মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজার শহর ও শহরতলী এলাকায় গত তিন সপ্তাহে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অভূতপুর্ব উন্নতি ঘটেছে।
ছিনতাই, চুরি ও চাদাঁবাজির ঘটনা নেমে এসেছে প্রায় শুন্যের কোঠায়।
বিষয়টি স্বীকার করে মৌলভীবাজার সদর মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুর রহমান শনিবার বাংলানিউজকে জানান, গত তিন সপ্তাহে মৌলভীবাজারে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসী-বখাটেরা নির্বাচনী মাঠে বিভিন্ন প্রার্থীর পে প্রচারণায় নেমে পড়ায় শহরে গত তিন সপ্তাহে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ছিনতাই বা চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেনি। ’
বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, উঠতি সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা মেয়র-কাউন্সিলরদের ডেরায় ভিরে পড়েছে। কারণ, এখানে রয়েছে বিনা ঝুঁকিতে পকেট ভরার সুযোগ।
এ পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য নিশ্চিত আয়ের পথ সৃষ্টি হয়েছে পৌর শহর ও আশপাশের এলাকায় বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণী ও বয়সের অন্তত দেড় হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষের।
প্রার্থীদের পোস্টার লাগানো, লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি দৈনিক মজুরির বিনিময়ে মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণায়ও অংশ নিচ্ছেন তারা।
পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নানা কৌশলে কর্মীখরচের নামে প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে টাকা তুলে দিচ্ছেন এইসব সিজনাল প্রচারকর্মীদের হাতে।
একই সঙ্গে সীমিত আকারে হলেও ভোট কেনাও চলছে গোপনে গোপনে। তবে এ বিষয়ে জড়িত ক্রেতা-বিক্রেতা কোনও পই মুখ খুলতে রাজি নন।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে সদলবলে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়া শহরের উঠতি সন্ত্রাসী ও বখাটেরা ‘টপ ফর্মে’ আছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রশয়ে বেড়ে ওঠা এসব সন্ত্রাসীরা ‘সার্ভিস দেওয়া’র বিনিময়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি যেসব সুবিধা পাচ্ছেন তার মধ্যে রয়েছে, মোটরসাইকেলের তেল, মোবাইলের বিল ও হাত খরচের জন্য বাড়তি টিপ্স।
এসব বখাটেরা মাথাপিছু প্রতিদিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত সেলামিও পাচ্ছেন।
এ সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ শহরের মাদকসেবী, সদ্য কারামুক্ত সন্ত্রাসীরাও। তাই তারাও দলে দলে ভিড় করেছে নির্বাচনী প্রোপাগাণ্ডায়। আগে বিভিন্ন খেলাধুলা ও অনুষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে শহরে নিরব চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরারাও আছেন এই কাতারে।
তবে এতসব ‘ভালো খবরের’ পেছনে কিছুটা অন্য খবরও আছে। শহরে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে ফেন্সিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের দাম। কারণ, চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদা বেড়ে গেছে- কারণ, মাদকসেবীদের হাতে প্রতিদিনই আসছে নির্বাচনী কামাইয়ের কড়কড়ে কাঁচা টাকা।
একাধিক মাদকসেবীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহ ধরে চিহ্নিত ফেন্সিডিল ও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ‘বাজারে মালের সাপ্লাই নেই’ দাবি করে প্রতি বোতল ফেন্সিডিল ৯০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় আর ইয়াবা ট্যাবলেট ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করছে।
এদিকে মৌলভীবাজার পৌরসভায় মেয়র পদে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বীতায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত একক প্রার্থী বর্তমান মেয়র ফয়জুল করিম ময়ুন, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ঘোষিত ও মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী সাইফুর রহমান বাবুল ও স্থানীয় আ’লীগের একাংশ সমর্থিত প্রার্থী ও জেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক নাহিদ আহমদ।
সংশ্লিষ্টরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ তিন প্রার্থীর পইে প্রতিদিন কর্মী খরচসহ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা খাতে অন্তত ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
তবে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিন প্রার্থীর সবাই টাকা খরচের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
বাস্তবে প্রতিদিন কর্মীরা মাঠে নামার আগেই প্রার্থীদের লিফলেটের সঙ্গে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ‘খরচ’ এর টাকা।
আর কর্মী খরচের এ টাকার হার নিয়েও প্রার্থীদের মধ্যে চলছে অন্যরকম এক প্রতিযোগীতা। গত বৃহস্পতিবার থেকে এক মেয়র প্রার্থী কর্মীদের জনপ্রতি দৈনিক ২৫০ টাকা করে ‘হাজিরা’ দেওয়া শুরু করায় তার কার্যালয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এসব মৌসুমি কর্মীরা।
কর্মী খরচের টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার এই ‘চালে’ বেকায়দায় পড়ে গেছেন অন্য প্রার্থীরা। শেষমেষ তারাও কর্মী ধরে রাখার তাগিদে বাড়াচ্ছেন ‘হাজিরার’ রেট।
এই সুযোগে ‘দু-মুখো’ নীতিও চালিয়ে যাচ্ছেন চালিয়াত শ্রেণীর কোনও কোনও কর্মী। বাড়তি উপার্জনের লক্ষে অনেকে দিনে এক মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে সন্ধ্যার পরই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে ‘দ্বিতীয় শিফ্ট’ করছেন।
তবে বিত্তশালী প্রার্থীদের টাকা উড়িয়ে ভোটের হাওয়া নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় বেকায়দায় পড়েছেন অনেক অসচ্ছল কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী। তারা নিজেদের প্রচারণা এমনকি লিফলেট বিলির জন্যও কর্মী পাচ্ছেন না।
১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ছাদিকুর রহমান ছাদিক বাংলানিউজকে জানান, তার ওয়ার্ডে কালো টাকার ছড়াছড়ি চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মেয়র প্রার্থী বাংলানিউজকে বলেন, ‘এবার নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা ও কড়াকড়ির কারণে প্রার্থীরা সরাসরি প্রকাশ্যে কর্মী খরচ বা ভোটারদের টাকা না দিলেও গোপন খরচ তো চলছেই। ’
তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর কর্মী ভাগিয়ে নেওয়ার এ প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে অন্তত কিছু খরচের টাকা তো আমাকেও জোগান দিতে হচ্ছে!’
জানা গেছে, পৌর এলাকার বেরীরচর, সৈয়ারপুর ও বড়হাট এলাকায় ভাসমান ও অস্থানীয় ভোটারদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এসব এলাকায় টাকার ছড়াছড়ি চলছে সবচেয়ে বেশি। আর নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়ি ও বাধ্যবাধকতার কারণে মেয়র ও কাউন্সিলার প্রার্থীরা এসব ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখতে নানা কৌশলী ভুমিকা নিয়েছেন।
আগের নির্বাচনগুলোতে ভোটের আগের দুই দিনে অস্থানীয় ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে ভোট টানার চেষ্টা থাকলেও এবার আগেভাগেই কৌশল পাল্টেছেন প্রার্থীরা। নির্বাচনের ১৫ দিন আগে থেকেই বিভিন্ন বস্তি ও কলোনীতে ২০ থেকে ৫০ জন করে পুরুষ ও মহিলাকে নিজের কর্মী হিসেবে মাঠে নামিয়েছেন তারা।
শহরের বাসাবাড়িতে গৃহস্থালী কাজে কর্মরত মহিলারাও বাসাবাড়ির কাজ ছেড়ে নেমে পড়ছেন ‘মৌসুমী নির্বাচনী প্রচারনায়’। এ শ্রেণীর কর্মীর তালিকায় রয়েছেন রিক্সাচালক, দিনমজুর, হোটেল শ্রমিক, গৃহকর্মীসহ গৃহিনীরাও।
শহরের সৈয়ারপুর বন্যাবাঁধ এলাকার ভোটার ছমিরন বেগম জানান, তিনি কার্তিক চন্দ্র সড়কের এক আইনজীবীর বাড়িতে ৪বছর ধরে গৃহস্থালী কাজ করেন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় গত দু’দিন ধরে অসুস্থতার অজুহাতে কাজে না গিয়ে এক মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন । বিনিময়ে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে পাচ্ছেন তিনি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আহা এমন ভোট যদি সারাবছর চলত!’
শহরের মুসলিম কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা গৃহিনী সোনিয়া আক্তার জানান, তার বাড়িতেও প্রতিদিন বাসার কাজের মেয়েদের দু’তিনটি দল একেক সময় একের প্রার্থীর লিফলেট নিয়ে ভোট চাইতে আসছে।
‘কাজ না কইরা বাড়ি বাড়ি ঘুইরাই যদি তার চেয়ে বেশি টাহা পাওয়া যায় তাতে দোসের কি আছে? ২০০টাহা মজুরি পাইয়া ভোট চাইতে আইছি’- বললেন শহরের টিবি হাসপাতাল সড়কের রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আবু মোহাম্মদের বাড়িতে এক মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইতে আসা ৫/৬জন যুবক।
তবে ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটছে। শহরের কোর্ট এলাকায় বিএনপির প্রার্থী ফয়জুল করিম ময়ুনের পক্ষে সদলবলে গণসংযোগে নামা জেলা ছাত্রদল নেতা নাসিম আহমদ বাপ্পী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি আমার দলের টানে নিজের তাগিদেই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমেছি। আমরা প্রার্থীর কাছ থেকে একটি টাকাও নিচ্ছি না। ’
এছাড়াও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে পোস্টার লাগানো-ঝুলানো, লিফলেট বিলি করে সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোররাও প্রতিদিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করছে।
ভোটের হাওয়ায় এভঅবে টাকার ছড়াছড়ি বিষয়ে প্রশ্ন করলে সিপিবির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু জাফর আহমদ জানান, মৌলভীবাজার পৌর নির্বাচন এখন কালো টাকার খেলায় পরিনত হয়েছে।
জেলা জাসদের সভাপতি এম এ হক বলেন, ‘ভোটের ময়দানে টাকার ছড়াছড়ি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায় বলেই আমরা মনে করি। ’
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১১