আবার বড় ধরনের সঙ্কটে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ১৯৯৬ সালের চেয়েও এবারের পুঁজিবাজারের ধস আরো ভয়াবহ বলে মন্তব্য করছেন বিভিন্ন মহল।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সেগুলোর কিছু সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো’। তিনি বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগই কাজে আসেনি। সবশেষে সূচকে সার্কিট ব্রেকার দিয়েও চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি’। একই সঙ্গে বাজার পতনের জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট, শেয়ারের অতি মূল্যায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও দায়ী করেছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মহল উল্লসিত হলেও এ ধরনের আত্মসমালোচনামূলক বক্তব্য বা স্বীকারোক্তির এক ধরনের ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে। তেমনি এর তাৎপর্যও অনেক। ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে সরকার তার ভুল বুঝতে পেরেছে এবং এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার আগামীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
তবে পাশাপাশি এই প্রশ্নটাও উঠছে যে, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা বা ভুলের খেসারত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেন বার বার দেবে? এর প্রতিকার কী? বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শুধু দায় স্বীকার করলেই হবে না, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিও সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এই কথাগুলো এখন খুব জোরালোভাবে উঠে আসছে। কারণ ’৯৬ সালে পুঁজিবাজারে যখন বিপর্যয় ঘটে তখনও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। আর এবার যখন এ সরকার দায়িত্ব নেয় তখনও পুঁজিবাজারে এমন একটা কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এবারও পুঁজিবাজারে ’৯৬-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
তবে এবার যাতে ’৯৬-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে এ ব্যাপারে সরকার তৎপর ছিল না এমনটা বলা ভুল হবে। সরকার তৎপর থাকলেও মূলত সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার কারণে এবার বাজারে ধস নেমেছে।
অনেকের মতে, ’৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হলে আজ আর এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না।
অর্থমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ’৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারীর সাথে জড়িতদের শাস্তি না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালের ঘটনার জন্য যাদের অভিযুক্ত করা
হয় তাদের বিরুদ্ধে কেউই সাক্ষ্য দিতে চায় না। ফলে প্রমাণ থাকলেও তা কাজে আসছে
না। মামলা করা যাচ্ছে কিন্তু সাক্ষ্য দেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না’। যদি তাই হয় তাহলে পুঁজিবাজারের জন্য বিষয়টা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই বিকল্প চিন্তা করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন পুঁজিবাজার ছিল মন্দা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে টানা প্রায় তিনমাস পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থা বিরাজ করছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুঁজিবাজার একটু একটু করে চাঙ্গা হতে থাকে। ২০০৯ সালের জুনে জাতীয় বাজেট ঘোষণার পরপরই বাজার আরো বেশি চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং প্রথমবারের মতো ডিএসই’র দৈনিক লেনদেন এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর থেকে বাজার ঊর্ধ্বমুখি হতে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে।
এর মধ্যে বাজারের লাগাম টেনে ধরার জন্য কখনো কখনো মার্জিন লোন কমিয়ে দেওয়া ও পি-ই রেশিও সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এগুলোর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে বিতর্কিত হয়েছে সরকার ও এসইসি।
পুঁজিবাজার সম্পর্কিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০০৯-এর নভেম্বরে। এ মাসের ৫ তারিখে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ‘ভবিষ্যতে সব কোম্পানির অভিহিত মূল্যে সমতা আনা হবে। যেহেতু বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ১০০ টাকা, সেহেতু ভবিষ্যতে শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করা শ্রেয়তর হবে। ’ এর পাঁচ দিন পর এসইসির পরামর্শক কমিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করে। শেষ পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় আগ্রহী কোম্পানিগুলোকে তাদের অভিহিত মূল্য ১০ টাকায় রূপান্তরের ব্যাপারে সম্মতি দেয়।
বলাবাহুল্য, এ ধরনের ঢালাও সিদ্ধান্তে রাতারাতি অধিকাংশ শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে এবং লেনদেন বেড়ে যায় অনেক।
চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতার জন্য ‘বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি, শেয়ার স্বল্পতা ও বিনিয়োগকারীদের অধিক মুনাফা প্রবণতা’ এই তিনটি কারণকে চিহ্নিত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার পুঁজিবাজারকে আরো স্বচ্ছ ও গতিশীল করতে চায়’। তিনি বলেন, ‘এ লক্ষ্যে বাজার তদারকি জোরদার, মার্জিন লোনের হার পুন: নির্ধারণ, বুক বিল্ডিং পদ্ধতি ও ওটিসি মার্কেট চালু এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট স্থাপন করা হয়েছে’।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে (২০১০) মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান যে, পুঁজিবাজারের স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকার, পোর্টফোলিও ম্যানেজার, মার্চেন্ট ব্যাংক এদেরকে মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় আনা হবে। আগামী জুনের মধ্যে এ সংক্রান্ত সকল আইন প্রণয়ন সম্পন্ন করা হবে। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারকে মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় আনা হলে ‘বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না’ বলেও উল্লেখ করে তিনি।
এছাড়া পুঁজিবাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে গত বছর ১২ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী এক বৈঠকে ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার বিষয়ে ঘোষণা দিলেও এ ব্যাপারে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানা যায়।
প্রসঙ্গ কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বিধান অনুযায়ী পুঁজিবাজার দেখা-শোনা করার সার্বিক দায়িত্ব সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)-এর, বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু সার্বিকভাবে দেশের মুদ্রা বাজার মনিটরিং করে তাই পুঁজিবাজারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ধরনের পরোক্ষ মনিটরিং থাকে। এ কারণে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো কখনো নেপথ্য হস্তক্ষেপ করে থাকে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে এসইসি যখন ব্যর্থ হয় কেবল তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসে। কিন্তু কোনো কোনো মহল তখন এই বলে প্রচার চালায় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণেই পুঁজিবাজারে ধস নামছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
তবে এবার পুঁজিবাজার পতনের জন্য অর্থমন্ত্রী সরকার ও এসইসি’র ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করায় স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ না করার জন্য ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে আসছিল। এ লক্ষ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর হিসাব পৃথকভাবে দাখিলেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলো গোপনে পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে আসছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এটা প্রমাণিতও হয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬(২) অনুযায়ী , কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ বা ব্যাংকের আদায়কৃত ও সংরতি মূলধনের ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি কম, এর বেশি টাকায় ওই কোম্পানির শেয়ার ধারণ করা যাবে না। পাশাপাশি কোনো ব্যাংক তার মোট আমানতের ১০ ভাগের বেশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না।
কিন্তু অতি মুনাফার আশায় ব্যাংকগুলো এ ধরনের বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। আর এতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে গ্রাহকের আমানত। ব্যাংকগুলো একদিকে নিজস¡ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করছে, পাশাপাশি গ্রাহকদেরও ঋণ দিচ্ছে বিনিয়োগ করার জন্য। আর এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ শেয়ারবাজারে ঢুকে পড়েছে। চলতি বছর বেসরকারি অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশ এসেছে শেয়ারে বাজারে বিনিয়োগ থেকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-ও সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ: আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ‘প্রথাগত ব্যাংকিং কার্যক্রমের বাইরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে। যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাজারের পতন ঘটলে তা কোনো কোনো ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে’।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরতে গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ব্যাংকগুলোর সিআরআর ও এসএলআর-এর হার কিছুটা বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরও আগে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে তাদের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয় করতে বলা হয়। তবে বাজারের সঙ্কট ক্রমশ : বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত তার সিদ্ধান্ত শিথিল করে এবং শেয়ার কেনার জন্য আইসিবি-কে ৪শ’ কোটি টাকা অর্থের যোগান দেয়।
বাংলাদেশ সময় : ১১৫৬ ঘন্টা, ২৩ জানুয়ারি , ২০১১