ঢাকা: আগামী ২৭ মার্চ খাদ্য অধিদপ্তরের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটির (এফপিএমসি)সভায় বোরো ধানের মূল্য নির্ধারণ করা হবে। সভায় বোরো ধানের মূল্য নির্ধারণ, বোরো সংগ্রহের পরিমাণ ও কোন সময় পর্যন্ত এই ধান সংগ্রহ করা হবে সেই তারিখও ঠিক করা হবে বলে খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়।
বোরো ধানের উপর এসব সিদ্ধান্তের বিষয় নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন চাষীরা। কারণ গত বোরো মৌসুমের চেয়ে এবার বিঘা প্রতি প্রায় দ্বিগুণ খরচ গুণতে হয়েছে চাষীদের। তাই বোরো ধানের মূল্য কম পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
বোরো চাষের শুরুতে ঘন ঘন লোডশডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন বোরো চাষীরা। চাষীরা বলছেন, বেশি মূল্যে চারা কেনা, বোরো চারা রোপণের বাড়তি খরচ ও বাড়তি মূল্যে সার ও কীটনাশক খরচ করার পর ডিজেল দিয়ে সেচ কাজ চালানো সম্ভব নয়।
বোরো জমিতে প্রতিদিন তেলের ঘানি টানতে গিয়ে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বিপাকে পড়েছেন দেশের বোরো চাষীরা। চাষীদের প্রতি লিটার ডিজেল ৭০টাকা মূল্যে কিনতে হচ্ছে। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি, লোডশেডিং ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বোরো আবাদে সেচ সংকটে পড়েছেন চাষীরা। সেই সঙ্গে খরচের তুলনায় বোরো ধানের মূল্য কম পাওয়ার আশঙ্কাও দানা বেঁধেছে চাষীদের মাঝে।
দিনাজপুর, বগুড়া, যশোর, ফরিদপুর, পঞ্চগড়সহ দেশের বোরো চাষ প্রবণ এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। অনেক এলাকায় দেখা গেছে বোরো জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য দিনে বিদ্যুৎ থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে গভীর রাতে সেচ কাজ করতে হয়। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বোরো চাষীদের এ পদ্ধতি বেছে নিতে হয়।
দিনাজপুর সদর উপজেলার শিবরামপুর এলাকার কৃষক সেলিম রেজা বলেন, “এবার বছরের শুরুতে সরকার ডিজেলের মূল্য বাড়িয়েছে। এতে করে প্রতি একরে কৃষকদের বাড়তি দেড় থেকে ২ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। ”
যদি ধানের সঠিক মূল্য পাওয়া যায় তবে খরচ হলেও ক্ষতি নেই বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “গতবার যে পরিমাণ খরচ হয়েছিল সে তুলনায় মূল্য পাওয়া যায়নি। ”
তিনি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
দক্ষিণনগর এলাকার বেনু রাম সরকার জানান, “বোরো আবাদ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। দিন দিন এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়তে থাকলে কিভাবে আবাদ করব?” এমন প্রশ্ন রাখেন সংশ্লিষ্টদের কাছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের কৃষক তাপস চন্দ্র দাস বলেন, “এ এলাকার একটি সমস্যা আছে। সেটি হলো পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। এখনই পাম্পগুলোতে ভালোভাবে পানি উঠছে না। আর কিছুদিন গেলে গর্ত করে পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলতে হবে। এমনিতেই ডিজেলের বেশি মূল্য ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের পর যদি পাম্পে পানি কম ওঠে তাহলে কৃষক কি করবে?”
এদিকে ধানের মূল্য কম পাওয়ায় এবারে অনেক কৃষক বোরো আবাদ করেন নি। তারা একই জমিতে অন্য ফসল
আবাদ করেছেন। ফলে এবার কমে গেছে বোরো আবাদ।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বারাইহাট গ্রামের কৃষক পরেশ চন্দ্র দাস বলেন, কৃষকরা জমিতে খরচ বেশি করলেও সে তুলনায় দাম পান না। এতে তাদের লোকসান গুণতে হয়।
তিনি বলেন, “গত বছর আমি ৪ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলাম। কিন্তু এবার আমি আড়াই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছি। ধানের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে অন্য ফসল আবাদ করছি। ”
বোরো আবাদ কমে গেছে এ কথা স্বীকার করে দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনোয়ারুল আলম বলেন, চলতি বছর দিনাজপুরে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন। তবে এবার গত বছরের তুলনায় আবাদ কম হবে।
আরও বিপাকে পড়েছেন মেহেরপুরের বোরো চাষীরা। তারা বলছেন, প্রতিকেজি ইউরিয়া সার কিনতে হচ্ছে ২১ টাকা, গুটি দানা ৩২ টাকা, ১০০ মিলিলিটার কীটনাশক ১২৫ টাকা এবং প্যাকেটজাত দুই কেজি সালফেট কিনতে হচ্ছে ৩শ’ ৪০ টাকায়। বোরো চারা রোপণের সময় বিঘা প্রতি চারা কিনতে হয়েছে তিন হাজার টাকার।
সব মিলিয়ে বোরো চারা রোপণের একমাসের মাথায় বিঘা প্রতি ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা। এছাড়া ডিজেল পুড়িয়ে বোরো চাষে দিশেহারা এসব কৃষক। তবে বোরো ধানের মূল্য যদি আশানুরূপ না পাওয়া যায় তবে লোকসান গুণতে হবে তাদের। আর যদি বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২২ মণ ধান হয় এবং মূল্য যদি মণ প্রতি ৮শ’ টাকা পায় তবে বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় হবে।
মেহেরপুরের গাংনী থানার ধলা গ্রামের বোরো চাষী মঞ্জুর হোসেন বলেন, “বৈদ্যুতিক মোটরে বোরো চাষে খরচ পড়বে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। আর ডিজেল পুড়িয়ে আরো এক হাজার টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে। ”
তবে যশোরের বোরো চাষীরা বলছেন, সরকার যেন বোরো ধানের যথাযথ মূল্য দেয়। যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া এলাকার কৃষক আলমগীর হোসেন জানান, তিনি ৭ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। শীতের কারণে দেরিতে আবাদ করলেও এখন পর্যন্ত ক্ষেতের অবস্থা ভালো। বিদ্যুৎ নিয়ে চিন্তা ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো সংকট দেখা দেয়নি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “প্রত্যেকদিনই ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এর মধ্যেও সেচ ব্যবস্থা টিকে আছে । তবে লোডশেডিং এই অবস্থা থেকে চেয়ে বেড়ে গেলে বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ”
যশোরের শার্শা উপজেলার ডিহি গ্রামের ফজলুর রহমান জানান, তিনি প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। মাঝে মধ্যেই বিদ্যুৎ নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। যেটুকু সময় বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে তাতে পুরো ক্ষেতে সেচের পানি ঢুকছে না। ”
শার্শা উপজেলার পাকশিয়া গ্রামের ময়না মিয়া বলেন, “সেচ নির্ভর বোরো আবাদ করতে গিয়ে এবার বিপদেই পড়তে হয়েছে। ডিজেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিঘাপ্রতি পানি সেচের খরচও বেড়ে গেছে। এখন প্রতি বিঘায় সেচ খরচ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে। ”
তবে ধানের মূল্য পাওয়ার ব্যাপারে সংশয়ে রয়েছেন তারা। তাদের মতে, ধান ওঠার পর যদি মূল্য পড়ে যায় তাহলে তাদের লোকসান গুণতে হবে। ৮শ’ টাকার কম ধানের মণ বিক্রি করতে হলে তারা লোকসানের মুখে পড়বেন।
তবে ফরিদপুর জেলার চাষীদের বিদ্যুৎ সমস্যা নেই। তারা সরকারের কাছে যথাযথ মূল্য চান।
খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ বিভাগ) মো. বদরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, “এখনও বোরো ধানের মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। ২৭ মার্চ নির্ধারণ করা হবে। এবার গতবারের চেয়ে বেশি দামে চাল সংগ্রহ করা হবে। বোরো ধানের চাল গতবারের চেয়ে কেজি প্রতি ১ টাকা বেশি দাম দেওয়া হতে পারে। ”
বদরুল হাসান আরও বলেন, “আমরা কত মেট্রিকটন বোরো চাল সংগ্রহ করবো সে বিষয়ে ২৭ তারিখে বিস্তারিত জানানো হবে। ”
বাংলাদেশ সময়: ০২৩২ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৩
এমআইএস/ সম্পাদনা: আসিফ আজিজ ও জনি সাহা, নিউজরুম এডিটর