ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

টাঙ্গাইলে গণধর্ষণ: বাড়ি ফিরতে পারবে তো ‘অপরাজিতা’!

আহমেদ রাজু, রানা রায়হান, সুমন রায় ও এসএম শহীদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৩
টাঙ্গাইলে গণধর্ষণ: বাড়ি ফিরতে পারবে তো ‘অপরাজিতা’!

(গণধর্ষণের ঘটনার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম যায় টাঙ্গাইলে। এই টিমে ছিলেন বিশেষ প্রতিনিধি ও চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমীর।

তাদের সঙ্গে ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি সুমন রায় ও মধুপুর প্রতিনিধি এসএম শহীদ। )

মধুপুর, টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: ‘অপরাজিতা’ (মেয়েটির আসল নাম নয়) কী বাড়ি ফিরতে পারবে? ফিরে যেতে পারবে কী বাবা-মা-ভাই-বোনের কাছে? স্থানীয় লোকজন ও মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, সম্ভবত কিশোরী মেয়েটি আর বাড়ি ফিরতে পারছে না!

এরই মধ্যে গ্রাম থেকে গ্রামে বহুদূর ছড়িয়ে গেছে তার বাড়ির ঠিকানা, বাবা-মা-ভাইয়ের নাম ইত্যাদি। এটি হয়েছে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও একজন সংসদ সদস্যের অদূরদর্শিতা ও হঠকারিতার কারণে। স্থানীয় দৈনিকটি মেয়েটির বাবা-মার নাম ও ছবি পর্যন্ত ছেপে দিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, মেয়েটির বাবা স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহমুদুল হাসানের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিচ্ছেন।

অপরাজিতার পরিবারও সামাজে টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়েও ঘোর সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ‘অপরাজিতা’র বাড়ির সামনেই নারীনেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী খুশী কবিরের সংগঠন ‘নিজেরা করি’ সমাবেশ আয়োজন করে।

টাঙ্গাইল ও মধুপুরে গণধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। আসামিদের শাস্তি ও মেয়েটিকে অভয় দেওয়ার লক্ষ্যেই এসব আয়োজন।

মাহমুদুল হাসান এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার বাড়িতে গিয়ে অর্থ সহায়তা করে এসেছেন। এসব ঘটনার ছবিও বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকায় এসেছে। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকেও সবার নাম-ঠিকানা মেয়েটির স্কুল ও গ্রামের নাম উঠে এসেছে, যা মোটেও কাম্য নয় বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

এ বিষয়ে ‘নিজেরা করি’র নির্বাহী পরিচালক খুশী কবির বাংলানিউজকে বলেন, “মেয়েটির পুনর্বাসন নিয়ে আমরা এখনো আলোচনা করিনি। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী হাসপাতালে মেয়েটিকে দেখতে গিয়েছিলেন। সরকারের তরফ থেকে তিনি মেয়েটির দায়িত্ব নিয়েছেন। ”

টাঙ্গাইলে অপরাজিতার গ্রামের পাশে সমাবেশ আয়োজন সম্পর্কে তিনি বলেন, “সেই সমাবেশে আমি যাইনি। তবে এতে আমাদের সমর্থন ছিল। স্থানীয় লোকজন মূলত এতে অংশ নেয়। শুধু নিজেরা করি এ সমাবেশের আয়োজন করে নি। সেখানে সবাই মিলে প্রতিবাদ করে। ” তবে স্থানীয়রা বলছেন, এ সমাবেশের আয়োজন করে ‘নিজেরা করি’।

এর ফলে মেয়েটি ও তার পরিবারের সামাজিকভাবে কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনই তো মেয়েটি ও তার পরিবার সমস্যায় আছে। সমাবেশের কারণে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা চাই এ ঘটনা যারাই ঘটিয়ে থাকুক তাদের শাস্তি হোক। ”

তিনি আরো বলেন, “আমরা মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি। মেয়েটি ও তার পরিবার জানুক আমরা তার পাশে আছি, এলাকাবাসী তার পাশে আছে। সাহস পেলে ও আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। ”

‘‘সামাজিকভাবে সমস্যা হবে জেনে সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষিত মেয়ের নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করা হয় না। তাহলে বাড়ির পাশে কেন আপনারা সমাবেশ করলেন?’’—এ প্রশ্নের জবাবে খুশী কবির বলেন, “পুরুষ হিসেবে সমাজ আপনাকে খারাপ চোখে দেখছে না। মেয়েদের খারাপ চোখে দেখে সমাজ। একজন পুরুষ অপরাধ করলে যেভাবে সহজে মেনে নেব, মেয়েদের ক্ষেত্রে সেভাবে হবে না। আপনি ছিনতাই করলে সমাজ আপনাকে হেয় করছে না। সমাজ চায় না এগুলো ঘটুক। ”

“মেয়েটার প্রতি সবারই সমর্থন আছে। আমরা যদি তার পাশে থাকি, সে সাহস পাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এলাকাবাসী তার পাশে আছে। ”

তিনি বলেন, “আসামিরা বুঝুক তাদের পাশে কেউ নেই। ক্রিমিনাল মনে করে, তাদের কেউ কিছু বলবে না। এটা হতে দেওয়া যাবে না। ”

খুশী কবির বলেন, “যে ঘটনার মধ্য দিয়ে মেয়েটি গেছে সেটা একটি ট্রমা (মানসিক আঘাত)। এটি কাটতে সময় লাগবে। আবার সমাজ ও মানুষ কীভাবে দেখছে সেটিও ট্রমা। এ মুহূর্তে চিকিৎসকদের দিকে তাকিয়ে আছি। তারা যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবে এগিয়ে যাবো। মেয়েটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠুক, এই কামনা করছি। ”

হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বাংলানিউজকে জানান, “মামলাটির আইনগত সমস্যার ব্যাপারগুলো আমরা দেখছি। এফআইআরে আমরা লুপহোল (ফাঁকফোকর) খুঁজে পেয়েছি। এখন যে অবস্থায় আছে তাতে আসামি ছাড়া পেয়ে যাবে। ”

মেয়েটির বাড়ির সামনে সমাবেশ করা উচিৎ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একদম বাড়ির সামনে এ ধরনের সমাবেশ করা উচিৎ না। এটি যারা করেছে তারা হয়ত চিন্তা না করেই করেছে। ”

‘অপরাজিতা’র পুনর্বাসনের ব্যাপারে তিনি বলেন, “সরকারের উচিৎ মেয়েটির দায়িত্ব নেওয়া। তবে এমন জায়গায় নিতে হবে যেন নতুন করে সে কারাগারে না যায়, বন্দি না হয়। বিদেশে এসব ক্ষেত্রে মেয়েটির নাম-পরিচয় পরিবর্তন করে স্কুলে দেয় বা পেশায় নিয়োগ করে। ”

স্থানীয় লোকজন ও মেয়েটির নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়েটির বাবা দিনমজুর। অত্যন্ত অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় পরিবারটিকে। এ কারণে মাস ছয়েক আগে নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয় তাকে। এমন পরিস্থিতিতে সেলাই শিখতে গিয়ে যোগাযোগ হয় ধর্ষণে সহায়তাকারী বীথির সঙ্গে। বীথিসহ এ মুহূর্তে পাঁচ আসামি জেলহাজতে রয়েছেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, এসএম নুরুজ্জামান ওরফে গেদা, শাজাহান আলী, হারুনুর রশিদ ও মনিরুজ্জামান মনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৩
আরআর/এআর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।