ঢাকা: পোশাকশিল্প এখন এক ক্রান্তিকাল পার করছে। একের পর এক হরতালে এই খাতটি দারুণ সংকটে পড়েছে।
দেশে এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের গ্রাহকরা অন্য দেশে চলে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাজরীন ফ্যাক্টরীতে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পর থেকেই বিদেশি ক্রেতারা এদেশের পোশাকশিল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে নতুন করে ভাবছেন। এই অবস্থায় সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় একের পর এক মানুষ নিহত হওয়ার পরিস্থিতি বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক করে তুলছে। একের পর এক অর্ডার বাতিল হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সময়মতো পোশাক তৈরির কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে বিলম্বিত হচ্ছে পোশাক রপ্তানি। এতে অনেক শিপমেন্ট বাতিল হয়েছে। গত কয়েক দিনের হরতালে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাকের স্টক লট হয়েছে বলে জানায় বিজিএমইএ সূত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পোশাকশিল্প কারখানার মালিক বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমার কারখানার একটি অর্ডার সাপ্লাই করার কথা ছিলো। হরতালের কারণে উৎপাদনে সময় বেশি লেগেছে। তাই নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদন কাজসহ শিপমেন্ট সম্পর্কিত অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে পারিনি। এতে অর্ডার বাতিল হয়েছে। সাড়ে চার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা ছিলো, যা এখন স্টক লটে পরিণত হয়েছে। এখন এসব পণ্য খোলা বাজারে ৮০ শতাংশ কম দামে বিক্রি করতে হবে। কিভাবে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবো আর কিভাবে কারখানা টিকিয়ে রাখব সে চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তবে হরতালে চট্টগ্রাম স্থল বন্দরের কাজে তেমন কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি বলে জানিয়েছেন বন্দরের সচিব ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলানিউজকে জানান, হরতালে বন্দরে মালামাল ওঠানামার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। আর কোনো শিপমেন্টও বাতিল হয়নি। ’
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৬শ’ কন্টেইনার ওঠানামা করলেও হরতালে তা কমে আসে। হরতালের দিনগুলোতে গড়ে প্রায় ১২শ’ কন্টেইনার ওঠানামা করে।
স্টক লটের বিষয়ে বিজিএমইএ-এর কাছে কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই বলে জানায় বিজিএমইএ।
বিজিএমইএ-এর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এটি পোশাক শিল্পের জন্য আত্মঘাতী হওয়ার পূর্ব সংকেত। এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর হওয়ায় হরতাল হলেই আমদানিতে সমস্যা হয়। অন্যদিকে হাইরিস্কের কারণে শিপমেন্ট ঠিক মতো করতে পারেন না মালিকরা। ফলে ক্রেতারা আমাদের ওপর থেকে আস্থা হারাতে বসেছে।
আর যখন শিপমেন্ট ঠিক সময়ে না করতে পারে তখন সে পণ্য স্টক লট হয়, যা এ শিল্পের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ স্টক লট হওয়া পণ্য ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কম দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হয় মালিকদের। একদিনের হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্যে তিন হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এসব হরতাল দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ দেশের অর্থনীতি।
সম্প্রতি অস্থিরতার কারণে বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে না। এতে অনেক অর্ডার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতি (ইএবি) সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, স্টক লট পোশাকশিল্পের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি খুব সাধারণ ভাবেই বোঝা যায় যে, মালিকরা বিনিয়োগ করে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে না। ফলে আয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর স্টক লট বিক্রি করে যা আয় হয় তা খুবই নগণ্য। কোন রকম বিক্রির জন্যই তা বিক্রি করা হয়। এটি এ শিল্পের এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি অশনি সংকেত। আর সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বর্হি:বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আর আমাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে কিনা, তা যদি পুনর্বিবেচনা করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে বিদেশি ক্রেতারা মিয়ানমারকে ভাবছেন বলে জানা যায় বিজিএমইএ-এর একটি সূত্র থেকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের নানা অস্থিরতা ও মিয়ানমারের কম মজুরিকে অর্ডার দানের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে ক্রেতারা। আগামী পাঁচ বছরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হলে শিল্পটি একটি বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের অর্থনীতির ৭০ ভাগই এ পোশাকশিল্পের সাথে জড়িত। রপ্তানি আয়ে পোশাক শিল্পের অবদান উল্লেখযোগ্য। বিজিএমইএ’র হিসাব মতে, দেশের রপ্তানির ৭৮ শতাংশই আয় হয় এ শিল্প থেকে। মোট জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আসে পোশাকশিল্প খাত থেকে। দেশের প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে পোশাকশিল্প কারখানাগুলোতে। তাই এই শিল্পের বাঁচানোর উদ্যোগ না নিলে ধস নামতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশেজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৩
ইউএম/সম্পদানা: আহমেদ রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর