ঢাকা: অনেক নির্যাতন আর প্রাণহানির পর অবশেষে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা (ইভটিজিং) ও যৌন নির্যাতন রোধে প্রচলিত আইনে সংশোধন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে আইন কমিশন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে তা আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
এছাড়া মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) ইভটিজিং রোধে সব জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ প্রশাসনকে প্রতি সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি করেছেন বিচারপতি ঈমান আলী এবং বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
আদালত জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে এ ধরনের ঘটনা নজরে এলে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন। পুলিশের মহাপরিদর্শককে আদালত মেয়েদের উত্ত্যক্তকারীদের গ্রেপ্তারসহ দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা পুরোমাত্রায় নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন।
একই সঙ্গে আদালত আইন, স্বরাষ্ট্র, নারী ও শিশু এবং শিক্ষাসহ মোট সাতটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন। এ কমিটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এক মাসের মধ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
আদালত বলেন, ‘ইভটিজিং প্রতিরোধে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে এবং তারা সেটা করছেও। তবে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছি। ’
সদ্য কাজে যোগ দেওয়া আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. শাহ আলম বাংলানিউজকে বলেন, আইন কমিশনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরকারী হিসেবে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতন প্রতিরোধে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিইডিএডব্লিউ বা CEDAW (Declaration on Elimination of Violence Against Women), যা ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ অনুসমর্থন করে।
আইন কমিশনের মূখ্য গবেষণা কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান জানান, আইন কমিশন থেকে ইভটিজিং রোধে প্রচলিত দন্ডবিধির ‘৫০৯’ ধারাকে সংশোধন করে ‘৫০৯এ’ নামে সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ সাত বছর এবং সর্বনিম্ন তিন বছরের সাজা এবং একই সঙ্গে জরিমানার কথা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আইন কমিশন থেকে প্রস্তাবটি এ বছরের ২৫ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত কোনও নির্দেশনা তারা এখনো পাননি বলে জানান তিনি। ’
পুলিশ প্রশাসনের নানান ব্যর্থতার কারণে সমাজে ইভটিজিং বেড়েছে বলে বাংলানিউজের কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। এটি সাম্প্রতিক সময়ের একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে।
তবে পুলিশের উচ্চপর্যায় থেকে যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি- তা কিন্তু নয়। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা বন্ধ করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশের সব পুলিশ সুপারকে আট দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পুলিশ কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। কেউ প্রয়োজন মনে করলেই সেখানে ফোন করতে পারবেন এবং এক্ষেত্রে তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজ শুরু ও ছুটির সময় রাস্তায় টহল পুলিশ থাকবে এবং একই সঙ্গে সাদা পোশাকের পুলিশও দায়িত্ব পালন করবে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে কম। তবে কোনও অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিই। আমরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়েছি। ছাত্রী ও অভিভাবকদের বলেছি, আমাদের কাছে অভিযোগ করতে। আমাদের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতার কথাও জানিয়েছি। ’
জিয়াউল আহসান বলেন, ‘ইভটিজিং রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জনমত তৈরি করতে হবে। তবে সেই জনমত ঘরে বসে করলে হবে না, রাস্তায় বের হয়ে আসতে হবে।
তার মতে, এ অপরাধের মামলা জামিনযোগ্য হওয়া উচিত না। আইন শক্ত হতে হবে এবং সেই শক্ত আইনের শক্ত প্রয়োগও থাকতে হবে। তাহলেই হয়তো ইভটিজিং রোধ করতে পারবো।
আইন কমিশনের আইন সংশোধনের তৎপরতা কিছুটা আশার আলো দেখালেও দু’মাসেরও বেশি সময়ে তা সংসদে না পাঠিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে আইন মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশ যোগ করেছে নতুন মাত্রা। সব বাধা পেরিয়ে সংশোধিত আইনটি সংসদে পাশ হলেও এর কতোটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে কাটছে না সংশয়।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে একাধিক সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের প্রশ্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেখানে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা থেকে নিজেরাই বিরত থাকতে পারেন না, সেখানে তারা অন্যদের কীভাবে বিরত রাখবেন?
অভিযোগ রয়েছে, থানায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় যে পরিমাণ অভিযোগ আসে, তার অতি সামান্য ক্ষেত্রেই পুলিশ পদক্ষেপ নেয়।
মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের এসব সদস্য আরও বলেন, পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে সম্প্রতি এতোগুলো প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত আইন বা সংশোধিত আইনের কোনও ফল পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ সময় ১০০০ ঘণ্টা, ০৩ নভেম্বর, ২০১০