ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

... সিগন্যাল

সালাম ফারুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১১
... সিগন্যাল

পুঁজিবাজারে গত তিন সপ্তাহের সার্বিক পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ ছিল তা আর এখন নতুন করে কাউকে বলার কিছু নেই। যারা পুঁজিবাজার বোঝেন না তারাও অন্তত এটা বুঝে গেছেন, দেশের অর্থনীতির একটি অংশে চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।

কিন্তু এ বিষয়টি হয়তো সরকার বুঝতে পারছে না। হয়তো বুঝে ও না বোঝার ভান করে আছে।

এর আগে ১৯৯৬ সালে এ পুঁজিবাজারে ঘটে যাওয়া কেলেঙ্কারির সময়ও ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তখন তৎকালীণ অর্থমন্ত্রী (বর্তমানে প্রয়াত) শাহ্ এ এম এস কিবরিয়া বলেছিলেন ‘আমি শেয়ারবাজার বুঝি না’।

এবারও ক্ষমতায় তারা। অবশ্য এবার কেউ কিবরিয়ার মতো মন্তব্য না করলেও বিনিয়োগকারীদের কাটা ঘায়ে নূনের ছটা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। অপরদিকে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, বাজারের এ অবস্থার জন্য তার নিজের তথা সরকার ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী।

অর্থমন্ত্রী শুক্রবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দুই দিনের মধ্যে এসব ভুল শনাক্ত করে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করা হবে এবং কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

অপরদিকে ড. মসিউর রহমান বৃহস্পতিবার খুলনায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘শেয়ারবাজারের ধসে সরকারের মাথাব্যথার কোনও কারণ নেই। এর পুঁজি প্রকৃত বিনিয়োগে যায় না। শেয়ারবাজারকে কেন্দ্র করে যারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, আপনার ও আমার দায়িত্ব তাদের বাধা দেওয়া এবং বলা, তোমরা দেশের ও সমাজের শত্রু‘।

সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদার দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি দু’ধরনের বক্তব্য নিয়ে জনগণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, তবে কি আওয়ামী লীগ সরকার পুঁজিবাজার চায় না? অথবা, পুঁজিবাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিবারই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী লোকজন নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। তাই সরকারের উচ্চমহল কিছু বলতে বা অ্যাকশন নিতে পারে না?’

গত কয়েকদিনে অনেককেই এ ধরনের মন্তব্য করতে দেখা গেছে। এমনকি রাজপথে আন্দোলনে নামা বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান ও শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগের দাবি তুলতে দেখা গেছে।

মসিউর রহমানের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ অনেক বিনিয়োগকারীকেই ‘আর মাত্র তিন বছর’ অথবা ‘যা খেলার খেলে যাও, তিন বছর পরই বুঝবা’ ইত্যাদি ধরনের মন্তব্য করতে শোনা গেছে। এ মন্তব্য যে সরকারের জন্য এক ধরনের সিগন্যাল তা হয়তো কারও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।

অর্থমন্ত্রী যতোই বলুন করসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা তিনি কতোটা করতে পারবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পথে নামানোর এ মিশনের তার দলের অনেক নেতা ও ব্যবসায়ী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি কি সত্যি সত্যি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন?

গত এক বছর ধরে অর্থমন্ত্রী বলে আসছেন, পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্তত ২৫/২৬টি কোম্পানির শেয়ার ছাড়া হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনও ছিটেফোটা দৃষ্টান্তও দেখাতে পারলেন না তিনি।

উপরন্তু তিনি ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ সালের মতো ধস নামার আশঙ্কা নেই। ’ তখন তিনি এও বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার দ্রুত ঊর্ধ্বমুখি হয়েছে। এ প্রবণতা কোনোভাবেই অতিস্ফীতির লক্ষণ নয়। ’

ওইদিন তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ২৬টি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার ঘোষণারও পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।

তখন ‘পুঁজিবাজারে তেজিভাব চলছে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সরকার এ বাজারের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বাজার স্থিতিশীল রাখতে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

তিনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ যে হিতে বিপরীত হবে তা হয়তো ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি।

কিছুদিন আগেও তিনি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে উপহাস করেছিলেন। তিনি শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শেয়ারের দাম পাঁচ টাকা কমে গেলে রাস্তায় নেমে এসে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেন। কিন্তু শেয়ারের দাম ৫০০ টাকা বাড়লে তো মিষ্টি খাওয়ান না। দরপতন হলে রাস্তায় নেমে ভাঙচুর শুরু করে দেন। ভাঙচুর কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। ’

পরদিন রাজপথে অনেক বিনিয়োগকারীকেই বলতে শোনা যায়, ‘মাননীয় মন্ত্রী, আপনাকে আমাদের কুলখানির মিষ্টি খাওয়ার দাওয়াত দিলাম। ’

এটা বাদ দিলাম। বৃহস্পতিবার সিলেটে অর্থমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ হয়। এখানে তো কেউ বলেনি যে, বিরোধীদলের কর্মীরা বিক্ষোভ করেছে। কারণ, সে ঘটনায় জড়িতদের অনেকেই ছিলনে আওয়ামী লীগ সমর্থক।

সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩৩ লাখ বিও (বেনিফিশিয়ারি ওউনার) অ্যাকাউন্ট। এর মধ্যে বিশেষ বিশেষ অ্যাকাউন্ট বাদ দিলে অন্তত ২৮ থেকে ৩০ লাখ অ্যাকাউন্ট রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তাদের রোজগারের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্তত এক কোটি মানুষ।

বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ বেকারত্ব ঘোচাতে পুঁজিবাজারে যুক্ত। তারা পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে অথবা জায়গা-সম্পত্তি বিক্রি করে পুঁজি জোগাড় করে দু’পয়সা লাভের আশায় এখানে এসেছেন। নিজেদের সহায়-সম্বল হারানোর এ অভিজ্ঞতা কি তারা সহজে ভুলে যাবেন? তাদের এ দুর্দশার সঙ্গে কি তাদের সহায়তাকারীরা একাত্ম হবেন না?

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত নির্বাচনের আগে প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক’জনকে চাকুরি দিতে পেরেছেন, একবার ভেবে দেখেছেন কি? সেই বেকার যুবকদেরই একটি অংশ এ পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সরকারকে বুঝতে হবে, ১৯৯৬ সালে তাদের আমলেই সংঘটিত কেলেঙ্কারির কথা আজও বিনিয়োগকারীরা ভুলে যাননি। আর এবারের ঘটনা তো ইতিহাস হয়ে থাকবে। ফলে নিজেদের জন্য তা কতোটা ‘সুখকর’ হবে, সে কথা একবারও কি ভাবতে ইচ্ছা করে না তাদের?

বাংলাদেশ সময় ১৪৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।