ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সীমান্তের দুদিকেই উলফার অভয়ারণ্য, অস্ত্র-ব্যবসা

সাঈদুর রহমান রিমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১০
সীমান্তের দুদিকেই উলফার অভয়ারণ্য, অস্ত্র-ব্যবসা

ভারতের মেঘালয় ও আসামের সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের ২৬টি থানা এলাকা জুড়ে ভারতীয় উগ্রপন্থিদের সদাপট বিচরণ। এদের কাছে কয়েক লাখ নাগরিক জিম্মি হয়ে পড়েছে।

এর মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ১০টি ও বৃহত্তর সিলেটের ১৪টি থানা রয়েছে। সীমান্তবর্তী এসব থানা-এলাকার উভয় পাশ জুড়েই অভিন্ন পাহাড়-টিলা ও ঘন বনাঞ্চল থাকায় জনবসতি ও জনচলাচল খুবই কম। অবস্থানগত কারণেই বিচ্ছিন্নতাবাদীসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্র“পের সশস্ত্র সদস্যরা সহজেই সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করতে পারে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন দুর্গম পাহাড় ও জঙ্গলঘেরা সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীরা।

উলফার ক্যাম্পগুলোর কারণে আদিবাসীরা যেমন জিম্মি, তেমনি এসব ক্যাম্পের কোনো কোনোটি ঘিরে চলছে অস্ত্র-ব্যবসা। এই অস্ত্র-ব্যবসা উলফার আয়ের একটি বড় উৎস। এ রকমই একটি ক্যাম্প হচ্ছে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর বড় গজনী উলফা ক্যাম্প। এ ক্যাম্প থেকেই আর্জেস গ্রেনেড কেনাবেচা ও সরবরাহ বেশি হয়ে থাকে। এখান থেকে  বিক্রি হওয়া গ্রেনেড একাধিকবার র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে। এই প্রতিবেদক টানা তিনদিন ছিলেন এই ক্যাম্পের লাগোয়া এলাকায়।

গজনী-বাঁকাকুড়া ক্যাম্প ঘিরে অস্ত্র-ব্যবসা
শেরপুর জেলা সদর থেকে সোজা উত্তরে ২০ কিলোমিটার দূরেই ঝিনাইগাতী থানার অবস্থান। উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে দিয়ে পশ্চিম দিকে আঁকাবাকা পিচ ঢালা রাস্তাটি গিয়ে শেষ হয়েছে গজনী অবকাশকেন্দ্রে। থানা সদর থেকে অবকাশকেন্দ্রের দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। এ রাস্তার সঙ্গে আরো এক কিলোমিটার কাঁচারাস্তা যোগ হয়ে মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা কোচপাড়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে। আরেকটি রাস্তা চলে গেছে সীমান্তবর্তী মহারশি নদীর ঘাট পর্যন্ত। দু’টি রাস্তা ঘন বন আর পাহাড়-টিলার ভেতের দিয়ে এগিয়ে গেছে অজগরের মতো। রাস্তার উভয় পাশে গ্রাম-জনপদ।


বড় গজনী, বাঁকাকুড়া, ছোট গজনী, নামাপাড়া, দুধনই, টিলাপাড়া ও কোচপাড়া গ্রামে প্রায় চার হাজার পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে গারো অধিবাসীদের সংখ্যাই বেশি। সেখানে কোচ, হাজং ও মোহাজেরিন মুসলিম সম্প্রদায়েরও বেশ কিছু পরিবার বসবাস করে থাকে। বেশিরভাগ পরিবারই অভাবী এবং নিম্ন আয়ের। বনাঞ্চলের কাঠ ও বাঁশ কেটে লাকড়ি বানিয়ে, বাঁশ-বেতের ঝুড়ি বিক্রি করে আর তে-খামারে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কোনো মতে চলে তাদের জীবন।


শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘গজনী অবকাশকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিকনিক ও ভ্রমণের অজুহাতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর লোকের যাতায়াত শুরু হয় সেখানে। স্থানীয়দের ধারণা, ভ্রমণ-পর্যটনের আড়ালে এখানে উলফা জঙ্গিদের জমজমাট অস্ত্র ব্যবসাও চলে। পাহাড় ও ঘন বনের প্রাকৃতিক আড়ালে পর্যটক সেজে অস্ত্র বেচাকেনার কাজটা সহজ ও নির্বিঘœ। বেগতিক দেখলে পালিয়ে যাওয়ার অবারিত সুযোগ। এ কারণেই গভীর পাহাড় ঘেরা গজনী সারা বছরই অচেনা পর্যটকদের ভীড়ে গমগম করে।


প্রথমদিকে উলফা ক্যাম্প থেকেই অপোকৃত কম দামে এ.কে-৪৭ রাইফেল, আর্জেস গ্রেনেড, শক্তিশালী বোমা ও গোলা-বারুদ কেনাবেচা হতো। মাত্র ৭০ হাজার টাকায় এ.কে-৪৭ রাইফেল বিক্রি হতো এখানে। কিন্তু  বিধি বাম! ২০০৩ সালের জুন মাসে র‌্যাব, এসবি ও সিআইডি সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানের পর অস্ত্র ব্যবসা একটু আড়ালে আবডালে হচ্ছে। সেই সঙ্গে হুহু করে বেড়েছে দাম।


স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, শুধু উলফা নয়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের কেউ কেউ এই অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নিজেদের স্বার্থেই তারা সীমান্তের অভ্যন্তরে ভারতীয় অস্ত্রবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আস্তানা বানানোর সুযোগ করে দেন। জমিজমা দখল, অবৈধ পন্থায় অগাধ টাকা কামানোর এই মহা মওকা পেয়ে এরা একেকজন হয়ে উঠেছেন টাকার কুমির। আর ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পলিসিতে উলফাও এদের ভাড়াটে বাহিনীর মতো কাজ করে।

স্থানীয় এই প্রভাবশালীরা উলফার অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনাবেচার মিডলম্যান হিসেবেও কাজ করেন। এমনকি উলফার হাতে অপহৃতদের ছাড়িয়ে আনার জন্য মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষির কাজও করেন। তারা থানা-পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রা, গ্রেফতার হওয়া দুর্বৃত্তদের হয়ে মামলা চালানোর কাজও করে থাকেন।

সীমান্তের উভয় পাশেই উলফার অভয়ারণ্য
ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) নিয়ন্ত্রিত ১৩টি গ্রুপের সহস্রাধিক সশস্ত্র ক্যাডার সীমান্তের উভয়পাশ জুড়েই নিজেদের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে। সীমান্তের ওপারে নানা অপরাধ করে তারা পাহাড়-জঙ্গলের সীমান্তরেখা ডিঙ্গিয়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেয়। একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন অপরাধ সংঘটন করে ওরা পাড়ি জমায় সীমান্তের ওপারে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী উভয় দেশের আদিবাসীদের চেহারা, ধর্ম, চালচলন ও ভাষা প্রায় অভিন্ন। ফলে এসব চরমপন্থি সহজেই আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এদের আলাদাভাবে শনাক্ত করার কোনো উপায় থাকে না।

উলফা ক্যাম্প ও এগুলোর দায়িত্বে যারা  

উলফা সদস্যরা বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় ঘিরেই গড়ে তুলেছে ১৩টি ক্যাম্প। বৃহত্তর সিলেট জেলার সীমান্ত এলাকায় এ রকম ক্যাম্পের সংখ্যা অন্তত ১৯টি বলে উলফা-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সেসব ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় অস্ত্রশস্ত্রের বিপুল মজুদ গড়ে তুলেছে তারা। শুধু ক্যাম্প নয়, আশপাশের বিভিন্ন বাড়ির আঙ্গিনা, বনাঞ্চলের মাটি খুঁড়ে আর্জেস গ্রেনেডসহ নানা রকম বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখায় সেসব এলাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মৃত্যুফাঁদ’ ।

২০০১ সালে শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার ছোট গজনী নামাপাড়ায় গারো মহিলা ‘রাঙ্গাবুড়ি’র বাড়ির আঙ্গিনাতে উলফার প্রথম ক্যাম্পটি স্থাপিত হয় পাকা ভবন তুলে। ২০ ফুট বাই ৩৫ ফুটের টিনশেড ভবনের দণি পাশেই সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বড় এক মাঠ। জেম্স এই রাঙ্গাবুড়ি  ক্যাম্পের কমান্ডার।


২০০৩ সালের শুরুতে উলফা তাদের বড় ঘাঁটিটি বানায় নামাপাড়া থেকে দুই কিলোমিটার ভিতরের ‘বাঁকাকুড়া’ গ্রামে। এই ক্যাম্পে আছে ছোট-বড় তিনটি টিনশেড ভবন। এ ক্যাম্পের কমান্ডার রিপন বাড়ৈ।


বড় গজনীর স্কুলমাঠ সংলগ্ন ‘খ্রিস্ট গারো’র বাড়িতে ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে তোলা হয় আরেকটি উলফা-ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে-যেতে হয় পাকা ভবন, রাস্তা থেকে তিনটি গেট পেরিয়ে। এ ক্যাম্পের কমান্ডার জাগির ওরফে বিটু।
টিলাপাড়ায় স্যামুয়েল মাংসাং এর বাড়ির লাগোয়া পূর্ব-দক্ষিণ পাশের টিলার চূড়ায় গড়ে তোলা হয় ছোট আকারের আরেকটি উলফা-ক্যাম্প। একে মূলত পাহারা চৌকি হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। ক্যাম্পটির কমান্ডার এলিন মারাক।


জামালপুর জেলা সংলগ্ন বালিয়াজুরী সীমান্ত পয়েন্টে মহারশি নদীঘেঁষা ক্যাম্পটি বাঁশের বেড়া ও টিনের চালা দিয়ে তৈরি। এ ক্যাম্প গড়ে তোলা হয় ২০০৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। এটির ক্যাম্প-কমান্ডার বিমল বাড়ৈ ও অ্যালবার্ট রিপন।


নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা থানার নলচাপড়ায় মিশনারি হাসপাতালের নার্স বিনীতা সাংমা’র বাড়িতে গড়ে তোলা হয় বেশ বড় আকারের এক উলফা ক্যাম্প। কমান্ডার ছিলেন : মারাক বাবু (তার আর কোনো নাম জানাতে পারেননি কেউ)।


ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানার মনিকুড়া ক্যাম্পের কমান্ডার সুশীল দ্রং। এ ক্যাম্পের ভিটে খুঁড়ে বিডিআর জওয়ানরা ২০০৫ সালের ৩০ জুন তিনটি ড্রামভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা বারুদ উদ্ধার করেছিলেন।


ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার টেংরাটিলা (বৃহত্তর সিলেটের টেংরাটিলা নয়) বিডিআর ক্যাম্প সংলগ্ন রামচেঙ্গা ক্যাম্পের কমান্ডার মৃদুল মারাক।


নেত্রকোণার দুর্গাপুর থানার সীমান্ত ঘেঁষে কোচপাড়া টিলা ক্যাম্প। কমান্ডারের দায়িত্বে আছেন ‘মিঃ ওয়াশিংটন’ (ছদ্ম নাম)। এ ক্যাম্পেই স্থানীয় যুবলীগ নেতা আদিবাসী যুবক দীপক সাংমাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়-২০০২ সালের জুলাই মাসে।
শেরপুর নালিতাবাড়ি  সন্ধ্যাকুড়ি রাবার বাগান ঘেঁষে গড়ে ওঠে রবিন ক্যাম্প, ২০০৫ সালের শেষ দিকে। এ ক্যাম্পের কমান্ডার রবিন চাম্বুগং।


ধোবাউড়া ক্যংপাড়া খ্রিস্টান মিশনের অদূরে একটি কাবঘরকে উলফা ক্যাম্পে পরিণত করা হয় ২০০৫ সালের শুরুর দিকে । এর কমান্ডারের নাম মন্ট্রিল ঘাঘরা।


দুর্গাপুরের পাঁচ কাহানিয়া গুচ্ছগ্রাম ঘেষা সীমান্তের ওপ্রান্তেই বাঘমারা-২ ক্যাম্প ও জামালপুরের বকশীগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় হাড়িয়াকোণা ক্যাম্প দুটির কমান্ডারের নাম সংগ্রহ করা যায়নি।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।