ঢাকা: স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ঢাকার আদালতে বিচারাধীন মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। যদিও অপরাধ প্রমাণ ও মামলার ফলাফল নির্ভর করে সঠিক ও অবিকৃতভাবে আদালতে আলামত উপস্থাপন করার ওপর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরাতন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত প্রাঙ্গণের অর্ধেকটাতেই এখন এরকম অসংখ্য আলামতের স্তুূপ। দিনের পর দিন পড়ে থাকায় এখন অনেক আলামত নষ্ট হচ্ছে। কোনো কোনোটিতে ধরছে মরিচা।
বেশ ক’টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার অভিযোগপত্র ও জব্দ করা আলামত একসঙ্গে আদালতে পাঠানোর বিধান থাকলেও মালখানায় জায়গা না থাকায় তা তারা পাঠাতে পারছেন না। ফলে দিন দিন থানায় বাড়ছে জব্দ করা গাড়ি, মটরসাইকেল, রিকশা, সাইকেলসহ অন্যান্য আলামতের স্তুপ।
ছোট ছোট আলামত মালখানায় স্থান পেলেও বাইরে পড়ে থাকায় বড় আলামতগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। সংরক্ষণের অভাবে আলামত চুরি যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
ঢাকা জেলা আদালতের পরিদর্শক রবীন্দ্র নারায়ণ সাহা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানান, ‘এখানে বছরের পর বছর আলামত জমতে থাকে। মামলা নিষ্পত্তির পর রায়ের কপি না পাওয়ায় আলামত হস্তান্তর কিংবা ধ্বংসের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ফলে নতুন আলামত রাখার জায়গা হচ্ছে না। ’
তিনি আরও জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৩ ধারার বিধানমতে দায়রা আদালতের সিদ্ধান্ত ও দ-াদেশের নকল জেলা হাকিমের কাছে পাঠানোর বিধান রয়েছে। ওই রায়ের একটা কপি মালখানায় পাঠালে সে অনুযায়ী আলামতগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো।
৩০ বছর আগের মামলার আলামতও মালখানায় রয়েছে বলে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানান মালখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা জানান, ১৯৮০ সালে সাভার থানায় দায়ের করা একটি মামলার ২৭(১) আলামত হিসেবে উদ্ধার করা একটি পয়েন্ট ৩৮ বোর রিভলবার, ছয় রাউন্ড গুলি, ম্যাগাজিনে পয়েন্ট ২৫ বোরের গুলিভরা একটি পিস্তলসহ আরও অনেক মামলার অসংখ্য আলামত আজও মালখানায় পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। হয়তো মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে; কিন্তু রায়ের কপি না পাওয়ায় বছরের পর বছর আলামতগুলো মালখানায় পড়ে আছে।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মামলায় আলামত হিসেবে জব্দ করা ১৬ থেকে ১৭ লাখ টাকা একটা সাধারণ স্টিলের আলমারিতেই রাখা ছিল এতোদিন। ছিল কয়েকশ’ ভরি সোনাও। শুধু ধামরাই থানার ১৪(১০)২০০৪ নম্বর মামলাতেই ১১৬ ভরি ¯¦র্ণ আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। গত জুনে ঢাকার পুলিশ সুপার এগুলো রাখার জন্য একটা লকারের ব্যবস্থা করে দেন। ’
‘অরক্ষিত অবস্থায় না রেখে এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখছেন না কেন?’ এ প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শুধু সংরণকারী। বিডিআরের মামলায় জব্দ করা স্বর্ণ ও টাকা যেভাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছেন সেভাবে এগুলোও জমা দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের সে মতা নেই। ’
আদালতের নির্দেশ পেলে স্বর্ণ ও টাকা-পয়সা বাংলাদেশ ব্যাংকে, অস্ত্র মিলব্যারাকে ও অন্যান্য আলামত ধবংস কিংবা তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া যায় বলেও জানান তিনি।
এদিকে, ঢাকা জেলা আদালত ও মহানগর আদালতের মালখানায় ঢুকতেই নাকে আসে গাঁজা, বাংলামদ আর ফেন্সিডিলের গন্ধ। জেলা আদালতের মালখানার পাশ দিয়ে হাঁটলেও নাকে রুমাল চাপতে হয়।
মালখানায় আলো ও বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বিশাল কক্ষে একটা বাতি ও একটা ফ্যান। ভেতরে এতোটাই অন্ধকার যে একটা মাত্র বাতি জ্বালিয়ে কোনো মতে চলে কাজ। নিজেদের উদ্যোগে একটা ছোট চার্জার লাইট কিনে এর আলোতে অনেকটা আন্দাজে আলামত খোঁজেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা।
মালাখানা সূত্র জানায়, আদালতের নির্দেশে কোনো কোনো দিন গাঁজা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সেদিন মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত এলাকার বাতাসে শুধুই পাওয়া যায় গাঁজার গন্ধ।
আদালত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সিএমএম আদালতকে ১০ তলায় উন্নীত করার কাজ চলছে। নির্মাণকাজের পানি সিঁড়ি দিয়ে সোজা চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডের মালখানায়। এ পানিতে নষ্ট হচ্ছে মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত।
আদালতের মতো মালখানাও পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দণি অঞ্চলে ভাগ করা রয়েছে। প্রত্যেক অঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছেন পুলিশের একজন করে উপ-পরিদর্শক। শ্রেণীবিন্যাস বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা না থাকায় যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছে আলামতগুলো। সে কারণে কোনো কোনো মামলার আলামত খুঁজতে নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক গুণ লেগে যায়।
মহানগর আদালতের কোর্ট পরিদর্শক মিরাশ উদ্দিনও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে মালখানার সমস্যার কথা জানান।
এ প্রসঙ্গে তিনিও স্থানাভাব আর সময়মতো মামলার রায়ের নকল না পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
মিরাশ উদ্দিন আরও বলেন, ‘মাঝে মাঝে পুলিশ সুপার, মুখ্য মহানগর হাকিম, মুখ্য বিচারিক হাকিম ও অন্য কর্তাব্যক্তিরা এসে মালখানা দেখে যান। তারা এসব সমস্যার বর্ণনা দিয়ে গণপূর্ত বিভাগে চিঠিও লেখেন। তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। অনেক মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত মালখানায় সংরণ করা হলেও এটির উন্নয়নে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০১০