ঢাকা: পৃথিবীব্যাপী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) খ্যাতি দীর্ঘদিনের। এখান থেকে প্রতি বছরই বের হচ্ছে শত শত মেধাবী প্রকৌশলী।
বুয়েট বিশ্বে পরিচিত হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীই উন্নত দেশে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ছুটছেন গবেষণা, উচ্চশিক্ষা আর পেশার তাগিদে। এভাবেই পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের মেধা। মেধাবী এসব শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছেন বাইরের দেশে। তৈরি করছেন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র। অধিকাংশই আর ফিরছেন না দেশে।
ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি-২০১০ (সংশোধিত)-এ বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণের অন্যতম ‘মেধা পাচার’ প্রবণতা। এতে বলা হয়, দেশে বিজ্ঞান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র সীমিত। ফলে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখার আগ্রহ কমছে। ২০১০ সালে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং-এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশে শীর্ষস্থান দখলের সঙ্গে সঙ্গে উপমহাদেশে ২৯তম স্থানে। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব ও মেধার স্বীকৃতি না দেওয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে থাকছেন না।
বুয়েট থেকে শুধু স্নাতক ডিগ্রি নিতে প্রতি শিক্ষার্থীর মাথাপিছু রাষ্ট্রের ব্যয় হয় প্রায় আট লাখ টাকা। রাষ্ট্র তাদের তৈরি করলেও দেশের কাজে তাদের মেধার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না। তাদের মেধার দ্যুতিতে অন্য আরেক দেশ আলোকিত হবে এটা কারও কাম্য নয়। তাদের জন্য তৈরি হোক পেশাত্রে তারা ফিরে আসুক সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়ে এটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
বঞ্চিত হচ্ছে দেশ
বুয়েটের প্রত্যেক বিভাগ থেকেই দেশের বাইরে যাবার প্রবণতা খুব বেশি তবে বর্তমানে সারা বিশ্বে কম্পিউটার প্রকৌশলীদের চাহিদা বেশি তাই এ বিভাগ থেকে দেশের বাইরে যাবার হার সবচেয়ে বেশি।
বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের কার্যালয় ও অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬-এর ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৩১ জন। তাঁদের ২৫ জনই এখন বিদেশে। একই বিভাগের ১৯৯৪-এর ব্যাচের ৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জন রয়েছেন দেশের বাইরে। ১৯৯৮-এর ব্যাচের ৬৫ জনের মধ্যে ৩০ জন প্রবাসী। ইন্টেল, ইয়াহু, গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএম, নোকিয়ার মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তাদের অনেকেই।
তথ্যমতে, শুধুমাত্র ইন্টেলের ৩০% প্রকৌশলী বুয়েটরে শিক্ষার্থী। ২০০৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কম্পিউটার পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের প্রেসিডেন্ট ক্রেইগ ব্যারেট আসার পিছনে রয়েছে তাদের অবদান।
২০০৬ সালে ডেনমার্ক বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের সম্ভাবনা যাচাই করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার আইটি গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে। তাঁরা আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিংয়ে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন , এতে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে । কিন্তু সারা বিশ্বে একটি ধারনা প্রচলিত আছে যে বাংলাদেশি মেধাবী প্রকৌশলীদেও প্রায় সস্তায় ব্যবহার করা যায়। তাই বিদেশি কোম্পানিগুলো এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু দেশের জনগণের টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা এ মেধাবী প্রকৌশলীরা দেশের কাজে সরাসরি অবদান রাখতে পারছেন না ।
বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম সম্প্রতি মোজাম্বিকে বুয়েটের মেধা পাচার নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা হয়, বুয়েট থেকে পাস করার পর শিক্ষার্থীদের ৮০ ভাগ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ৬০ ভাগ এ ক্ষেত্রে সফল হন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
গত ৩ ফেব্রুয়ারি বুয়েটের দশম সমাবর্তনে ও রাষ্ট্রপতি মো.জিল্লুর রহমান বুয়েটের আচার্যের বক্তব্যে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে অনেক মেধাবী ছাত্রের দেশে ফিরে না আসার কথা ক্ষোভের সঙ্গে উল্লেখ করেন। ‘আমাদের দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য অনেকেই ইউরোপ, আমেরিকা যাচ্ছেন। পরিতাপের বিষয় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে অনেকেই দেশে ফেরেন না। ফলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যেতে পারে,’ বলেন জিল্লুর রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বুয়েট , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে দেশের বাছাই করা মেধাবীরা ভর্তি হয় । তাদেও দেশের কাজে লাগানো জরুরি । মেধা পাচার রোধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, বুয়েটের মেধাবী ছাত্ররা দেশে উপযুক্ত কাজ পাচ্ছেন না তাই দেশ বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বুয়েটের অনেক ছাত্রই এখন বিভিন্ন দেশের বিশ্বস্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। দেশেও তাদের কাজে লাগানো যেত। এ জন্য দরকার নীতিমালা।
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে। তা করতে হলে দেশের এসব মেধাকে আগে কাজে লাগাতে হবে, বললেন এম এম নজরুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময় ১০৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১১