ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

গাড়ি চালনায় এগিয়ে আসছেন নারী

মনোয়ারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১২
গাড়ি চালনায় এগিয়ে আসছেন নারী

ঢাকা: নারীর অগ্রগতি সূচকে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। নারী আর অবরোধবাসিনী নন।

সরকারি-বেসরকারি সব পেশাতেই তারা যোগ্যতার পরিচয় রাখছেন। এখন গাড়ি চালনায় যুক্ত হয়েছেন নারী। পেশাদার ও অপেশাদার দু’ভাবেই গাড়ি চালনায় তারা এগিয়ে আসছেন। নারীর অগ্রগতির এটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নারীদের এই অগ্রগতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে, হচ্ছে।

সব সেক্টরেই নারীরা এখন পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। গাড়ি চালনার মতো রোমাঞ্চকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেও নারীদের উপস্থিতি দেশের বাইরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে।

কর্মসংস্থানের তাগিদ নারীদের পিছিয়ে রাখতে পারেনি। শুধু শখের বশে গাড়ি চালনা নয়, নারী এখন এ পেশায় যোগ দিচ্ছেন জীবিকা অর্জনের জন্য। চাকরি পেতেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই দিচ্ছেন কারো ব্যক্তিগত বা অফিসিয়াল গাড়ি চালনায়। তবে বড় বড় লরি বা ট্রাক চালনায় লাইসেন্স নিয়েছেন মাত্র দুইজন নারী। ধীরে ধীরে এক সময় সব ধরনের বড় গাড়ি চালনায় নারী এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের নারী এখন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রদূত, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বৈমানিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী, সেবিকা, শিক্ষক, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, গার্মেন্টস কর্মী প্রত্যেকটি সেক্টরে সাফল্য দেখিয়েছেন।   সফল ‍ ও পেশাদার নারীদের পেশার সঙ্গে এখন উচ্চারিত হচ্ছে নারী চালকদের কথা। তারাও গাড়ি চালনা সেবার মাধ্যমে এই সমাজে অবদান রাখছেন।

তবে এই পেশায় আসা নারীদের মতে, দেশের সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত কারণে ড্রাইভিং পেশায় এখনো মেয়েদের কাজ করার পরিবেশ পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এ পেশায় মেয়েদের সংখ্যা বাড়লে পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে। তখন নারী শুধু জীবিকার তাগিদে নয়, বরং রোমাঞ্চকর একটি পেশা হিসেবে আসতে উৎসাহী হবে।

বাংলাদেশ রোডস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার ৯৭৭ নারী চালক লাইসেন্স নিয়েছেন। এর মধ্যে অপেশাদার লাইসেন্স নিয়েছেন ১১ হাজার ৬৬৮ জন নারী। আর পেশাদার নারী চালক হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছেন ৩০৯ জন।

৩০৯ জন পেশাদার নারী চালকের মধ্যে ভারি গাড়ি চালনার লাইসেন্স নিয়েছেন মাত্র দুইজন। মিডিয়াম গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দুইজন, লাইট  (জিপ, কার, মাইক্রোবাস) ২৮৬ জন, মোটরসাইকেল চালনার লাইসেন্স ১৮ জন এবং থ্রি হুইলার চালনার লাইসেন্স নিয়েছেন একজন নারী।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বাংলানিউজকে বলেন, “যোগাযোগমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রায় ৬০০ নারী চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দক্ষ নারী চালক তৈরিতে নিরাপদ সড়ক চাই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বুয়েট, নিটল-নিলয় গ্রুপ, গণস্বাস্থকেন্দ্র ও ব্র্যাক তৈরিতে বিভিন্নভাবে কাজ করছে। আমরা বিআরটিএর পক্ষ থেকে সবার কাজে সহযোগিতার চেষ্টা করছি। ”

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের এই উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। এটি কোনো সরকারের সেটা বড় কথা নয় এই সাফল্যের সুবিধা পাবে সব সরকার ও সর্বস্তরের জনগণ।

বেসরকারি উদ্যোগ
দেশে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসছে। নারীদের নিয়ে ব্র্যাক, নিসচা, নিটল-নিলয় গ্রুপসহ কয়েকটি এনজিও কাজ করছে। কেউ কেউ সরাসরি প্রশিক্ষণ না দিলেও এ ব্যাপারে সচেতনতার কাজ করছে।

চিত্রনায়ক ও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলানিউজকে বলেন, “নারী ড্রাইভাররা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছেন। আমাদেরও এ ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। সবাইকে সড়ক নিরাপদের জন্য সচেতন হতে হবে। আর নিরাপদ সড়ক তৈরিতে নারী চালকরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন নারীদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। আমরা বিনামূল্যে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স দেওয়ার জন্য কাজ করছি। ”

বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয় কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ঢাকার আবাসিক সমন্বয়কারী নীল ওয়াকার বলেন, “জাতিসংঘের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন, তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতি, আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সরকারের বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ রোল মডেল। এদেশের নারী অন্যান্য সেক্টরে এগিয়ে গেলেও তাদের পেশা বৈচিত্রের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভিং পেশা মেয়েদের জন্য বিশ্বব্যাপী উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়। ”

চিটাগাং উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজর প্রেসিডেন্ট ও ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআইয়ের) প্রথম সহ সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, “নারীরা সব জায়গায় এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভিং সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তবে আরও এগিয়ে আসা উচিত। কারণ নারী এ‌ কাজে এলে আমাদের সমাজে অনেক পরিবর্তন আসবে। ”

ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ এ (রুমী) আলী বলেন, “আমরা নারীদের ড্রাইভিং পেশায় এগিয়ে আনতে সরকারের সহায়তায় ৬০০ নারীকে বিনা খরচে গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। দু’মাসের এ প্রশিক্ষণে শেখানোর মধ্যে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নিরাপদে গাড়ি চালনা, কমিউনিকেটিভ ইংলিশ। এজন্য তাদের খাতা-কলমে শেখানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে  তাদের দেওয়া হয় ড্রাইভিং সার্টিফিকেট। সব ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে মাইক্রোবাস, বাস ও ট্রাকের চালক হিসেবে রাজপথে দেখা যাবে এসব নারীকে। ”

ব্র্যাকের তথ্য মতে, ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ নেওয়া ৬১ জন নারীর মধ্যে লাইসেন্স পেয়েছে ৩১ জন। বাকিদের ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে। লাইসেন্স পাওয়া সবাই বিভিন্ন স্থানে চাকরি করছেন। এর মধ্যে ব্র্যাক সেন্টারে একজন, ব্র্যাক ব্যাংকে চারজন, চুয়াডাঙ্গায় একটি বিদেশি সংস্থায়‍ একজন, সাজেদা ফাউন্ডেশনে তিনজন ও বাকিরা ব্যক্তিগত গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করছেন। অনেকেই ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ”

রেলওয়েতে নারী চালক
wdবাংলাদেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক সালমা খাতুন ২০০৪ সালের ৮ মার্চ চাকরিতে যোগ দেন। প্রথম ট্রেন চালান ২০০৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। রুট ছিল লাকসাম-নোয়াখালী। রেলওয়ের ড্রাইভার সালমা খাতুনের সঙ্গী হচ্ছেন আরও নয় নারী চালক। বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তত্ত্বাবধানে লোকোমোটিভ চালনায় তারা এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

নারীদের ট্রেন চালনার ব্যাপরে দেশের প্রথম নারী রেলচালক সালমা খাতুন বলেন, “দেশে নারী ড্রাইভার কম নয়। তবে আরও হতে হবে। পেশাদার নারীচালক দরকার আরও বেশি। রেলে আরও নারী চালক আসছেন, তাতে আমি খুব খুশি। তারা সার্ভিসে এলে আমার একাকিত্ব ঘুচবে। আমার বিশ্বাস, সব ধরনের পেশাদার ড্রাইভিংয়ে নারী আরও এগিয়ে আসবে। ”

নারী চালক নিরাপদ
চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইনে ব্র্যাক ড্রাইভিং ও ট্রেনিং স্কুলের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেওয়া ২১ জন নারী গাড়িচালককে সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “আমি দেখেছি মালয়েশিয়াতে মেয়েরা হিজাব পরে গাড়ি চালায়। আমাদের দেশের নারী যাতে এ পেশায় বেশি করে যুক্ত হতে পারে সরকার সে চেষ্টা করছে। ”

সরকার নারীদের এই পেশায় এগিয়ে আসতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।

মন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা আশা করি, বাংলাদেশের রাস্তায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে। কারণ মেয়েরা সহজে অধৈর্য হয় না। ওভারটেক করার প্রবণতা থাকবে না। আমরা আশাবাদী, এ পেশায় নারীরা এলে কমবে দুর্ঘটনার হার। ”

টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্যমতে, গবেষকরা তাঁদের এক গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, গাড়ির চালক হিসেবে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি নিরাপদ। গাড়ির চালক হিসেবে নারী ও পুরুষের ব্যবধান আছে। সে ক্ষেত্রে নারী চালকরাই এগিয়ে। গাড়ি চালাতে গিয়ে পুরুষের চেয়ে নারী গতিসীমা লঙ্ঘন করেন কম। হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক করার প্রবণতাও কম তাদের মধ্যে। তাছাড়া নারীরা রাতে কম গাড়ি চালায়। ফলে রাস্তায় তারা দুর্ঘটনার কবলেও পড়ে কম।

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) প্রতিষ্ঠাতা রোকেয়া কবীরের মতে নারী ড্রাইভিংয়ে আসছে কিন্ত গ্রামীণ নারী আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হলেও সার্বিকভাবে তারা এখনও প্রান্তিক পর্যায়েই রয়েছে। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সবার আগে প্রয়োজন সবার মানসিকতার পরিবর্তন। যে কোন সাহসী পেশাতে নারীদের এগিয়ে আসতে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারী স্বভাবগত কারণে এই পেশায় ভালো করবে

জীবিকার প্রয়োজনে বাধা ডিঙিয়ে
জীবিকার জন্য নারী ডাক্তার, আইনজীবী, ব্যাংকার, পরিচালক, ব্যবসায়ী, সেবিকা এভাবে দেশের সব সেক্টরে পদচারণা রয়েছে নারীদের।   জীবিকার প্রয়োজনে নারী ড্রাইভারের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এজন্য নারীদরে অনেক বাধা পেরিয়ে আসতে হয়।

নারী ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পেশায় আসতে কম-বেশি বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। কখনো পরিবার, কখনোবা সমাজের অন্যদের থেকে। যদিও সবার লক্ষ্যও নিজের পায়ে দাঁড়ানো, কিছু উপার্জন করা। সেইসঙ্গে পরিবারের আর্থিক কষ্ট দূর করা, সন্তান ও ভাইবোনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। নারী হিসেবে পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ নেই।

ঢাকায় রেন্ট-এ-কার চালান আকলিমা আক্তার। তিনি বলেন, “নারীচালক হিসেবে একবছর ধরে এক আত্মীয়ের গাড়ি চালাচ্ছি। অনেকেই তাকিয়ে থাকেন নারী ট্যাক্সিচালক বলে। আবার আমাকে সহযোগিতাও করেন অনেকে। ঢাকায় নারী ড্রাইভার এখন সব জায়গায় চোখে পড়ে। তবে পেশাদার নারী ড্রাইভার বাড়াতে হবে। কারণ নারীদের এই পেশায় উন্নতি করার সযোগ আছে।

ব্র্যাকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিতে আসা রাজশাহীর সুমি খাতুন বলেন, “কাজে ছেলেরা যা পারবে মেয়েরাও তা পারবে। আমি সংকোচ না করে এই পেশাতে এসেছি। আমাদের সংসার, বাবা, মা, ভাইবোনদের জন্য কাজ করতে চাই। ”

রাঙামাটি থেকে  ঢাকায় এসে ড্রাইভিং শেখা মিনতি প্রভা চাকমার মতে, “নারী হিসেবে বা আদিবাসী হিসেবে কোনো বাধা নেই। বরং চাকমা সম্প্রদায় থেকে প্রথম নারী গাড়িচালক  হবার গৌরব আছে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১২
এমআইআর/সম্পাদনা: আহমেদ রাজু, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।