ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

আদম শুমারি : প্রচারহীনতায় সচেতনতার অভাব

‘ভোটার লিস্টে নাম আছে-শুমারি দিয়ে কী হবে’

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১১
‘ভোটার লিস্টে নাম আছে-শুমারি দিয়ে কী হবে’

ঢাকা: ‘আমগো আবার কিসের শুমারি-কিসের গোণাগুণি ? রাস্তায় খাই, ভ্যানে ঘুমাই ! আমগো মাথা গইণা দেশের কোনো কাজে আইবো না, হুদাই টাইম নষ্ট। ’ চলমান আদম শুমারি-২০১১ তে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করা প্রসঙ্গে এসব কথাই বলছিলেন কাওরানবাজারের ভ্যান চালক মালিক মিয়া।

তার সংগে সুর মিলিয়ে একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন জুনাব আলী, দেলোয়ার, ছামাদ মৃধা, হোসেন মৃধা, সাবের আলী, সাইজুদ্দিন প্রামানিকসহ ৮/১০ জন ভ্যান চালক।

কাওরানবাজারের ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের সঙ্গেই একাকার হয়ে গেছে তাদের পেশা, জীবন, বেঁচে থাকা। ১৪/১৫ বছর ধরে ছিন্নমূল শ্রমিক তারা। কাওরানবাজারের দোকানপাট ঘেষে, মসজিদ গলির আশেপাশে নিজেদের রিকসা ভ্যান থামিয়ে দিনের বেলায় বিশ্রাম নেন, ঘুমিয়ে থাকেন। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় তাদের হৈচৈ, চিৎকার, ছোটাছুটি। ট্রাক থেকে কাঁচামাল নামিয়ে ভ্যানে তুলে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দেওয়াটাই তাদের কাজ।

জুনাব আলী- মালিক মিয়াদের মতো প্রায় আড়াইশ’ ভ্যান চালক রয়েছেন কাওরানবাজারকে ঘিরে। রাজধানীর কোনো বাসা-বাড়িতে মাথা গোঁজার বিন্দুমাত্র ঠাঁই নেই তাদের। অনেকের নাড়িপোতা গ্রামেও একখন্ড ভিটের অস্তিত্ব নেই। স্ত্রী-সন্তানরা বসবাস করে অপরের দয়ায়, অন্যের ভিটেয়। আদম শুমারির ব্যাপারে কোনো কিছুই জানেন না জুনাব আলী, ছামাদ, সাবের, সাইজুদ্দিনরা। সরকারি পরিসংখ্যানে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি করা না করা নিয়ে মাথা ব্যথাও নেই তাদের।

ভ্যানচালক ছামাদ বলেন, ‘খাতাপত্র নিয়া জাগায় জাগায় (বিভিন্ন স্থানে) ঘুমে থাকা মানুষগুলারে ডাইকা উঠাইয়া কিসব লেখে লেখে নিতে দেখলাম। আমরা তো থাকি দৌড়ের উপর-আমগো নাম লিখবো কোন্ সময় ? আমরা মুর্খ-সুর্খ মানুষ, কিসের মধ্যে সই দিয়া আবার কোন্ বিপদে পড়ি ! নাম না লেখাতেই ভাল অইছে। ’

রাস্তা-ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা লোকজনকে ডেকে তুলে চলমান ‘আদম শুমারি’ করার বিষয়কে ওই ভ্যানচালকরা রীতিমত হাসি-ঠাট্টা, ইয়ার্কি হিসেবেই নিয়েছেন। সরকারি এ গণনা কার্যক্রমকে তামাশা বলেও মন্তব্য করেন তারা।

শুমারির কাজে নিয়োজিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মিরা রাজধানীর ভাসমান জনগোষ্ঠীর গণনা করতে গিয়ে সোমবার রাতে নানারকম বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হন। কাওরানবাজার এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী শুমারি কর্মি মোখলেছুর রহমান, রিফাত আহমেদসহ কয়েকজন জানান, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও প্রচার স্বল্পতার কারণেই লোকজন শুমারির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছেন না। রিফাত আহমেদ বলেন, ‘ভোটার লিস্টে নাম আছে-শুমারি দিয়ে কী হবে-অনেকেই এমন ভ্রান্ত ধারনা পোষন করায় শুমারি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ’

শুমারি কাজে নিয়োজিত আরেকদল কর্মি বেশ বিপাকে পড়েন জাতীয় সংসদ ভবন সংলগ্ন এলাকায়। সেখানে মানিক মিয়া এভিনিউ ও জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শতাধিক ভাসমান দেহপসারিনীকে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি কোনোভাবেই। খাতাপত্র নিয়ে শুমারি কর্মিরা এগিয়ে যেতেই দেহপসারিনীরা অজানা আশংকায় দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে যেতে থাকে। সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে পলায়নপর এক দেহপনারিনী বাংলানিউজকে বলে, ‘আজ রাইতে নাম তালিকা করবো-কালই পুলিশ আইবো ধইরা নিতে। ’

শুধু আদম শুমারি সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণার অভাবেই গণনা বিষয়ে ভাসমান অনেক মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা গেছে। শুমারিতে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না বললেই চলে।

এদিকে ভাসমান জনগোষ্ঠীর শুমারির ক্ষেত্রে রেলস্টেশন, বাস ও নৌ-টার্মিনাল, রাস্তা-ফুটপাত ছাড়াও হাসপাতাল-ক্লিনিক ও আবাসিক হোটেলে অবস্থানকারীদের গণনার কথা রয়েছে। কিন্তু সোমবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে হাসপাতাল-ক্লিনিক-আবাসিক হোটেলে শুমারি কার্যক্রম চালানোর নজির দেখা যায়নি। ফকিরাপুল এলাকার আশিয়ান, সিরাজ আবাসিক, মুনস্টার, আল ইউনুস, টাওয়ার, আজমেরী, নিশি, রওশন, মেমোরী হোটেলে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তিদের গণনা করেনি কেউ। মেমোরী হোটেলের ৩৪ নম্বর কক্ষে রাত কাটানো সিদ্দিকুল আলম জানান, সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কেউ তাদের শুমারি করতে হোটেল কক্ষে যাননি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগি ও তাদের স্বজনদের গণনা করা হলেও বেশিরভাগ ক্লিনিক ছিল শুমারির বাইরে। মৌচাক এলাকার সাফেনা হাসপাতাল, শহীদবাগের আলবারাকা, শাহজাহানপুরের ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালের কয়েকশ’ রোগি ও তাদের স্বজনদের শুমারি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। ভাসমান জনগোষ্ঠীর তালিকায় স্থান পাননি কমলাপুর রেলস্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম এলাকায় বসবাসকারী ৬২ জন পঙ্গু ভিক্ষুকও।

বাংলাদেশ সময় : ০৬২৪ ঘন্টা, মার্চ ১৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।