ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডে সমুদ্রপথে মানবপাচারের হোতারা

রহমান মাসুদ, ইলিয়াস সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১২
মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডে সমুদ্রপথে মানবপাচারের হোতারা

কক্সবাজার থেকে: কক্সবাজার জুড়েই রয়েছে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট সারা বছরই থাকে সক্রিয়।

স্থানীয় সংসদ সদস্য, পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, শিক্ষক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।

মানবপাচারের বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে টেকনাফ ও উখিয়ায় বসবাসরত নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও গডফাদাররা।

বেশিরভাগ মানবপাচার কার্যক্রম পরিচালিত হয় টেকনাফ থেকে। সপ্তাহব্যাপী সেন্টমার্টিন ও টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধানে জানা যায়, মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে শতাধিক ব্যক্তি।

দালাল চক্রের মূল হোতা টেকনাফের স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির আপন ভাই মৌলভী মজিবুর রহমান (পিতা এজাহার মিয়া, সাং জালিয়াপাড়া, টেকনাফ)।

অন্য দালাল সর্দাররা হলেন এমপির ভাগ্নে ও আবদুর রহমান দারোগার ছেলে নিপু, তার চাচাতো ভাই আকতার কামাল ও শাহেদ কামাল (পিতা- নাজির আহমেদ), এমপির তালতো ভাই (ভাইয়ের শ্যালক) এবং সাবেক ইউপি সদস্য ইউনুস, সাবরাং ইউনিয়নের কচুবনিয়া এলাকার নজির আহমদ প্রকাশ নজির ডাকাত, শাহপরীর দ্বীপের বাজার পাড়ার ধুলু হোসেন, চকরিয়ার মৃত মোজাহের কোম্পানির ছেলে জাফর আলম কোম্পানি, সেন্টমার্টিনের আবু তালেব, মুন্ডারডিলের আক্তার ফারুক মার্ডারার আবদুর রহমান।

মানবপাচার সিন্ডিকেটের রোহিঙ্গা অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন উখিয়ার কুতুপালং এলাকার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের এ ব্লকের ৪০ নং শেডের ছৈয়দ আলম মাঝি ও তার ছেলে মো. আলম, শাহ আলম, ফরিজুল্লা ও শামসুল, হাবিবুর রহমানের ছেলে আইয়ুব মাঝি, নজির আহমদের ছেলে আবুল কালাম, আব্দুল কাদেরের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক, কামাল পাশা ওরফে জালি মিয়া।

এছাড়াও সি ব্লকের ১৯ নং শেডের সৈয়দ আলমের ছেলে জসীম আহমদ, একই এলাকার অনিবন্ধিত ক্যাম্পের সভাপতি লাল মিয়ার ছেলে আবু সিদ্দিক, একই ক্যাম্পের সিএমসি সদস্য ইমাম হোসেনের ছেলে রফিক, সাধারণ সম্পাদক মৃত নজিমুল হকের ছেলে মাস্টার রাকিব।

মানবপাচারে ব্যবহৃত বোটগুলোর মাঝির কাজ করেন সাধারণত ক্যাম্পে থাকা ও অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের মাঝিরা। জানা গেছে, পাচার হয়ে যাওয়া মানুষের সিংহভাগই রোহিঙ্গা।

এ কাজে আরো যারা জড়িত
সেন্টমার্টিনের গডফাদার ও বোট মালিক সমিতির সভাপতি আবু তালেব এবং ইউপি বিএনপির সভাপতি সৈয়দ কাসিমের ছেলে ফয়েজ। এছাড়াও তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন কালাম, মুস্তাক, তাহের, ইউনুস ও রশীদ।

টেকনাফের মাঝিরা হচ্ছেন, রশীদ মাঝি, এজাহার মাঝি, রহমান মাঝি, কবির মাঝি, আব্দুল্লাহ মাঝি। কচুবনিয়ার হাজী মনিরুজ্জামানের ছেলে মো. রহিম, আলী আহমদের ছেলে আবুল কালাম। কোনাপাড়ার সৈয়দ করিম চকিদারের ছেলে ইয়াহিয়া।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নিজাম আহমদের ছেলে মো. হাসান কক্সবাজার শহরে থেকেই করছেন মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের কাজ। এ কাজে জড়িয়ে আছেন কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার খারুলিয়া গ্রামের মৃত ছালিম উল্লাহর ছেলে আবু তালেব। কক্সবাজার সদরের ঈদগাহ এলাকার আজিম। চকরিয়ার মুবিন পাড়ার গ্রামের আবু তাহের শিকদারের ছেলে আব্দুল মান্নান শিকদার। বান্দরবনের লামা, বরইতলি, নয়া পাড়ার ফাইতংয়ের হেলাল উদ্দিনের মেয়ে হ্যাপী বেগম। চকরিয়ার মৃত মোজাহের কোম্পানির ছেলে ও মানবপাচারের গডফাদার জাফর আলম কোম্পানি। একই এলাকার শামসুল আলম ও শাহাবুদ্দীনেরও নাম উঠে এসেছে জড়িতদের নামের সঙ্গে।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের বাজার পাড়া গ্রামের মৃত সুলতান আহমদের ছেলে ও মানবপাচার কাজের গডফাদার এবং বোট মালিক ধলু হোসেন। শাহপরীর দ্বীপের ঘোলাপাড়া গ্রামের মৃত কবির হোসেনের ছেলে সামসুল আলম।

মিস্ত্রিপাড়া গ্রামের নজির আহমদের ছেলে নুরুল আলম, দলিল মিয়ার ছেলে হোসেন, হাজী আলী হোসেনের ছেলে এনায়েত উল্লা, জোর আহম্মদের ছেলে জাফর আহমদ, নজির আহমদের ছেলে বোট মালিক নুর হোসেন, ফয়জুর রহমানের ছেলে বোট মালিক মো. হাসান, জালাল আহমদের ছেলে শরীফ হোসেন ও মৃত হাসেমের ছেলে সেলিম।

কোনারপাড়া গ্রামের সৈয়দ করিম চৌকিদারের ছেলে ইয়াহিয়া, কলারডাপা গ্রামের নজির চোরা ও ফয়জুর রহমানের ছেলে মো. হাসান।

ডেইলপাড়ার নুর বিবি ও তার ভাগিনা ইলিয়াস, ডাঙ্গরপাড়া গ্রামের বড় হাজীর ছেলে ফিরোজ আহমদ ও আব্দুল মোতালেবের ছেলে দেলোয়ার হোসেন। হ্নীলা ইউনিয়নের উত্তম মিয়া, জাদীমুড়া গ্রামের নবী হোসেন ও আব্দুর রহমানের ছেলে সোহাগ আব্দুল্লাহ।

শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়া গ্রামের কালা মিয়ার ছেলে কামাল হোসেন, আব্দুল লতিফের ছেলে সাব্বির আহমদ ও মৃত সুলতান আহমদের ছেলে সাহাব মিয়া।

পশ্চিম পাড়া গ্রামের সফি মিয়ার ছেলে বোট মালিক কবির হোসেন। মাঝের পাড়া গ্রামের বোট মালিক জলিল ও সুলতান আহমেদের ছেলে হাফেজ আব্দুল্লাহ।

দক্ষিণ পাড়া গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে সামসুল আলম ওরফে সামসু মাঝি, নুর আহমদের ছেলে বোট মালিক মো. জাফর,আলী মাঝি, এজাহার মিয়ার ছেলে ফয়েজুর রহমান ও মাহমুদুল্লাহ মাঝির ছেলে শফিক ও জাহিদ মাঝি।

হোয়াইক্যাং ইউনিয়নের এর লম্বাবিল গ্রামের আব্দুর রশীদের ছেলে মো. শামসুল আলম।

সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়ার মো. হোসেনের ছেলে দলিল আহম্মদ, কচুঁবনিয়া এলাকার সুলতান আহমদের ছেলে মৌলভী বশির ওরফে ডাইলা, মইনুদ্দিনের ছেলে আব্দুর রহিম, কাটাবুনিয়া এলাকার কালা মিয়ার ছেলে সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম ওরপে বাদু কোম্পানি ও আবুল কাশেমের ছেলে ইব্রাহীম।

টেকনাফের শামলাপুর গ্রামের পুরান পাড়ার মৌলভী নাজিরউদ্দীনের ছেলে মৌলভী আজিজ ও একই গ্রামের নয়াপাড়া এলাকার রশীদ আহমদের ছেলে আব্দুস সালাম প্রকাশ আব্দু কোম্পানি, রশীদ আহমদের ছেলে আজিজুল ইসলাম ওরফে পুতুইয়া।

টেকনাফের আজিজুর রহমানের ছেলে ফয়েজ, মকবুল আহমদের ছেলে নুরুল ইসলাম ওরফে কালা পুতু, আবুল মাজেদের ছেলে জাহাঙ্গীর, মীর আহমেদ।

উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের আলী আহম্মদের ছেলে নুরুল আলম। পালংখালি ইউনিয়নের ধামনখালি গ্রামের সৈয়দ, মফিজউদ্দিন, আব্দুস সাত্তার, মামুন ওরফে ঝুনু, শাজাহান ও আয়ুব মাঝি মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত।

নির্বিকার প্রশাসন
প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়েই কক্সবাজার জেলা থেকে প্রতিদিন সাগর পথে মালয়েশিয়া যাচ্ছে একাধিক ট্রলার। আবার গভীর সমুদ্রে অপেক্ষামাণ বার্মিজ কাঠের জাহাজেও তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশগামী যুবকদের। প্রশাসন এ ক্ষেত্রে নীরব। গত কয়েকদিনে বাংলানিউজ সুনির্দিষ্টভাবেই ঘাট, বোট, মাঝি ও সময় উল্লেখ করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব বোট ঠেকানো, বাধা দেওয়া, তল্লাশি বা প্রশাসনিক ব্যক্তি ও বাহিনীর সদস্যর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেলো, স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ব্যবসায়িক অংশীদার চট্টগ্রাম বিভাগীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ কোনো দালাল বা গডফাদার আটক করলে সংসদ সদস্যের সুপারিশে তা ছেড়ে দিতে টেকনাফ ওসিকে ফোন করে ওই বিভাগীয় পুলিশ কর্মকর্তা। কক্সবাজার জেলা পুলিশও ওই কর্মকর্তা ও সাংসদের দাপটের কাছে অসহায়। এছাড়া টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে দালালদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার একাধিক অভিযোগ। পুলিশের এই নতজানু মনোভাব ও দুর্নীতির কারণে প্রতিদিন সাগর পথে অনিশ্চতায় পা বাড়াচ্ছেন শত শত ভাগ্যান্বেষী যুবক। র‌্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও নৌবাহিনীর পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট, স্থাপনা, যানবাহন, নৌযান ও লোকবল ‍না থাকায় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ফলে অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়ে এদের কেউ কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য
স্থানীয় এলাকাবাসীর মতে, কে বা কারা মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। দালালরা এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার কাছে চেনা-পরিচিত মুখ। এমনকি সরকারের খাতায় তাদের নামও রয়েছে। এরপরও কেন এ মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না, তা বুঝতে পারছে না সাগরপাড়ের এ জনপদ।

হিসাব মতে, টেকনাফের জনসংখ্যা পাঁচ লাখ। অথচ টেকনাফ ও উখিয়ায় অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হচ্ছে সাড়ে পাঁচ লাখ। মিয়ানমারে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারাই মালয়েশিয়া যাচ্ছে বেশি। তারা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশি হিসেবে কাজ করে পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে বলে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ওই পাসপোর্ট দিয়ে বাংলাদেশে এসে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে জমি ও বাড়ির মালিক বনে যায় তারা।

অর্ধেকই ফাঁকি
যারা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যান, তাদের সবাই কি সেখানে গিয়ে পৌঁছান? স্থানীয় দালাল, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রমতে, সম্ভবত না। রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি একটি চক্র আছে, যারা কেবল সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে বোট ডুবিয়ে মেরে ফেলার জন্যই লোক জোগাড় করেন। এ কাজটি এরা এতো কৌশলে করে যে, কারো পক্ষেই এই বোট ডোবানোকে দুর্ঘটনার বাইরে ভাবতে পারে না। ডুবিয়ে দেওয়া বোটকে অনুসরণ করে অন্য একটি বোট। ডোবানো বোটকে উদ্ধারের কৌশলে দালাল ও মাঝিসহ যারা ভেসে থাকেন তাদের নিয়ে চলে আসে।

অন্যদিকে মহেশখালি, চকরিয়া অঞ্চল থেকে ছাড়া বোট সাগরে তিন চারদিন বিক্ষিপ্ত ঘুরে, রাতের আ‍ঁধারে সেন্টমার্টিন বা শাহপরীর দ্বীপকে মালয়েশিয়া বলে লোক নামিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ডিসেম্বর ২৭,২০১২
আরএম/এমইএস/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।