রাজনীতিতে নতুন করে আবার ‘প্লাস’ ’মাইনাস’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রাজনীতিতে সব সময়ই যোগ-বিয়োগের খেলা চলে আমরা জানি।
দলের বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থও যে বিবেচিত হয় না তার বড় প্রমাণ হলো, রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। নতুন নেতৃত্বও আসছে না। এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব নির্বাচন হয় কে দলকে বা নেতাকে বা লবিস্টকে বেশি টাকা দিতে পারে। বেশি অন্ধ আনুগত্য দিতে পারে। অর্থ ও অন্ধ আনুগত্যই এখন নেতৃত্বের মানদণ্ড। জনমত বা জনস্বার্থ এখানে গৌণ। রাজনীতিকদের ধারণা, অর্থ থাকলে জনগণ এমনিতেই দলে ভিড়বে।
সেই সাথে পেশিশক্তি থাকলে জনমতের তোয়াক্কা না করলেও চলে।
আমাদের দেশে এ রাজনৈতিক ‘আদবের’ শুরু হয়েছে ৮০’র দশকে। অর্থ-অস্ত্র-পেশির ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় রাজনীতিতে সামরিক উর্দির অনুপ্রবেশের ফলে। সাদা পাঞ্জাবির ভিতরে জলপাই রঙের উর্দি আবিষ্কার করতে আমাদের সময় লেগেছে এক দশক। পাকিস্তান আমলেও আইয়ূবী চাল বুঝতে ১০ বছর সময় লেগেছিল বাঙালির। ভোলা-ভালা বাঙালির বুঝতে সময় একটু বেশিই লাগে! কিন্তু একবার বুঝতে পারলে সিদ্ধান্ত নিতে তার বেশি সময় লাগে না অবশ্য। আইয়ূবের গদি ওল্টাতে বাঙালির কয়দিন লেগেছিল? আর নয় মাসে তো বাঙালি লড়ে-রক্ত দিয়ে গোটা দেশটাই স্বাধীন করে ফেললো।
বাঙালি বুঝবে কীভাবে? তার অতীতটা তো স্বর্ণোজ্জ্বল। অবিভক্ত ভারতবর্ষে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মেধা-প্রজ্ঞা, দূরদশিতা ও দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। এতো কম সময়ে সেই ইতিহাস মুছে ফেলা তো সম্ভব নয়! সবকিছু তো চাইলেই মাইনাস করা যায় না।
আমরা তো আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে চাইলেই শেরে-বাংলা ফজলুল হককে মাইনাস করতে পারবো না। কেবল চল্লিশের দশকেই একাধারে তিনি মুসলিম লীগ সংগঠিত করেছেন, লাহোর প্রস্তাব প্রণয়ন করেছেন, পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকে অথাৎ-’৫২ সালে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ’৫৫ সালে স্বরাষ্টমন্ত্রী, ’৫৬ সালে গভর্নরের দায়িত্বসহ নানাবিধ দায়িত্ব পালন করেছেন। এসবই তার কীর্তি। তাকে মুছে দিলে তো আমাদের ইতিহাসই অপূর্ণ থেকে যাবে।
একইভাবে সম্ভব না হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও বাদ দেওয়া। তিনি ১৯৪৩ সালে খাদ্যমন্ত্রী হন। ’৪৬ সালে মুসলীম লীগ সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এছাড়া ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ’৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তাকে বাদ দিয়ে তো আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস রচিত হতে পারে না। কারণ, তিনি আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে আওয়ামীলীগ বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসও রচিত হতে পারে না।
এভাবে অবিভক্ত পাক-ভারতের আরো অনেক নেতার কথা বলা যাবে যারা সময়কে জয় করেছেন তাদের কর্ম দিয়ে। ভারত বিভক্তির আগে নেতাজী সুভাষ বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, ভগৎ সিং, মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, জওয়াহের লাল নেহেরু, মহাদেব গোবিন্দ রানা দে, আবুল কালাম আজাদসহ আরো অসংখ্য নেতার কথা আমরা বলতে পারি। তারা কেবল রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না; তারা একেকজন ছিলেন সমাজ সংস্কারক।
স্বাধীনতার পরে আমরা সেই নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু, ভাসানীসহ এমন আরো অনেক নেতার রাজনৈতিক জীবন আমাদের আজকের রাজনীতিকদের জন্য আদর্শ হতে পারতো। কিন্তু আমরা তাদেরকে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ করতে পারি নি।
আমরা আদর্শিক রাজনীতি থেকে অনেক আগেই তাদের মাইনাস করেছি। তাতেও দোষের কিছু নাই যদি তাদের সেই আদর্শিক রাজনীতির জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারতাম বা নিজেরাই আদর্শ রাজনীতিক হতে পারতাম। সেটা করতে পারলে আজকের রাজনীতিকরা আগামী প্রজন্মের জন্য আদর্শ হয়ে থাকতে পারতেন। রাজনীতিতে যোগ হতো শুভশক্তির। বিদায় নিতো সকল অশুভ।
সেটা হয় নি বলেই আজ অমুককে ‘মাইনাস’ করো, কাল তমুককে প্লাস করো’ জাতীয় তথাকথিত ফর্মুলা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, রাজনীতিতে জোর-জবরদস্তি করে কাউকে প্লাস-মাইনাস করা যায় না। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। রাজনীতিতে কার কী অবস্থান ও পরিণতি হবে তা সময়ই ঠিক করে দেবে। জনগণ এখানে মূল চালিকাশক্তি। কোনো ব্যক্তি বা ফর্মুলা দিয়ে সেটি সম্ভব নয়। যদি তা-ই হতো তাহলে আর রাজনীতি থাকতো না, গণতন্ত্রেরও প্রয়োজন হতো না।
‘মাইনাস-প্লাস’ কোনো গণতান্ত্রিক আদর্শ নয়। এটি স্বৈরাচারী মতবাদ। স্বৈরশাসকরাই জনগণের ওপর তাদের জবরদস্তিমূলক শাসন-প্রশাসন চাপিয়ে দিতে পারে। জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে হয়।
আমাদের দেশেও অস্ফূট ও অপূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের অজুহাতে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার আবিভাব হয়। ১/১১ সেই ফর্মুলারই সাংকেতিক নাম আর কি! রাজনীতি থেকে দুইটি প্রধান দলের নেত্রীদের বাদ দিয়ে নতুন ধারার একটি (অপ)রাজনীতি চালু করতে চেয়েছিল সে সময়ের নায়করা। কিন্তু বিধি বাম! সেই নাটকের কুশীলবরা নায়ক হতে গিয়ে খলনায়ক হয়েছেন। কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না তেমনি নীচের থেকে সরিয়েও নেওয়া যায় না। প্লাস-মাইনাস এখানে অচল মতবাদ। জোর করে ক্ষমতায় বসা যেমন রাজনৈতিক অবিচার, তেমনি জোর করে রাজনীতিকদের রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টাও রাজনৈতিক ব্যভিচার। এটি মূলত বিরাজনীতিকরণ বা ‘মাইনাসিং গণতন্ত্র’র আরেক নাম।
কিন্তু ইতিহাসের সবচে’ বড় শিক্ষা হলো আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। আমরা ১/১১ এর সুবিধাভোগী (বেনিফিশিয়ারি) কারা আর ভিকটিম কারা এ নিয়ে যত কাদা ছোড়াছুড়ি করি সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে তার সিকিভাগও চিন্তিত নই। মুখোশ উন্মোচন বা বিচার তো অনেক পরের কথা। আমরা অবিচারের শাস্তি দিতে লগি বৈঠা নিয়ে মাঠে নামি আর ব্যভিচারিকে ফুল-মালা দিয়ে বরণ করি।
ফলে অনেকে বলছেন, রাজনীতিতে মাইনাস টু বা নতুন করে ১/১১ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। একথা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনতে হয়, তখন আম-জনতা হিসেবে আমরা চিন্তিত না হয়ে পারি না । যদি প্রধানমন্ত্রীর কথা সত্যি হয়ে থাকে তবে যারা এই অপচেষ্টার সাথে জড়িত অনতিবিলম্বে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দায়িত্বও তারই। কেবল অভিযোগ দায়েরই প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়। জনগণ পাঁচ বছরের জন্য তাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে দেশ শাসনের, পরিচালনার এবং সুশাসন উপহার দেবার জন্য। সেখানে সামান্য কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারীকে শাসন করতে পারবেন না, সেটি অবিশ্বাস্য, অগ্রহণযোগ্য। আবার আইনের দৃষ্টিতে তিনি অতীতের ঘটনার বিচার করেন নি বলে যে নতুন ঘটনার বিচার করতে পারবেন না তা-ও নয়।
তবে জনগণের জন্য যেটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও উদ্বেগের বিষয়, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলো যেনো নতুন করে আর ১/১১ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট রচনা না করে। রাজপথে লগি-বৈঠা কিংবা কাস্তে-কোদাল-লাঙ্গলের লড়াই যেনো আর না হয়। এর চেয়ে সংসদে বসে খিস্তি খেউর করুন তা-ও ঢের ভালো। বাঙালি হরর মুভির চেয়ে কমেডি নাটকই বেশি পছন্দ করে।
আমরা মনেপ্রাণে তাই বিশ্বাস করতে চাই যে, দেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, দেশে মাইনাস টু হওয়ার সম্ভাবনা (নাকি আশংকা?) শেষ হয়ে গিয়েছে। সেটি আমাদেরও বিশ্বাস। কিন্তু দেশের চলমান রাজনীতির যে হাল তাতে করে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর নিশানা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। জনগণের উদ্বেগটা এখানেই।
দেশের আপামর জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে কোনো রাজনীতি চলতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে তা-ই হচ্ছে।
রাজনীতিই একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে সংলাপের মাধ্যম সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে সংলাপের কোনো মানসিকতাই গড়ে ওঠে নি। সংলাপ ছাড়া মতপার্থক্য দূর হবে না।
মহামতি ভল্টেয়ার একটি কথা বলেছেন, ‘‘I may disagree with you, but I shall defend to the death to protect your right to disagree’’-এটিই গণতন্ত্রের মূল কথা। আমাদের রাজনীতিকদের এর মর্মার্থ উপলব্ধি করা জরুরি। তা না হলে জনগণের মুক্তি নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর