ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

অর্পিত সম্পত্তি সংশোধন আইন নিয়ে ধূম্রজাল কাটছে না

নিয়াজ জামান সজীব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১১
অর্পিত সম্পত্তি সংশোধন আইন নিয়ে ধূম্রজাল কাটছে না

ঢাকা: অর্পিত সম্পত্তি আইন বা শত্রু সম্পত্তি আইন নিয়ে ধূম্রজাল কাটছে না। দেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো আইনটি সংশোধনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় এ ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।



এতে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি এ আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে আছে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়।

জাতীয় সংসদের সদ্য সমাপ্ত শীতকালীন অধিবেশনে আইনটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইনটি সংসদে উত্থাপন করতেই ব্যর্থ হয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে এ আইনের সংশোধনী  নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে রশি টানাটানি চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা।

তাদের অভিযোগ, দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলারা চান না আইনটি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দাবি অনুযায়ী সংশোধিত হোক।

ঐক্য পরিষদের ৭ দফা দাবির মধ্যে ২ টি দফা আমলারা মানতে চাচ্ছেন না বলে অভিযোগ নেতাদের।

এর মধ্যে তিন নম্বর ও পাঁচ নম্বর দাবি।

তিন নম্বর দাবিতে রয়েছে ‘সরকারের ১/১ খাস খতিয়ানভুক্ত করে যেসব সম্পত্তিকে অর্পিত করা হয়েছে, তা অর্পিত নয় বলে নির্দেশ দিতে হবে। ’

আর পঞ্চম দফা দাবিতে বলা হয়েছে ‘প্রয়োজন মতো প্রত্যেক জেলায় গঠিত বিশেষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে যথাযথ শুনানি ও নিষ্পত্তির মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে মামলার নিষ্পত্তি কিংবা হাইকোর্টে আপিল শুনানির জন্য সময়সীমা ১৮০ দিনের বেশি হবে না। ’

ঐক্য পরিষদের এ দু’টি দাবি মানা হলে বিভিন্ন সময়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দকৃত শত্রু সম্পত্তির বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে।

এ কারণেই আমলারা দফা দু’টি মানতে চাচ্ছেন না বলে জানান নেতারা।

এদিকে, ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ধারা দু’টির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে মন্ত্রণালয় কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। তাই আগামী অধিবেশনে এ আইনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি অনুযায়ী সংশোধিত হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

অথচ ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, এ দু’টি ধারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধারা দু’টি অন্তর্ভুক্ত না হলে আইনটি সংশোধন করেও তাদের সম্পত্তি বাঁচানো যাবে না।

ভূমি প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা এবং ভূমি মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক এমপি ঐক্য পরিষদের নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে তিন বার বৈঠক করে আইনটি তাদের দাবি অনুযায়ী সংশোধনের কথা দেন।

এ ব্যাপারে ঐক্য পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় দায়িত্বপ্রাপ্তরা সব দাবি মেনে নেন। অথচ সেটাকে আইনে পরিণত করার ব্যাপারে তাদের কোনও উদ্যোগ এখনও আমরা দেখিনি। ’

সেইসঙ্গে আইনটি তাদের দাবি অনুযায়ী সংশোধন হবে কি-না, সে ব্যাপারেও তিনি সন্দিহান।

তিনি বলেন, ‘আমরা সন্দিহান হয়ে পড়ছি সরকার তাদের কথা রাখবে কি-না। ‘

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ’

তবে ভূমি প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা এ ব্যাপারে আশাবাদী।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অর্পিত সম্পত্তি আইনটি সংশোধনের ব্যাপারে সচেষ্ট। বিষয়টি নিয়ে ঐক্য পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আগামী অধিবেশনে আইনটি সংসদে উঠলে সেখানে আলোচনার প্রতিফলন দেখা যাবে। ’

এদিকে, আইনটির ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশও রয়েছে। আগের সরকারগুলোর নানা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ সত্ত্বেও আইনটির অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

আরতি রানী পাল বনাম সুদর্শন কুমার পাল এবং অন্যান্য মামলায় (৫৬ ডিএলআর ৭৩ (এডি), সুপ্রিম কোর্ট মত প্রকাশ করেন, শত্রু সম্পত্তি আইন অর্ডিন্যান্স নং ১৯৬৯ এর ১ রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে  আইনটি আপনাআপনি বাতিল হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর হতে নতুন কোনও সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা যাবে না এবং ওই আইনের আলোকে যা ইতোমধ্যে মৃত।

শত্রু সম্পত্তি আইন সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ (৫৮ ডিএলআর, পৃ. ১৭৭) মামলার ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন।

রায়ে বলা হয়েছে, ‘শত্রু সম্পত্তি একটি মৃত আইন, এর ভিত্তিতে নতুন করে কোনও সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা বেআইনি।

অর্পিত সম্পত্তি সংশোধন আইন নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করে যাওয়া নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত  বাংলানিউজকে বলেন, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সুপ্রিম কোর্টের আদেশটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। তখনকার কিছু অসাধু আমলার সঙ্গে যোগসাজশে দেশবিরোধী চক্র ‘৭৭ সাল থেকে এ সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে শুরু করে, যা এখনও চলছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এবার সঠিক উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে কী হতে পারে তা আমি ভাবতে পারছি না। ’

সরকারি হিসাব মতে, সারা দেশে সাড়ে ৬ লাখ একর অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১৭ হাজার একর সম্পত্তি সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইজারা দেওয়া হয়েছে।

ড. আবুল বারাকাতের ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বঞ্চনা, অর্পিত সম্পত্তির সঙ্গে বসবাস’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ আইনের ফলে সারা দেশে মোট ২৭ লাখ হিন্দুখানার মধ্যে ১২ লাখ (শতকরা ৪৪ ভাগ) খানা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আর ভূমিচ্যুতির পরিমাণ ২৬ লাখ একর। যা মোট মালিকানার ৪৫ ভাগ। ক্ষতিগ্রস্ত ২৬ লাখ একরের মধ্যে ৮১ ভাগ কৃষি জমি, ১১ ভাগ বসতভিটা, ২ ভাগ পুকুর, ১ ভাগ পতিত জমি।

এসব জমির বাজার মূল্য (২০০৭ সালের বাজার মূল্যে) ৩ লাখ ১০ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা।

ড. আবুল বারাকাত বলেন, ‘যাদের সম্পত্তি তারা যদি সেটা না পায় তবে তা দুঃখজনক। আর বর্তমান সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক বলে আমি জানি। স্বাধীনতার আগে করা একটি আইন দেশের জনগণকে ভিটে ছাড়া করছে আর সেটা সরকার অবশ্যই চাইবে না। ’

১৯৪৭ সালে এ দেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৯ ভাগ ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়। বর্তমানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯ দশমিক ৬ ভাগে। এদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী ভারতে চলে গেছেন।

এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএসএম আতিকুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে দক্ষ, কম দক্ষ ও অদক্ষ জনগোষ্ঠী অন্য কোথাও চলে গেছে দেশের মানবসম্পদের ক্ষতি হয়। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।