ম সংসদে মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ প্রসঙ্গে বর্তমান স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বলেন, “স্বৈরাচারী শাসন হটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রবর্তন হওয়ায় সরকারি ও বিরোধীদগুলোর মধ্যে সংসদ কেন্দ্রিক সমঝোতা ছিল। ৫ম সংসদের পর থেকে এই সমঝোতা কমে গেছে। ”
বিভিন্ন বিধিতে আলোচনা করা মুলতবি প্রস্তাব
৫ম জাতীয় সংসদে ৬৩টি এবং ৭ম সংসদে ৫টি মুলতবি প্রস্তাব অন্য বিধিতে আলোচনা ও সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
৫ম সংসদের ৫ম অধিবেশনে একই বিষয়ে ১৪টি প্রস্তাব জমা পড়ায় তা নিয়ে সাধারণ আলোচনা হয়। ৮ম অধিবেশনে তিনটি প্রস্তাব ৬৮ বিধিতে এবং একটি ৭১ বিধিতে জনগুরুত্ব বিবেচনায় আলোচনা হয়। ৯ম অধিবেশনে তিনটি প্রস্তাব ধর্ম মন্ত্রণালয় ও একটি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। একই বিষয়ে ১৮টি প্রস্তাব ৬৮ বিধিতে গ্রহণ ও আলোচনা হয়। ১০ অধিবেশনে একটি ৭১ বিধিতে ও দুটি ৬৮টি বিধিতে গ্রহণ করা হয়। অপর একটি নোটিশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। ১১তম অধিবেশনে একটি ৬২ বিধিতে ও একটি ৭১ বিধিতে গৃহীত হয়।
১২তম অধিবেশনে ৭টি নোটিশ সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়। ১৩তম অধিবেশনে ১০টি নোটিশ সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয় এবং একটি নোটিশের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এছাড়া ৭ম সংসদের ৫টি মুলতবি প্রস্তাব ৬৮ বিধিতে সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হয়।
অন্য বিধিতে আলোচনার বিষয়ে সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নিজাম উদ্দীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, “ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অন্য বিধিতে আলোচনার বিধান নেই। ভারতীয় পার্লামেন্টে মুলতবি প্রস্তাব অন্য বিধিতে আলোচনার বিধান রাখা হয়। সেখান থেকেই আমরা এটা নিয়েছি। তবে আমাদের এখানে চর্চাটা এখনও গড়ে ওঠেনি। ”
তিনি বলেন, “সব সময়ই সরকারি দল মনে করে মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ করলে সরকার ছোট হয়ে যাবে। তারা এ ব্যাপারে অহেতুক ভয় পায়। মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করলে প্রকারান্তরে সংসদই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ”
তিনি আরো বলেন, “বিরোধী দল প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশ ও গণমাধ্যমে যেসব বিষয় নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করে এগুলো সংসদে এসে বললে সংসদীয় রাজনীতি কার্যকর হয়। আর সরকারি দলকেই বুঝতে হবে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে সংসদ কার্যকর হয়। ”
সংসদ সচিবালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি ৯ম জাতীয় সংসদে এখন পর্যন্ত ১৪টি অধিবেশনে ৭৭৯টি মুলতবি প্রস্তাব জমা পড়েছে। সবচেয়ে বেশি জমা পড়েছে ৮ম অধিবেশনে আর সবচে কম জমা পড়েছে ২য় অধিবেশনে। এসব মুলতবি প্রস্তাবের মধ্যে ৬৮৩টি প্রস্তাব বাতিল হয়। আর তামাদি হয় ৯৬টি প্রস্তাব। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিল। ”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, “বিভিন্ন সময়ে সরকারি দলগুলোর অসহিষ্ণু আচরণের জন্যই মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় না। বর্তমান সরকারও চায় না জাতীয় ইস্যু নিয়ে সংসদে আলোচনা হোক। ”
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১২
এসএইচ/সম্পাদনা: রানা রায়হান, আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]