ঢাকা: ১ম শ্রেণীতে পড়ুয়া ৭ বছরের শিশু আবির অন্য শিশুদের থেকে আলাদা। তার চাহিদাও একুট বেশী।
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন প্রতিবন্ধী আবিরের স্কুলশিক্ষিকা মা সুফিয়া বেগম।
নিজের চাকরি করার কারণে সন্তানের জন্য বের করতে পারেন না আলাদাসময়। এমন নানারকম সমস্যায় থাকে প্রতিবন্ধীদের পরিবার ও প্রতিবন্ধীরা ।
শুধু প্রতিবন্ধী শিশুরা নয়, বড়দেরও সমস্যা কম নয়। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা শিক্ষাক্ষেত্রে--এমনটা মনে করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ভিজ্যুয়ালি ইম্পেয়ার্ড পিপলস সোসাইটির (ভিপস) সভাপতি মোশাররফ হোসেন মজুমদার ।
তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের মূল ধারার শিক্ষার বাইরে রেখে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য বিশেষায়িত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের মূলধারায় বাধ্যতামূলক ভর্তির সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।
প্রতিবন্ধীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারিভাবে আলাদা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় নানা সংকটের কারণে তাদের আর উচ্চশিক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়।
বিদ্যালয়ের প্রতিকূল পরিবেশ, পরিবার থেকে উৎসাহের অভাব, ভর্তি করার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহা, সর্বোপরি দারিদ্র্য এ বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় পা রাখতে দিচ্ছে না।
অথচ বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী, শিক্ষা এদেশের সব মানুষের মৌলিক অধিকার।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শেখার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন ব্রেইল পদ্ধতি, ব্রেইলে মুদ্রিত বই, টেপ রেকর্ডার, ক্যাসেট, রাইটিং ফ্রেম, ছবি ও অন্যান্য শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ অপরিহার্য। কিন্তু এসব উপকরণের অধিকাংশই আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। যেসব উপকরণ পাওয়া যায়, তাও ব্যবহার অনুপযোগী এবং দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
কোনো প্রতিষ্ঠানে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের উপযোগী টয়লেট এবং সিঁড়িতে র্যাম্পের ব্যবস্থা নেই ।
দোতলা বা তার বেশি উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে লিফট না থাকলে ওরা মহাবিপদে পড়ে। এভাবে কর্মক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে ।
প্রতিবন্ধীদের জন্য যুগোপযোগী সরঞ্জাম সরকারের পক্ষ থেকে দেয়ারও কোনও ব্যবস্থা নেই ।
আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৃথক বা সম্মিলিত কোন চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানসিক বিকাশও হয় না।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ ও দেশে ২০০১ সালে প্রণিত প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইনে তফসিল ধারা ২(খ) এবং ৬(২) এর ঘ ধারাতে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার কথা উল্লেথ করা হয়েছে ।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসীসহ বিভিন্ন কোটায় ভর্তির ব্যবস্থা থাকলেও নামিদামি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রতিবন্ধীদের জন্য সে ব্যবস্থা নেই।
জাতিসংঘ প্রণিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদের ২৪নং ধারায় বলা হযেছে পড়ালেখার জন্য প্রতিবন্ধী হওয়াটা যেন বাধা না হয়।
১৯৭৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষার জন্য ঘোষিত ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধীদের অধিকার হিসেবে যে দশটি বিষয় বিবেচনা করা হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে: ১. পারিবারিক জীবন ২. আশ্রয় ৩. খাদ্য ৪. শিক্ষা সম্পৃক্ততা ৫. শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ ৬. অবসর জীবন ৭. সরকারি সেবা ৮. সংগঠন ৯. আর্থিক সুযোগ সুবিধা ১০. রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা।
কিন্তু সেসবের বাস্তবায়ন নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মুহাম্মদ সামাদ।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, জাতিসংঘ সনদ বাংলাদেশ সরকার এই দেশে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিবন্ধীদের পরিবার, সমাজ ও জাতির বোঝা করে রেখে সমৃদ্ধির পথে এগোনো যাবে না। তাদের মধ্যেও লুকিয়ে আছে অনেক সম্ভাবনা। তারাও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।
ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব ডিজঅ্যাবল্ড পিপল অর্গানাইজেশনস(ন্যাডপো)সভাপতি ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) এর নির্বাহী পরিচালক আবদুস সাত্তার দুলাল বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আগামী অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটের ১০ ভাগ বরাদ্দ দিতে হবে ।
অবকাঠামোগত সুবিধাদি একজন প্রতিবন্ধীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে কোন প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য উপযোগী কোন অবকাঠামো নেই।
দি ডিজএ্যাবল্ডের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন সোহেল বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। ১ কোটি ৬০ লক্ষাধিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ০.১০% যা অপর্যাপ্ত । তাই এ খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে ।
এ ব্যপারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রনজিৎ কুমার বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। তাই এ খাতে নানা সংকট সত্বেও আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি।
খুব দ্রুত সরকার জাতীয় ব্রেইল প্রিন্টিং প্রেস ও ইশারা ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, যানবাহনের ব্যবস্থা, প্রতিবন্ধী নিবাস, সহায়ক উপকরণ উৎপাদন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। আমরা এসব ব্যপারে পরামর্শের জন্য প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোর পরামর্শ নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১১