কেশবপুর (যশোর): ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যশোরের কেশবপুর উপজেলায় ১২১ জন পুরুষ ও ২১১ জন মহিলা বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে ৫ জন পুরুষ এবং ৪ জন মহিলার মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগের বছরগুলোতে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ ছিল না।
এ ব্যাপারে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের পরিসংখ্যান তুলনা না করেও বলে দেওয়া যায়-শুধু একটি উপজেলায় আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের এ সংখ্যা আশংকাজনক।
উল্লেখ্য, দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আত্মহননের ঘটনার ক্ষেত্রে আলোচিত খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলা। তবে বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও’র তৎপরতায় এ প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে বলে জানা যায়। তারপরেও ২০১০ সালে ঝিনাইদহ জেলার মোট ৬টি উপজেলায় বিষ-ঘুমের বড়ি সেবন ও গলায় দড়ি দিয়ে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ২হাজার ৭০৯ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ৩৬০ জনের মৃত্যু হয়। এ তথ্য জানা গেছে সোসাইটি ফর ভলান্টারি অ্যাকটিভিটিস (শোভা)-এর গবেষণাপত্র সূত্রে।
তবে একই বিভাগের জেলা যশোরের কেশবপুর উপজেলায় মানুষজনের মাঝে আত্মহত্যাপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ কী? এ প্রশ্ন এখন এলাকার সব শ্রেণীর মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে।
বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবারে অভাব-অনটন, বিবাহ-বিচ্ছেদ, যৌতুক, স্বামী-স্ত্রীর অভিমান ও প্রেমঘটিত কারণসহ না কারণে ব্যাপকহারে এ আত্মহত্যা প্রবণতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
হাসপাতালের চিকিৎসক এবং থানাপুলিশও এ ধারণার সঙ্গে একমত বলে জানা গেছে।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন, বিষপানে ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা নিয়ে যারা বাড়ি ফিরছেন সে সব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনগত কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন কেশবপুরে আত্মহত্যা চেষ্টার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আত্মহত্যার চেষ্টা করে যদি কেউ বেঁচে যায় তার বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান থাকলেও গত ১৪ মাসে কেশবপুর থানা পুলিশ এ সংক্রান্ত ঘটনায় একটি মামলাও করেনি। অথচ এ সময়ের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন ৩৫৭ জন নারী-পুরুষ।
উপজেলা হাসপাতালের (স্বাস্থ্যকেন্দ্রের) ভর্তি রেজিস্ট্রার অনুযায়ী ২০১০ সালের ৩৩২ জন নারী-পুরুষ বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাদের সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর ৫ পুরুষ এবং ৪ মহিলার মৃত্যু হয়।
এছাড়া পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিষপানে ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে এ উপজেলায় ৩৯ নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছে।
ওপরের দু’টি পরিসংখ্যানই ভয়াবহ।
এছাড়া একই বছর ২ জন মহিলা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসা শেষে তারা বাড়ি ফেরেন।
এছাড়াও চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭ জন পুরুষ ও ২৬ জন মহিলা বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারাও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর বাইরে ১ জন পুরুষ গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাৎক্ষণিক ব্যর্থ হলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যাওয়া উপজেলার কানাইডাঙ্গা গ্রামের জুঁই (হাসপাতালে ভর্তি নং-৫০৭) বাংলানিউজকে জানান, পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ায় পরিবারের সদস্যদের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি।
উপজেলার চালিতাবাড়িয়া গ্রামের আয়শা খাতুন (হাসপাতালে ভর্তি নং-৬৬৩) সংসারের অভাব অনটন ও দাম্পত্য কলহের জের ধরে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জানান।
এদিকে কেশবপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর রেজাউল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বিষপানে ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে কেউ মারা গেলেই কেবল হাসপাতাল কর্তৃপ থানা-পুলিশে খবর দেয়। চিকিৎসা নিয়ে ভাল হয়ে যখন কেউ বাড়িতে ফিরে যায় তখন তারা থানা পুলিশে খবর দেয় না। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব হয় না।
তিনি আরো জানান, গত বছর বিষপানে ১৮ জন ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে ২১ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। যা ইউডি মামলা হিসেবে থানায় রের্কড করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. হেদায়েতুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বিষপানে ও গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে সঙ্গে সঙ্গেই থানা পুলিশকে জানানো হয়।
তিনি আরো জানান, এ ধরনের রোগীরা শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই নয়, কেশবপুর শহরের ৬টি বেসরকারি কিনিকেও চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়। এ েেত্র স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানোর নিয়ম থাকলেও কিনিক কর্তৃপ স্বাস্থ্য বিভাগকে খবর দেয় না।
তবে শহরের সেবা সার্জিক্যাল কিনিকের মালিক নেওয়াজ বলেন, বিষপানে আত্মহত্যা চেষ্টাকারী যে সব রোগী কিনিকে চিকিৎসা নেন, মাসওয়ারী তাদের তালিকা স্বাস্থ্য বিভাগে পাঠানো হয়।
অপরদিকে থানা পুলিশ মামলা না করার প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহিদা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, ‘সামাজিক দুর্নামের ভয়ে ঘটনার শিকার পরিবারও মামলা হোক তা চায় না। তবে বিধান অনুযায়ী আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত। ’
তার মতে, মামলা হলে আত্মহত্যা চেষ্টা প্রবণতা অনেক কমে যাবে।
এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ডা. বিরাজ মোহন বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, বিষন্নতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই সাধারণত আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এছাড়াও সামাজিকভাবে মর্যাদাহানি, ইভটিজিং ও মান অভিমানের কারণেও কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
তবে, যারা আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে যায়, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলেই আত্মহত্যা প্রবণতা কমে যাবে বলে মনে করেন না ডা. বিরাজ মোহন।
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে বিষন্নতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর অন্যান্যদের ক্ষেত্রে (বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করতে পারে বলে ধারণা হয় এমন ব্যক্তিদের) পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। ‘
তিনি আরও জানান, ‘আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১১