ঢাকা: বাঙালির নতুন স্বপ্ন দেখার ক্ষণ বৃহস্পতিবারের ভোর। কাঁদামাটির বাঙালির উৎসবের দিন এটি।
‘এসো হে বৈশাখ এসো, এসো, এসো /তাপস নিঃশ্বাস বায়ে... মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক.../মুছে যাক গ্নানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ রবি ঠাকুরের এই স্বর্ণরচনা এ গানটি বাঙালির প্রতিটি গলায় বেজে ওঠে।
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড় ... তোরা সব জয়ধ্বনি কর। ’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষুরধার লেখা বাঙালির অন্তরের সেøাগান।
নববর্ষ উদযাপনে রাজধানীসহ সারাদেশ এখন উৎসবে মাতোয়ারা।
বিভিন্ন স্থানে বসেছে বৈশাখী মেলা। পটুয়া আর মৃৎশিল্পীরা মেলায় নিয়ে আসছেন তাদের বাংলার চির ঐতিহ্যের সম্ভার। সেই সঙ্গে থাকছে নাগরদোলায় চড়া আর পতুল খেলা দেখার ব্যবস্থা।
রাজধানীর রমনার বটমূলে কাকডাকা ভোরে নববর্ষকে আবাহনী গান রাজধানীবাসীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। নববর্ষের দিন সমগ্র রাজধানীর পথ মিশে গেছে রমনায় এসে।
নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে বলেন, ‘বাংলা নববর্ষ চিরায়ত বাংলার বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যে লালিত এক অনন্য দিন। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা মাস ও তারিখের ভূমিকা চিরন্তন। তাই পহেলা বৈশাখের আবেদন সর্বজনীন। ’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ‘নববর্ষ মানেই লোকায়ত বাঙালি সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য উৎসব। প্রাণে নতুন উদ্যম সঞ্চরণের প্রেরণা। নুতন আশায় উদ্দীপ্ত হওয়ার নির্ঘণ্ট। ’
তিনি বলেন, ‘বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনার আধার। এ চেতনাকে নস্যাৎ করার জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। আঘাত করা হয়েছে। বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো অপচেষ্টাই সফল হয়নি। বাঙালি জাতি তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। ’
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। ’
বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে নববর্ষের বিশেষ সংখ্যা। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেসঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন, ব্যবসায়ীদের হালখাতা।
কৃষির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই সন প্রবর্তনের সূচনা থেকেই। ঋতুর ওপর ভিত্তি করেই হয় ফসলের চাষাবাদ। কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হলে সারাদেশে একটি অভিন্ন সৌর বছরের প্রয়োজন। এই ধারণা থেকেই সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময়, অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিল নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো আচার অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন আয়োজন।
১৯৬৫ সাল থেকে রমনার বটমূলে প্রতি বছর ছায়ানট বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা নগরীতে নতুন তাৎপর্য পায়। একে একে আরও অনেক সংগঠন প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে এর সঙ্গে।
ছায়ানট: ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছরের মতো ১৪১৮ সালের প্রথম প্রভাতে রমনার বটমূলে ছায়ানট নতুন বছরকে গান ও পাঠের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানায়। ছায়ানটের শিশু-কিশোরসহ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ছাড়াও অতিথি শিল্পীরা সঙ্গীত ও আবৃত্তি পরিবেশন করে । পরিবেশিত হয় রবীনদ্্রনাথ, নজরুল, অন্য তিনকবির গান ও লোকগীতি।
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারে ব্রতী ছায়ানট এ বছর পঞ্চাশ বর্ষে পদার্পণ করে।
শিল্পী-শ্রোতা-দর্শকদের নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী এ বছরও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এ বছর বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার এ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে।
চারুকলা: প্রতিবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে পহেলা বৈশাখ সকালে বের হয় মঙ্গল শোভা যাত্রা। আর এই শোভা যাত্রাকে বর্ণাঢ্য করতে চারুকলার শিক্ষার্থীর তৈরি করেছেন বাঙ্গালী ঐতিহ্যের নানা শিল্পকর্ম।
এর মধ্যে রয়েছে- বিশালাকায় ময়ূর, কাকাতুয়া, লোকজ পাখি, বাঘের মুখে বকের ঠোঁট, মাছ, ঘোড়া, গ্রামীণ বধু, নৌকা ইত্যাদি। এছাড়া শোভা যাত্রায় থাকছে রাজা- রানী-উজির-নাজিরের মুখ, টেপা পুতুলের মুখ, পেঁচা, খরগোশ, ছোট পাখি, চশমা প্রভৃতি।
এছাড়া রাজধানীসহ বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও গ্রামীণ লোকজ মেলার আয়োজন করে সরকার। কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবার (এতিমখানায়) উন্নতমানের খাবার পরিবেশন, শিশুদের নিয়ে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১১