ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

নিষিদ্ধ ডোরেমন কার্টুনের প্রভাব ভয়াবহ

হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৩
নিষিদ্ধ ডোরেমন কার্টুনের প্রভাব ভয়াবহ

ঢাকা: মা, মুঝে এক চকলেট খিলা দো; ডোরেমন তুম কাহা—এসব কথা ইদানিং আর রাস্তাঘাটে অপরিচিত নয়। বিশেষ করে শিশুদের আনাগোনা আছে, এমন বেশিরভাগ জায়গাতেই দেখা যাবে বাবা-মায়ের কাছে সাধারণ চকলেট-চিপস কেনার আবদারেও ভাঙাচোরা হিন্দি বলছে শিশুরা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো বাবা-মা হাসিমুখে পছন্দের জিনিসটি কিনে দিচ্ছেন শিশুকে। কিন্তু একবার ভেবেও দেখছেন না, কেন এই সাধারণ আবদারটি করতে ভিন্ন ভাষার আশ্রয় নিল তার পাঁচ বছর বয়সী শিশু?

একই সঙ্গে আরেকটি ঘটনা মেলানো যায়। গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকার যে কোনো বাজারে ‘ডোরেমন’ নামে নীলরঙা এক নাদুস-নুদুস খেলনা বিড়ালের আনাগোনা বেড়ে গেছে। বাচ্চাদেরও যেন এই বিড়াল চুম্বকের মতো কাছে টানছে। এরই সুযোগে পুতুল থেকে শুরু করে পেনসিল, জামা-কাপড়, ব্যাগ এমন কিছু নেই যাতে তার উপস্থিতি নেই। এমনকি সর্বশেষ চালু হয়েছে ‘ডরিমন স্কুল’ পর্যন্ত!

বিখ্যাত জাপানি কার্টুনিস্ট ফুজিকো ফুজিওর ‘মাঙ্গা’ ধাঁচের এই কার্টুনটি প্রথম কমিকস আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ১৯৭৩ সালে প্রথম একে অ্যানিমেশন কার্টুনে রূপ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০৫ সালে আরও দুই ধাপে এর দুটি কার্টুন সিরিজ তৈরি করা হয়। জাপানি ভাষাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব হিসেবে ২০০৮ সালে এটি জাপান সরকারের পুরস্কার পায়।

ডোরেমন মূলত ভবিষ্যতের একটি বিড়াল আকৃতির রোবট, যে ২০২২ সাল থেকে অতীতে (অর্থাৎ বর্তমান সময়ে) এসে নোবিতা নোবি নামে এক অলস ছেলেকে সঙ্গ দিচ্ছে। ডোরেমনকে অতীতে পাঠিয়েছে নোবিতারই ভবিষ্যত নাতি সেওয়াসি, যে কিনা ভবিষ্যতে খুবই কষ্টের সময় কাটাচ্ছে। ডোরেমনের গায়ে একটি পকেট আছে, যেখান থেকে সে দারুণ দারুণ সব জিনিস বের করতে পারে। তবে নোবিতা বেশ দুষ্ট প্রকৃতির, সে বরাবরই ডোরেমনের সাহায্যকে কাজে লাগিয়ে দুষ্টুমি করতে চায়, ফাঁকি দিতে চায়। ডোরেমন তাকে অলসতা, দুষ্টুমি ছেড়ে ভালো ছেলে হওয়ার পরামর্শ দেয়। কাহিনীতে নোবিতার আরও সঙ্গী থাকে তার দুই বন্ধু জিয়ান ও সোনিও।

এই হচ্ছে মোটামুটি কাহিনী, এখানে শিশুদের সবচেয়ে আকৃষ্ট করে ডোরেমনের নোবিতাকে যে কোনো সময় সাহায্য করার ব্যাপারটি।

শিশু সমাজে কার্টুনের প্রভাব নতুন কিছু নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই উপকারি। টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউস, পাপাই দ্য সেইলর, বাগস বানি যুগ যুগ ধরে শিশুদের নির্মল আনন্দ দিয়ে এসেছে, তাদের নিয়ে গেছে রূপকথার এক জগতে। কিন্তু ডোরেমনের ক্ষেত্রে চিত্রটা কিছু ভিন্ন। শুধু শিশুর মনোজগত নিয়ে নড়াচড়ার পাশাপাশি এটি তাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি কিছু। যার আজকের রূপ শিশুদের মুখে, ‘চকলেট খিলা দো,’ ‘মা কুছ ইন্তেজার কারো’ ইত্যাদি।

কেন হঠাৎ এই হিন্দির আগ্রাসন? কেন পাঁচ বছরের শিশু থেকে ১২-১৩ বছরের বালক-বালিকারা পর্যন্ত অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে পড়ছে পড়ছে হিন্দির দিকে? ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে গর্বিত যে জাতি, তার জন্য এটি কতো বড় অপমান তা কী কেউ ভেবে দেখেছে? কেমন লাগতো ভাষা শহীদদের, যদি তারা দেখতেন বাচ্চারা শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে বলছে, ‘মা, ইতনা গর্মি হ্যায় আজ!’

শিশুদের নয়, এর জন্য দোষারোপ করতে হলে শিশুদের বাবা-মাকেই করতে হবে। দশ বছর আগে ‘কুসুম’, ‘কাহানি ঘর ঘর কি’, ‘জেসি জ্যাইসি কোই নেহি’ সিরিয়াল দিয়ে যে সংস্কৃতি তারা শুরু করেছিলেন, তারই আরেক রূপ ডোরেমন নিয়ে শিশুদের সামনে এখন হাজির হয়েছে হিন্দি চ্যানেলগুলো। শিশুরা আগে-পরে না ভেবে সেটাই দেখতে শুরু করে, যা তাদের ভালো লাগে। কিন্তু সেই দেখা কতোটুকু সুস্থ, রুচিশীল ও যৌক্তিক, সেটা বোঝার দায়িত্ব অভিভাবকদেরই।

এর আগে শিশুরা হিন্দি শিখতো, যখন মা-খালারা বাসায় টুকরো টুকরো গল্প করায় সময় হিন্দি শব্দ জুড়ে দিতেন। এখন আর তার প্রয়োজন হচ্ছে না। ডোরেমন থেকেই তারা পেয়ে যাচ্ছে হিন্দি ভাষার দাঁড়ি-কমা-সিলেবাস, শিখে নিচ্ছে অকপটে। চার বছরে বয়সের শিশুর মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ভাঙা ভাঙা হিন্দি, যা আর বছর তিনেকের মধ্যেই বেশ সড়গড় হয়ে উঠবে। আর অভিভাবক নিজেই যেখানে হিন্দি সিরিয়াল গলধ:করণে ব্যস্ত, সেখানে যে তার সন্তানের প্রতিটি বাক্যেই একটি-দুটি করে হিন্দি ঢুকে পড়ছে তা খেয়াল করার সময় কোথায়? এমনকি অনেক অভিভাবক খেয়াল করলেও একে নেতিবাচক কিছু মনে করছেন না, উলটো সন্তানের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন, ‘সাবাস বেটা, ইতনে আচ্ছা হিন্দি কাঁহাসে শিখায়ে!’

স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা প্রথম বয়সে যা শেখে তা তাদের মনে গেঁথে যায়। তাই এই হিন্দিপ্রিয়তা থেকে একটু বড় হলেই তারা বেরিয়ে আসতে পারবে, এমন ভাবা ভুল। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রুচি বদলে ডোরেমনের স্থান করে নেবে হিন্দি সিরিয়াল। হিন্দি সিরিয়ালের সঙ্গে অবধারিতভাবে হিন্দি সংস্কৃতি। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, এই সংস্কৃতি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, এখানে আর ভবিষ্যতকাল ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। বরং এই সংস্কৃতি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে পরগাছার মতো ঢুকে ধীরে ধীরে আরও গভীরে স্থান নিচ্ছে- এমনটা বলাই শ্রেয়।

ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ডোরেমনের একটি প্রবল মানসিক প্রভাবও আছে শিশুদের ওপর। যাকে আজকাল বলা হচ্ছে ‘ডোরেমন ইফেক্ট’ কিংবা ‘ডোরেমন কমপ্লেক্স’।

এর ফলে নিজেকে নোবিতার জায়গায় কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। তারা প্রতি মুহূর্তে আশা করছে, ডোরেমনের মতো কোনো দয়ালু বিড়াল এসে তার হোমওয়ার্ক করে দেবে, টিচারকে ফাঁকি দিতে সাহায্য করবে, কেউ ঝগড়া করতে এলেই তাকে শায়েস্তা করবে, আম্মু বকা দিলে আম্মুকে উলটো ‘মজা’ দেখাবে। আর যেহেতু ডোরেমন বাস্তবে নেই, তাই অনেক ক্ষেত্রেই এই ‘ফাঁকি’ মারার কাজগুলো নিজেরাই সেরে নিচ্ছে শিশুরা।

ডোরেমন ইফেক্টের সঙ্গে হিন্দি ভাষার প্রভাব যুক্ত হয়ে সমস্যা আরও জটিল করে তুলছে। শিশুরা ভাবছে, নোবিতা-ডোরেমন যেহেতু হিন্দিতে কথা বলে, তাই সেটাই আদর্শ।

মৌরি (ছদ্মনাম) নামে সাত বছর বয়সী এক শিশুর কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ডোরেমনের অন্ধভক্ত সে, ইতোমধ্যে হিন্দি ভাষাশিক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ডোরেমনের পাশাপাশি মায়ের পাশে বসে একটু-আধটু ‘মধুবালা’ দেখাও শুরু করেছে সে। বাংলার সঙ্গে হিন্দির বেশ কিছু মিল ধরা পড়েছে তার চোখেও। সেখান থেকে সে মনে করছে, হিন্দি বাংলারই কোনো ‘আপডেট’ ভার্সন, বাংলা সে তুলনায় অনেক ‘ব্যাকডেটেড’।

পাপ্পু (১০) নামে আরেক শিশুর মতে, বাংলায় কার্টুন সম্ভবই নয়! মীনা কার্টুন তার কাছে ‘বোরিং’। হিন্দিকে সে অনেক ‘রিচ’ মনে করে, ঠোঁট উলটে জানায়, বাংলায় কখনো ভালো কার্টুন তৈরি হলে দেখবে।

ভালো সংবাদ হলো, সরকার ইতোমধ্যে ডোরেমনের ফলে হিন্দির এই আগ্রাসন বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে, ইতোমধ্যে ডোরেমন সম্প্রচারকারী চ্যানেলগুলোও বন্ধ করেছে।

তবে বর্তমানে ডোরেমন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে, রাতারাতি এটিকে বন্ধ করে দিলে অনেক শিশুরই নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কেউ কেউ আবার আন্দোলনে নেমে যেতে পারে ফিডার হাতে! আর আজকের যুগে কোনো চ্যানেল বা ওয়েবসাইট বন্ধ হওয়া মানেই পুরোপুরি বন্ধ নয়, কৌশল খাটিয়ে কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিমেষেই আগের মতো ডোরেমন দেখতে পারে শিশুরা। অনেক বাবা-মাও চাইবেন শিশুকে ডোরেমন থেকে বঞ্চিত করে কষ্ট না দিতে, তাই তাই টিভি বক্স বসিয়ে বা আইপি টিভির ব্যবস্থা করে দেবেন নি:সংকোচে।

বর্তমানে বিশ্বের ৬২টি দেশে ডোরেমন সম্প্রচারিত হচ্ছে, কিন্তু বেশিরভাগ দেশেই নিজ নিজ ভাষায়। সেই উদ্যোগ বাংলাদেশেও নেওয়া কঠিন কিছু নয়। এতে একদিক দিয়ে যেমন মাতৃভাষায় প্রিয় কার্টুনকে দেখতে উৎসাহী হবে শিশুরা, তেমনি হয়তো কার্টুনটির ভালো দিকগুলো থেকেও শিক্ষা নেবে। এখানে বলা প্রয়োজন যে ডোরেমনের বিভিন্ন পর্বে শিক্ষণীয় ব্যাপার থাকলেও হিন্দি না বোঝার কারণে শিশুরা অনেক সময় সেগুলো ধরতেও পারে না। বরং সেদিকেই তারা ঝুঁকে পড়ে, যেটা বেশি ‘ইন্টারেস্টিং’ মনে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হোমওয়ার্ক না করার জন্য ডোরেমন যে নোবিতাকে নিন্দা করে তা কিন্তু প্রায় কোনো শিশুই খেয়াল করে না, তাদের মাথায় ঢুকে যায় হোমওয়ার্ক না করার অংশটি।

তবে শুধু বাংলা করাতেই থেমে থাকলে চলবে না। কার্টুন আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শিশু সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে কার্টুনের গুরুত্বকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। একসময় মীনা কার্টুন দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সেই মীনার মতোই কোনো শিক্ষামূলক কার্টুনকে যুগোপযোগী করে তৈরি করা যেতে পারে। কিংবা সাম্প্রতিককালের সিসিমপুরের মতো শিশুদের উপযোগী অনুষ্ঠানের সংখ্যা আরও বাড়ানো যেতে পারে, যাতে আনন্দের খোঁজে শিশুদের বারবার বিদেশি চ্যানেলগুলোর কাছে ছুটে যেতে না হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৩
আরআর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।