(গণধর্ষণের ঘটনার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম যায় টাঙ্গাইলে। এই টিমে ছিলেন বিশেষ প্রতিনিধি ও চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমীর।
মধুপুর, টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: ‘অপরাজিতা’ (মেয়েটির আসল নাম নয়) গণধর্ষণের নেপথ্যে রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দালালদের মাধ্যমে অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী-তরুণীদের নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। এরপর তাদের অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করে। সিন্ডিকেট মধুপুর থেকে রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত।
টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশ এবং মধুপুর থানা পুলিশ সূত্রে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সিন্ডিকেটের সদস্যরা নারী ও পুরুষ দালালদের মাধ্যমে অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের সংগ্রহ করে। দালালরা প্রথমে তরুণীদের নাটকে অভিনয়ের প্রলোভন দেখায়। প্রলোভন দেখানো হয়, অভিনয়ে সুযোগ পেলে তারা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবেন। ঘুচে যাবে দারিদ্র, বদলে যাবে ভাগ্য। জীবনে আসবে অর্থ-বিত্ত আর প্রাচুর্য।
দারিদ্র থেকে রেহাই এবং যশ-খ্যাতি পেতেই অনেক তরুণী সিন্ডিকেটের ফাঁদে ধরা দেয়। এই সিন্ডিকেট ভিডিও ক্যামেরায় নাটক ও মিউজিক ভিডিও বানায়। এসব নাটক প্রচারে সরকারের কোনো সেন্সর লাগে না। তাই এগুলো কেবল অপারেটরদের মাধ্যমে স্যাটেলাইট টিভির দর্শকদের জন্য প্রচার করা হয়।
কোনো কোনো নাটক ও মিউজিক ভিডিও রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেট এবং পুরোনো ঢাকার পাটুয়াটুলীর বিভিন্ন সিডির দোকান থেকে বাজারজাত করা হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে যায় রাজধানী ছাড়াও বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত নাটকগুলো সাধারণত আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়। চটুল ভাষা ব্যবহার ও অশালীন অঙ্গভঙ্গির কারণে এ নাটকগুলো গ্রামের মানুষের কাছে বেশ ‘জনপ্রিয়’। গ্রামাঞ্চলের হোটেল, চা এবং মুদি দোকানে দিনভর চালানো হয় এই ধরনের নাটক ও মিউজিক ভিডিও। এগুলো দেখার জন্য ওইসব জায়গায় সারাদিনই ভিড় থাকে। তাই বেচাবিক্রিও হয় ভালো।
মধুপুরে কেবল অপারেটররা যে চ্যানেল চালায় তার নাম মধুপুর চ্যানেল। স্থানীয়দের মধ্যে এটি ‘ডেঙ্গু চ্যানেল’ নামে পরিচিত। এ চ্যানেলেই দেখানো হয় ওই সিন্ডিকেট নির্মিত নাটক ও মিউজিক ভিডিও।
পুলিশ জানায়, এমনই একটি নাটক ‘নিয়তি’র নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করছিলেন বীথি। দ্বিতীয় নায়িকার চরিত্রে অভিনয়ের প্রলোভন দেখানো হয় ‘অপরাজিতা’কে। নাটকে অভিনয়ের প্রলোভন দেখিয়েই বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান বীথি। সরল বিশ্বাসে ‘অপরাজিতা’ বীথির সঙ্গে মধুপুরে যান। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বোকারবাইদ গ্রামে গেদার বাড়িতে। সেখানে তাকে টানা তিনদিন গণধর্ষণ করে পাষণ্ডরা।
পুলিশ জানায়, নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলে এই পাষণ্ডরা অনেক তরুণীর জীবন ধ্বংস করেছে। তাদের বিপথগামী করা হয়েছে। এসব মেয়ের সঙ্গে প্রথমে নিজেরা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তারপর স্থানীয় প্রভাবশালী এবং বিভিন্ন মহলে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এদের ব্যবহার করা হয়।
এদিকে, বীথির সঙ্গে পরিচয় হওয়া সম্পর্কে ‘অপরাজিতা’র ভাই জানান, টাঙ্গাইলে একটি নাচের স্কুলে নাচ শিখিয়ে তিনি তার লেখাপড়া চালিয়ে যান। কিন্তু, নবম শ্রেণিতে উঠার পর আর্থিক টানাপোড়েনে ‘অপরাজিতা’র লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর টাঙ্গাইলে একটি সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে ‘অপরাজিতা’। সেখানে তার সঙ্গে আরেকটি মেয়ের পরিচয় হয়। ওই মেয়েটির মাধ্যমেই বীথির সঙ্গে পরিচয় হয় ‘অপরাজিতা’র।
পরিচয়ের পর থেকেই বীথি ও ‘অপরাজিতা’র মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়। মাঝেমধ্যেই তারা দু’জন উভয়ের বাড়িতে যাতায়াত ও রাতযাপন করতো। তাই সেদিন বিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ‘অপরাজিতা’র পরিবার কোনো আপত্তি করে নি।
বীথির খালা বাংলানিউজকে জানান, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর টাঙ্গাইল শহরের শাপলা নার্সিং হোমে চাকরি নেন বীথি। বাবা-মা হারা বীথির অসহায়ত্বের কথা জেনে তার প্রতি সদয় হন ওই ক্লিনিকের এক কর্মকর্তা। তাই বীথি ভিন্ন ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও তাকে তার বাসায় নিয়ে যান।
গৃহকর্মী হিসেবে বাসায় নেওয়া হলেও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে শাপলা নার্সিং হোমের ওই কর্মকর্তা বীথিকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু, বাদ সাধেন তার স্ত্রী। ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ায় ওই কর্মকর্তার স্ত্রী বিষয়টি মেনে নেন নি। তাই এক পর্যায়ে বীথিকে সেখান থেকে চলে আসতে হয়।
বীথির খালা আরো জানান, শাপলা ক্লিনিক থেকে চলে আসার পর বীথি সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। তারপর বাড়িতেই সেলাইয়ের কাজ করতে থাকেন।
মাস ছয়েক আগে তিনি ‘ভাদাইমার হাতে চেংগু খুন’ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান। নাটকটির (ভিসিডি) মোড়কে বড় করে তার ছবি থাকলেও ভেতরে তার কোনো অভিনয়ের দৃশ্য নেই।
অভিনয় শুরু করার পর থেকে বীথির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসতে থাকে। মাস ছয়েক আগে বীথি তার নানা বাড়িতে একটি টিনের ছাপড়া ঘর দিয়েছে। বীথির খালা জানান, ছাপড়া ঘর তৈরিতে তিনি এনজিও থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সপ্তাহে তাকে ৩০০ টাকা শোধ করতে হতো।
জানা যায়, বীথির নানাবাড়ির আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। নানার নিজের কোনো বাড়ি ও জমিজমা নেই। টাঙ্গাইল কালিহাতি পৌলী রেলক্রসিং-এর পাশে মহেলা গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত তিনি।
পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, মধুপুর থানা পুলিশ ‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণের মামলাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। মোটা অংকের উৎকোচ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আসামীদের পক্ষ থেকে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে, মামলাটি যেন পুলিশ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে।
এদিকে মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুজিবুর রহমান মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। এটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মামলাটি তদন্ত করছি। মামলায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ”
উল্লেখ্য, গত ৬ ডিসেম্বর মধুপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে ‘অপরাজিতা’কে পালাক্রমে ধর্ষণ করে এসএম নুরুজ্জামান ওরফে গেদা, শাজাহান আলী, হারুনুর রশিদ ও মনিরুজ্জামান মনি। এরপর ১০ ডিসেম্বর রেললাইনের পাশে অর্ধচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ‘অপরাজিতা’কে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৩
এআর/আরআর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
- ‘অপরাজিতা’ ধর্ষণ: জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে টাঙ্গাইলে মানববন্ধন
- সুস্থ হয়ে উঠছে টাঙ্গাইলের ‘অপরাজিতা’
- সরেজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণ: নারীরা ছিলেন নাইওরে! - সরেজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণ: নেপথ্যে আরো অনেকেই! - সরেজমিন ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণ: নেপথ্যে অভিনয়ের প্রলোভন!