ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মৌলিক গানও গাইবো: সোহিনী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৩
মৌলিক গানও গাইবো: সোহিনী ছবি: জীবন আমীর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত `আমার সোনার বাংলা` গানের নতুন একটি মিউজিক ভিডিও নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া জগতে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে ইংল্যান্ড`ক্ষ` ব্যান্ড দল।

তবে শুধু রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোনো শিল্পী নয়, এক সময় নিজের রচনা ও সুরেও বাংলা গান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ‘ক্ষ’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সোহিনী আলম।



তিনি বলেছেন, হয়তো এক সময় নিজেরও মৌলিক বাংলা গান হবে। হয়তো শ্রোতাপ্রিয়তা অর্জন করবে, আবার হয়তো করবে না।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত `ক্ষ` ব্যান্ড দলের সোহিনী আলম শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলানিউজের লাইভ আড্ডায় এমনটাই আশা প্রকাশ করেন।

সঙ্গে ছিলেন মিউজিক ভিডিওটির পরিচালক শাহরিয়ার রহমান। এ ছাড়াও জমজমাট এ আড্ডায় অংশ নেন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী শাহেদ এবং প্রীতম।

আড্ডায় আরও অংশ নেন বাংলানিউজের কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার, হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, ওয়েব এডিটর জিকরুল আহসান শাওন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাজেদুল নয়নসহ আরও অনেকেই। সঞ্চালনায় ছিলেন বাংলানিউজের অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর মারিয়া সালাম।

আলোচনায় জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে তৈরি মিউজিক ভিডিওটির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে দীর্ঘসময় ধরে। তবে রবীন্দ্রনাথের `আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...` গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশনের জন্যে গাওয়া হয়নি বলে দাবি করেন সোহিনী।

রবীন্দ্রনাথ সর্ম্পকে তিনি বলেন, `যারা এখন রবীন্দ্রনাথ সর্ম্পকে বলছেন তারা কেউই তাকে দেখেন নি।
রবীন্দ্রনাথ কি ভাবতেন এটা কেউ জানে না। `

তবে সোস্যাল মিডিয়ায় গানটি নিয়ে এতো আলোচনা ও সমালোচনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কথা জানালেন সোহিনী।
তিনি বললেন, এতে হয়রান বোধ করছি আবার আনন্দও লাগছে।

আড্ডার প্রথমেই ব্যান্ডের নাম `ক্ষ` করণের গল্পটি শোনান সোহিনী।

তিনি জানান, ২০০৭ সালে থেকেই ইংল্যান্ডে তাদের দলটি গান করে আসছে। দলটিতে তিনি ছাড়া এ দলের অন্য সব সদস্যই ব্রিটিশ। ২০০৮ সালের দিকে তারা চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেন একটি নতুন দল করার। যেহেতু বাংলা গান করবে বলে ঠিক করে দলটি, তাই বাংলা নামই খুঁজছিলেন। তবে যেহেতু ব্যান্ডের অনেক শ্রোতাই বাংলাদেশি নন, তাই ভালো একটি নাম খুঁজতে গিয়ে পছন্দ হয় `ক্ষ`। এটি একটি বাংলা যুক্ত বর্ণ।

`যেহেতু আমাদের ব্যান্ড বাংলা গানের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন মিউজিককে যুক্ত করেছে—প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে তাই এ যুক্তাক্ষরটিকেই বেছে নিই,` বলেন সোহিনী। February

বাংলা ব্যান্ড গড়ে তোলার কারণ হিসেবে নিজের পরিবার থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ ব্রিটিশকন্যা। চমৎকার বাংলায় তিনি জানান, `আমার মা-খালারা গান করতেন এবং করেন। আমার বয়স যখন নয় তখন আমি বাংলাদেশে আসি এবং ৭ বছর ছিলাম। যৌথ পরিবারে বাস করাতে এবং পরিবারে সঙ্গীতচর্চা থাকাতে আমি বাংলা গানকে ভালবাসি। এরপর আমি যেখানেই যাই বাংলা গান গাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি যখন একবার নিউইয়র্কে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম, সেসময় বাংলা গান গেয়েছি। `

নিজের ব্যান্ড দলের সদস্যদের যোগ্যতা ও দক্ষতা সর্ম্পকে সোহিনী জানান, অলিভার এবং ভ্যান দুজনেই মিউজিকের ওপর পড়াশোনা করেছে। তারা বাংলা মিউজিকেও দক্ষ। বর্তমানে মৌসুমী ভৌমিকের সঙ্গে কাজ করছে ওরা। অলিভার মিউজিক নিয়ে ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করেছে এবং ভারতে অনেকদিন থেকে বাউল সঙ্গীতের ওপর পিএইচডি করেছে।

বাংলাভাষাকে ভালবাসেন সোহিনী। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তার আগ্রহ রয়েছে জানান সোহিনী। তবে তার কন্ঠে গাওয়া বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর ও তালের যে সমালোচনা উঠেছে সে ব্যাপারে তিনি বলেন, `এতো কিছুতো চিন্তা করি নি। ইতিবাচক কিনা সেটাও ভেবে দেখি নি। তবে এ সুরে গান গাওয়ার প্রতিক্রিয়া কতটুকু হতে পারে সকলের মতোই তিনিও দেখার অপেক্ষা করছেন বলে জানান। `

বাংলা গান গাওয়ার পেছনে বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ কোন দায়বদ্ধতার উল্লেখ করেননি সোহিনী। তার ভাষায়, `শিল্পীকে আগে নিজের কাছে দায়বদ্ধ হতে হবে। আমি যদি আগে নিজের প্রতি দায়বদ্ধ না হই তবে অন্যের প্রতি কি করে দায়বদ্ধ হবো!`
তিনি বলেন, `বাংলা আমার বাবা-মায়ের ভাষা। এ ভাষার প্রতি তার ভালোবাসা রয়েছে। ` তিনি যখন যেখানে থাকেন বাংলা গানকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন বলে জানান।

তবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতকে বিকৃত ভাবে তুলে ধরার আইনত বিধি নিষেধ তুলে ধরেন মাহমুদ মেনন। পাঠকদের বিভিন্ন মেইল এবং তথ্য থেকেই জাতীয় ‘সঙ্গীতে বিকৃতি! `ক্ষ`র স্পর্ধা প্রতিহত এখনই’   শীর্ষক  রিপোর্টটি করা হয় এবং এ ব্যাপারে বাংলানউজের নিজস্ব কোন মত ছিলনা বলে জানান তিনি। সোহিনীকে নিজের মৌলিক গান গাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে সোহিনী গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গেয়েছেন কিনা জানতে চাওয়া হয়।

সোহিনী জানান, ‘আমরা কোথাও বলি নি এটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। আমাদের স্পষ্ট বলা ছিল, ‘Tagore Song: Amar sonar bangla ami tomay valobasi...’

`ক্ষ` ব্যান্ডের গাওয়া `আমার সোনার বাংলা..আমি তোমায় ভালোবাসি` রবীন্দ্রসংগীতটির মিউজিক ভিডিও তৈরি করেছেন গ্লাসগোতে পড়াশোনা করা বাংলাদেশের ছেলে শাহরিয়ার রহমান।

তিনি জানান, গানটির প্রতি মমত্ব থেকেই এবং `ক্ষ` ব্যান্ডের মিউজিকে গানটি শুনে তার ভালো লেগেছিল। সে কারণেই এ মিউজিক ভিডিওটি তৈরি করেন তিনি।

সঙ্গীতশিল্পী শাহেদ বলেন, সোহিনী যে কাজটি করেছেন তা এক কথায় অসাধারণ। শ্রোতার কাছে ভাল লাগাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। গানটিতে সুর, তাল ও লয়ের ব্যাবহারও ভাল বলে জানান তিনি।
জুয়েল মাজহার নিজেও সোহিনীর গান শুনে মোহিত বলে জানান। তিনি বলেন, তবে  রবীন্দ্রনাথের গান মূলত বাণীপ্রধান। তার গানের ভাবটাও বাণীবাহিত। বাণী ও ভাবকে আশ্রয় করেই রবীন্দ্রগানের সুরের বাঁধন আর বিস্তার। এ-গান কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ বা যন্ত্রনির্ভর নয়।

তিনি বলেন, নিজের রচিত ও সুর করা গান ভবিষ্যতে বিকৃত হতে পারে এ আশংকা হয়তো রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যন্ত্র এসে বা যন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার (যা এখন ঢালাওভাবে হচ্ছে!) তার গানের মূল বাণীকে ছাপিয়ে, এর ভাবকে ছাপিয়ে, গৌণ করে দেবে এর মূল মর্ম ও আবেগ--- এর অন্তরের সুর ও আততি। February

আহমেদ রাজু জানান, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’ গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের সময় রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখেন। এবং পরবর্তীকালে এটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এরপর থেকে গানটির প্রতি মানুষের অনেক আবেগ এবং ভাব। এ ব্যাপারে সোহিনীর মত জানতে চান তিনি।
সোহিনী একই উত্তর আবারো জানান, ‘এটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশন করি নি। ’

জুয়েল মাজহার জানান এ গানটির সুর গগন হরকরার। তবে রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের সুরই চার্চ সঙ্গীত থেকে নেয়া হয়েছে বলে তিনি এবং শাহেদ একমত হন।

যারা সোহিনীর গলায় রবীন্দ্রনাথের গান ভিন্ন সুরে শুনতে পেয়ে বিরূপ মত দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্য করে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যান্ড দল ‘ক্ষ’ এর ভোকালিস্ট সোহিনী আলম বলেন, ``ইট’স দ্য বিগিনিং। ``

তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ``তিনি (রবীন্দ্র) যদি আইরিশ ড্রিংকিং সং (সুরাপানগীতি) থেকে সুর নকল করতে পারেন, তাহলে আমি কেন করতে পারবো না?``
একই সঙ্গে বর্তমানে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ও লালন গীতিসহ ঐতিহ্যবাহী চিরায়ত বাংলাগান নিয়ে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।

তাকে ও তার গাওয়া গান নিয়ে চলমান সমালোচনার ব্যাপারে তিনি বলেন, `আমি নিজে শুধু জানি কি মনে করে আমি গানটি গেয়েছি। একজন শিল্পী তার শিল্প সৃষ্টি করতে গিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করে সৃষ্টি করবে না। `
সঙ্গীতশিল্পী প্রীতম অবশ্য উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তিনি এক একজনের কাছে এক এক রকম। এমনও হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ নিজে সোহিনীর গান শুনতে পেলে খুশিই হতেন। শুধুমাত্র জাতীয় সঙ্গীত দেশপ্রেম দেখানোর জায়গা নয়।

বাংলানউজের রিপোর্টটিতে যারা সোহিনীর সমালোচনা করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করেন। সরকার ছাড়া অন্য কউ সোহিনীর কাছে গানের জন্যে জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার নেই বলেও জানান তিনি
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী সরকারের দেয়া বাড়িতে থেকে এক রাজাকারের কোম্পানির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যখন গান গায় তখন দেশপ্রেম কোথায় থাকে?
আড্ডার শেষ দিকে দর্শকদের জন্যে ‘ক্ষ’ এর গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা...’ গানটি বাজানো হয়। এ সময় সোহিনী প্রশ্ন করেন, ‘এখন এটা শুনেও কি দাঁড়াতে হবে?’।

উপস্থিতরা আশ্বস্ত করলে সকলে বসেই গানটি উপভোগ করেন।
তবে রানা রায়হান রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভিন্নমত পোষন করেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন সেটি জানা যায় না এটি সত্য নয়। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা পড়েই তো রবীন্দ্রনাথকে চেনা যায়।

বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের মুখ থেকে নিজের গাওয়া গানের সমালোচনা শুনে আহত বোধ করেছেন সোহিনী। বলেছেন, `কি শোভা, কি ছায়াগো...` থেকে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হলে তা যদি রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল হয়, তবে ‘তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ বারবার নিতে প্রস্তুত রয়েছেন।

বাংলাদেশের যেসব বরেণ্য রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী ‘ক্ষ’ ব্যান্ডের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা..’ গানটির সমালোচনা করেছেন, তাদের যুক্তি ও পরামর্শগুলোকে বিবেচনায় নেয়ার জন্যে সোহিনীর প্রতি অনুরোধ জানান মাহমুদ মেনন। সোহিনীকে ভবিষ্যতে মৌলিক বাংলা গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

মারিয়া সালাম জানান তিনিসহ সকলেই সোহিনীর এ গানটি শুনে মোহিত হয়েছেন এবং খুবই ভাল লেগেছে।
সবশেষে এক পাঠকের প্রশ্নের জবাবে সোহিনী জানান, তার বাবার বাড়ি খুলনার খালিশপুরে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর; নূরনবী; [email protected];জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।