ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মহাসেন: সঙ্কেত জেনে প্রস্তুতি, হ্রাস করবে ঝুঁকি

ইসমাইল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৩
মহাসেন: সঙ্কেত জেনে প্রস্তুতি, হ্রাস করবে ঝুঁকি

ঢাকা: গভীর সমুদ্রে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ক্রমেই উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। আর এ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

মহাসেনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তা উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সতর্কতা সঙ্কেত জেনে প্রস্তুতি নিলে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব।

ঝড়ের সময় সচেতন করে প্রস্তুতি নিতে আবহাওয়া অধিদফতর সাধারণত ১০ নম্বর পর্যন্ত সতর্ক সঙ্কেত ব্যবহার করে থাকে (দুর্যোগকোষ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, প্রকাশকাল-জুলাই, ২০০৯)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এএমএম আমানত উল্লাহ খান বাংলানিউজকে বলেন, “কতো নম্বর সঙ্কেতে কি হয়, তা জানা থাকলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারবেন। এতে ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। ”

গত শনিবার উপকূল থেকে এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূরে নিম্নচাপ সৃষ্টির পর একশ’ কিলোমিটার এগিয়ে তা ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেনে’ রুপ নেয়।

আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়, পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় ‘মহাসেন’ স্থির অবস্থায় রয়েছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে।

উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর। এছাড়া মংলায় ৫ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

বুধবার আবহাওয়া অধিদফতর এ ঘোষণা দেয়। মহাসেনের কেন্দ্রের ৫৪ কিমি’র মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিমি, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকট সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার এবং সমুদ্রগামী জাহাজসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দুর্যোগকোষ অনুযায়ী, ৪ নম্বর সঙ্কেত মানে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রিক ভয়াবহ ধরনের ঝড়ের পূর্বাভাস, যা উপকূল অঞ্চলসহ বিশাল অংশে আঘাত হানতে পারে।  

আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে এলে স্থাপিত ডপলার রাডারের মাধ্যমে জানা যাবে, কোথায়-কখন-কিভাবে আঘাত হানবে। বুধবার বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ”

প্রতি বছর এই সময়ে দেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা দেখা দেয়। সমুদ্র বন্দরের জন্য আবহাওয়ার সঙ্কেতগুলো হচ্ছে- ১ নম্বর দূরবর্তী সঙ্কেত, ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সঙ্কেত, ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত, ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত ও ৬ নম্বর বিপদ সঙ্কেত।

তবে ৮, ৯ ও ১০ নম্বর হলো মহাবিপদ সঙ্কেত।

উপকূল থেকে দূরে গভীর সাগরে ঝড় হলে ও চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার মতো বিপজ্জনক সময় না হলে চারটি (১-৪) সঙ্কেত ব্যবহার করা হয়। তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথে বিপদে পড়ার শঙ্কা থাকে।

৪ থেকে ৭ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত মানে বন্দর ছোট ও মাঝারি সামুদ্রিক ঝড়ে কবলিত হতে পারে। ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার।

৬ নম্বর বিপদ সঙ্কেতের সময় মাঝারি তীব্রতা সম্পন্ন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় মাঝারি ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করবে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও নদীতে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।

৮ থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার বেশি হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও নদীতে মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে। ৮ থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণার পর প্রচার মাধ্যমে প্রতি ৫ মিনিট পর পর প্রচার করতে হবে।

৮ নম্বর সঙ্কেতে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ থেকে ১১৭ কিমি, যা প্রচণ্ড তীব্রতা সম্পন্ন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়।

৯ নম্বর সঙ্কেতে  ১১৮ থেকে ১৭০ বেগে হারিকেনের তীব্রতা সম্পন্ন প্রবল ঘূর্ণিঝড় বিরাজ করবে। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দর এলাকা এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অতি তীব্র ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করবে।

১০ নম্বর সঙ্কেতের সময় অতি প্রচণ্ড তীব্রতা বিশিষ্ট বা সুপার সাইক্লোনের তীব্রতা বিশিষ্ট প্রচণ্ডতম সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দর এলাকায় অতীব তীব্র ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করবে। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭১ কিলোমিটার বা তার বেশি হবে।

২০০৭ সালের সিডরসহ কয়েকটি বড় ঘূর্ণিঝড়ের সময় ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত জারি করা হয়েছিল বলে জানান আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ।

৮, ৯ ও ১০ নম্বর সঙ্কেতের সময় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ দালান কোঠায় অনতিবিলম্বে জনসাধারণকে স্থানান্তর করতে হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাসমূহকে পূর্ণমাত্রায় প্রস্তুত থাকতে হবে এবং ইমারজেন্সি অপারেশন কেন্দ্রের সর্বশেষ নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

এর বাইরে ১১ নম্বর হলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সঙ্কেত। আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আয়েশা খাতুন জানান, ঝড়ের মাত্রা এতো বেশি হয়, যখন আবহাওয়ার বিপদ সঙ্কেত দেওয়া কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১ নম্বরে সামুদ্রিক ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১ থেকে ৬১ কিমি, ২ নম্বরে ৬২ থেকে ৮৮ কিমি এবং ৩ নম্বরে নদী ও সমুদ্র বন্দর এবং আশেপাশের এলাকায় ৪০ থেকে ৫০ কিমি। ৩ নম্বরের বেলায় উত্তর বঙ্গোপসাগর ও নদীতে চলাচলকারী ৬৫ ফুটের নিচে নৌকাযানগুলোকে অতি সত্ত্বর নিরাপদে আসতে বলা হয়। ১ ও ২ নম্বর সঙ্কেতে বন্দরত্যাগী জাহাজ পথে ঝড়ের মধ্যে পতিত হতে পারে, সেজন্য তাদের উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়।

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, ব্রিটিশ শাসনামলে বন্দরকে কেন্দ্র করে সঙ্কেতগুলো তৈরি হয়েছে। এছাড়া নদী বন্দরের জন্য চারটি (১-৪) সঙ্কেত রয়েছে।

সতর্কতা সঙ্কেতের বিষয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলম বলেন, “মহাসেনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত জারি করা হয়েছে। ”

চার থেকে সাত নম্বর পর্যন্ত দেওয়া সঙ্কেতে খুব ভয়ের কিছু নেই।

শাহ আলম বলেন, “৮ ও ৯ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত দিলে তখন জনসাধারণকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেবে আবহাওয়া বিভাগ। ”

মহাসেন নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকার ও আবহাওয়াবিদরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, “উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন প্রস্ততি কর্মসূচির (সিপিপি) ৪৯ হাজার ৩৬৫ জন প্রশিক্ষিত সেচ্ছাসেবক আগাম সতর্ক বার্তা প্রদানে কাজ করছেন। ”

মন্ত্রী বলেন, “তিন হাজার ৭৭০টি আশ্রয় কেন্দ্র কার্যকর রয়েছে। উপকূলীয় জেলায় অতিরিক্ত টাকা ও চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ওই এলাকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ”

“আতঙ্কিত না হয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে” বলেও জানান মন্ত্রী।

ড. আমানত উল্লাহ খান আরও বলেন, “ঘূর্ণিঝড় নিয়ে জনগণের মধ্যে কনফিউশন তৈরি না হলে বড় দুর্যোগ মোকাবেলা কঠিন হবে না। সেজন্য প্রয়োজন সতর্ক সঙ্কেত জেনে আগাম প্রস্তুতি। ”

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৩
এমআইএইচ/ সম্পাদনা: জনি সাহা, নিউজরুম এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।