ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ

ইসমাইল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১১
২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ

ঢাকা: রাজধানীতে প্রতি বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ছে। কিন্তু ভাড়াটিয়াদের আয় বাড়ছে না।

তার পরও বছর শেষ হলেই বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়ানোর অজুহাত খুঁজতে থাকেন। লাগামহীন ভাড়া বৃদ্ধিতে ভাড়াটিয়াদের নাভিশ্বাস উঠেছে।

গত ২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ। কিন্তু অস্বাভাবিক হারে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যেন কেউ নেই । বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে না থাকায় আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।  

নতুন বাসায় উঠতে এবং নতুন বছরের শুরুতে ভাড়াটিয়াদের বাড়তি ভাড়া গুণতে হয়। বাড়িওয়ালারা ভাড়ার নির্দেশনা তো মানছেই না, উপরন্তু এ সংক্রান্ত একটি আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই।

ভাড়ার অর্থ যোগান দিতে না পেরে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন ছোট বাসায় থাকতে। অনেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নিজে ভাড়ার টকা যোগাতে না পেরে সাবলেট হিসেবেও ভাড়া দিচ্ছেন। পরিণামে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য মতে, রাজধানীর ৮৩ শতাংশ বাসিন্দাই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আর প্রতি বছর তাদের দিতে হচ্ছে বর্ধিত ভাড়া।

জরিপ রিপোর্টের তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে ভাড়া বেড়েছে ২৫.৭৯। ১৯৯১ সালে ২১.৭৫, ১৯৯২ সালে ১৩.৪৩, ১৯৯৩ সালে ১২.১৬, ১৯৯৪ সালে ১৬.৪৪, ১৯৯৫ সালে ২২.৬১, ১৯৯৬ সালে ১৭.৮৬, ১৯৯৭ সালে ১৫.০৩, ১৯৯৮ সালে ১৪.০৯, ১৯৯৯ সালে ১৮.২৪, ২০০০ সালে ১৫.০৮, ২০০১ সালে ১৭.০৪, ২০০২ সালে ১৩.৪৯, ২০০৩ সালে ৮.০৪, ২০০৪ সালে ৯.৯৬, ২০০৫ সালে ৭.৮৯, ২০০৬ সালে ১৪.১৪ এবং ২০০৭ সালে ২১.৪৮ ভাগ।

জরিপে আরও দেখানো হয়, ১৯৯১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১১৬.৯৬ ভাগ। এই সময়ে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ ২৫৯.৪৫ ভাগ। ২০০৮ সালে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে দ্রব্যমূল্য।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সম্প্রতি ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে জানায়, ঢাকায় বর্তমানে দেড় কোটি মানুষ বাস করছে। এরমধ্যে ১ কোটি ২৬ লাখ ভাড়াটিয়া আর মাত্র ২৪ লাখ মানুষের নিজের বাড়ি আছে। ভাড়াটিয়ারা আয়ের ৬০ ভাগ ব্যয় করেন বাড়ি ভাড়ায়। গত ২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ। তাদের অভিযোগ, বাড়িভাড়ার আইন থাকলেও এর কোনও প্রয়োগ না থাকায় মালিকরা দিন দিন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে।

এদিকে ১৯৬৩ সালে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে একটি অধ্যাদেশ জারি হয়। এর অধীনে ১৯৬৪ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করা হলে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তা কার্যকর ছিল। ওই সময় বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করা হয় ৩ বছরের জন্য এবং ১৯৯১ সালে বর্তমানে প্রচলিত বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি জারি করা হয়।

সংগঠনের পক্ষে বাড়ি ভাড়া অধ্যাদেশ সংশোধন, প্রতি ওয়ার্ডে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নিয়োগ, জোন ওয়ারি ভাড়ার তালিকা টাঙানো ও ভাড়া বৃদ্ধির হার নির্দিষ্ট করার দাবি তুলে ধরা হয়।

অন্যদিকে ১৯৯১ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই মহানগরীকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি)।

প্রধান সড়কের পাশে, গলির তিন শ’ ফুটের মধ্যে এবং গলির তিন শ’ ফুটের বাইরের ভাড়া আলাদা করা হয়। এই তিন ক্যাটাগরিকে আবার আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং শিল্প- এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়া বাড়ির হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়, নির্মাণশৈলী, অবস্থানের শর্তের উপর ভিত্তি করে ভাড়ার তালিকাও নির্ধারণ করা হয়।

কিন্তু ডিসিসির এই নিয়ম কেউ মানছে না। নতুন বছরের শুরুতে এবং ভাড়াটিয়া পরিবর্তন হলেই বাড়তি ভাড়ার চাপ আসে ভাড়াটিয়ার ঘাড়ে। এছাড়া ব্যাচেলরদের বেলায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি ভাড়াও বেশি নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিসিসি শুধু বাড়ি ভাড়ার ওপর কর নেয়। ভাড়ার তালিকা ওয়েবসাইটে দেওয়া হলেও তা মেনে চলতে বাধ্য করার মতো আইন ডিসিসির নেই। বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর যুক্তি সঙ্গত কারণ  নেই, এ ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মিরপুর পল্লবী এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বেসরকারি সংস্থার চাকুরিজীবী এরশাদ হোসেন। তিনি জানান, কোনও নোটিশ ছাড়াই সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়িয়ে দেন। বর্ধিত ভাড়া তার মাসিক বেতনের অর্ধেকের সমান। অতিরিক্ত ভাড়া দিতে না পেরে অক্টোবরে তিনি বাসা ছাড়তে বাধ্য হন।

মোহাম্মদপুরের আরেক বাসিন্দা একটি কর্পোরেট কোম্পানির কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, বাড়ি ভাড়ার জন্য মাসিক বেতনের প্রায় অর্ধেক চলে যায়। এতো ভাড়া দিলে পরিবার-পরিজনের খরচ মেটাবো কি করে? তার মতে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও এর প্রয়োগ জরুরী।

এদিকে অনিয়ন্ত্রিত ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ি করেছেন নাগরিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের সম্পাদক তুষার রহমান বলেন, বাড়ি ভাড়া আইনটির নতুন কোনও বিধি প্রণীত হয়নি। ফলে ১৯৬৪ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাই কার্যকর রয়েছে। আইনটিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে নতুন বিধি প্রনয়ন ও প্রয়োগের দাবি জানান।

ক্যাবের চেয়ারম্যান কাজী ফারুক বলেন, গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় কাজের সন্ধানে মানুষ রাজধানীমুখী হচ্ছে। এতে আবাসন সমস্যা আরও বাড়ছে। বেপরোয়া বাড়ি ভাড়া সমাজে অন্যায় ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে।

তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার সুরাহা হয়নি। সব দিক থেকে ভোক্তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন জানিয়ে তিনি এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।