ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বুয়েটে দুই ছাত্রের আজীবন বহিষ্কার:

লেজুড়বৃত্তি আর নৈতিক অবক্ষয়ের ফল

মহিউদ্দিন মাহমুদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১২
লেজুড়বৃত্তি আর নৈতিক অবক্ষয়ের ফল

ঢাকা: দেশের সর্বোচ্চ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের ছাত্ররাও কলুষিত লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির পথ ধরে নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশয় বা নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে চলছে অযথা শক্তি প্রদর্শনের মহড়া।

অথবা তুচ্ছ বিষয়েও হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে দেবার প্রবণতা। এসব প্রবণতা থেকেই বড় ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে ছাত্ররা।

এর ফলে গত ২৮ ডিসেম্বরে নগণ্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বুয়েটের ছাত্ররা অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিয়ে বসে। এর পরিণতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ০৬ ব্যাচের ঈশানের হাত-পা ভাঙার ঘটনা ঘটে। আর ০৮ ব্যাচের সুজিত এবং মিঠুনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। উভয় পক্ষেরই ছিল প্রভাব খাটানো আর শক্তি প্রর্দশনের প্রতিযোগিতা।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. এস.এম. নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর হঠাৎ করে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকে। একই সাথে তাদের মধ্যে অতি মাত্রায় দলে ভিড়ে যাবার প্রবণতা দেখা দেয়। ’

‘তারা চলমান বিভিন্ন লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতিসহ বিভিন্ন স্বাংস্কৃতিক সংগঠনে মিশতে শুরু করে। রাজনৈতিক দলগুলোও এই ছাত্রদের দলে ভেড়ানোর জন্য পিছু পিছু লেগে থাকে। ফলে দুর্বল নৈতিক ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ছাত্রদের দ্রুত চারিত্রিক অবক্ষয় হয়। ’--বলেন তিনি।

এ সময় তিনি লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা এবং ছোটবেলা থেকেই ছাত্রদের নৈতিক চরিত্রের শক্ত ভিত তৈরি করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা যাতে অপরাধ প্রবণ না হয় সে জন্য কাউন্সেলিং করার কথা বলেন তিনি। আগামীতে বুয়েটে এধরনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

র‌্যাগ কনর্সাটে মাদকের ব্যবহার :

বুয়েটের ০৬ ব্যাচের ছাত্রদের বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত গত ২৮ ডিসেম্বর র‌্যাগ কনসার্ট উপভোগ করতে যাওয়া ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ ঐ দিন মাদক সেবন করেছে। যাদের বড় একটা অংশের জন্য এটা ছিল জীবনের প্রথম বার মাদকসেবন। উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং সাধারণ ছাত্রদের কাছ থেকে এই তথ্য জানা যায়। এছাড়া ছাত্র নেতাদের কাছ থেকেও একই ধরনের তথ্য জানা যায়।

এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম হলের সিনিয়র সুপারভাইজার আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, ‘ কনসার্টটি ক্যাফেটেরিয়ায় হয়েছে। জানি না সেখানে কি হয়েছে। তাছাড়া আমাদের কাছে কেউ কিছু বলেনি। ’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুই একজন হয়তো সেবন করেছে। এ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে কানাঘুষা হতে দেখেছি। ’

বিচারে সাধারণ ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া:

এ বিচারকে স্বাগত জানিয়েছে ছাত্ররা। ছাত্রদের বক্তব্য এ ধরণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া হলে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস থাকতো না। এরকম বিচারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত বিচারের ক্ষেত্রে সকল প্রকার আবেগ বা দলীয় প্রভাবের উর্ধ্বে থাকা।

তবে অনেকেই চায়নি সুজিত, মিথুন আজীবন বহিষ্কার করা হোক। তাদের বক্তব্য: বুয়েটে মেধাবীরাই আসে। এজন্য অপরাধীদের ছাত্রজীবন একেবারে নষ্ট হওয়ার চেয়ে দেড় বা দুই বছরের অথবা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিষ্কার করে তাদের সংশোধনের সর্বশেষ সুযোগ দেয়া যেতে পারতো।

বুয়েটের ছাত্রলীগ প্রতারণা করেছে: সুজিতের বড় ভাই

সুজিতের বড় ভাই সাগর সাহা বাংলানিউজকে বলেন, বুয়েটের ছাত্রলীগ সুজিত এবং মিঠুনের সাথে প্রতারণা করেছে। এতদিন এরা ছাত্রলীগের জন্য নি:স্বার্থভাবে কাজ করে গেলেও এ বিপদের সময় তাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।

তিনি নিজেকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির সদস্য পরিচয় দিয়ে বলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের মধ্যে ইজম কাজ করেছে। কলেজ সভাপতি নিজেও চায়নি এরা স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হোক। কিন্তু ব্যাচপ্রীতির কারণে সহযোগিতাতো করেইনি। বরং এরা ছাত্রলীগেরই নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সুজিত, মিঠুন বলেন, আগামী কমিটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি মিশু বিশ্বাস আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব দিয়েছিল এবং মিঠুনকে দপ্তর সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি।

এ প্রসঙ্গে সেক্রেটারী তন্ময় আহমেদ বিষয়টি স্বীকার করেন।

পুরো ঘটনাটা যেভাবে ঘটেছিল:

২৮ ডিসেম্বরে রাতে বুয়েটের র‌্যাগ কনসার্টে বসা নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। ঐদিন রাতে কনসার্টে অনুষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে ০৬ ব্যাচের ঈশানের সাথে ০৮ ব্যাচের সুজিত এবং মিঠুনের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ০৬ ব্যাচের আরো কয়েকজন এ বির্তকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় উভয়পক্ষ একে অপরকে আক্রমণাত্বক কথা বলে। এর এক পর্যায়ে সুজিত, মিঠুনসহ তার সাথের বন্ধুরা স্থান ত্যাগ করে।

এর পর মধ্যরাতের দিকে ০৬ ব্যাচের ১৫/২০ ছাত্র নজরুল ইসলাম হলে গিয়ে সুজিত, মিঠুনকে মারধর করে। এরপর তারা সাময়িকভাবে হল ত্যাগ করে এবং এ বিষয়ে ২৯ ডিসেম্বর ০৬ ব্যাচের ইপ্তি, নাহিয়ান, জিয়া, মিথুন, সৌরভ, শোভন, রাফি ও সৌমিকের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় একটা অভিযোগও দাখিল করে সুজিতরা।

এরপর ৩১ ডিসেম্বর দুপুরে সুজিত ও তার বন্ধু মিঠুন সি.এস.ই বিভাগের ছাত্র তৌসিফ আহমেদ ঈশানকে রড, বেসবল ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। হাত-পা থেঁতলে যাওয়া ঈশানকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এদিকে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ০৬ ব্যাচের সাথে অন্য ছাত্ররা সুজিত ও মিঠুনকে না পেয়ে তাদের বন্ধু দীপ ও জয়কে মারধর করে এবং সুজিত ও মিঠুনের রুমে ভাংচুর চালায়।

একই সাথে ঈশানের উপর হামলাকারী সুজিত, মিঠুনও দীপকে বহিষ্কারের দাবিতে ৩.৩০ টার দিকে বুয়েটের ছাত্র-ছাত্রীরা উপ-উপাচার্যের কার্যালয়ে অবস্থান নেয়। ভিসি কার্যালয়ের সামনে তাদের অবস্থান অব্যাহত রাখে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ ডিসেম্বর কর্তৃপক্ষ তিনজনকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করে। আন্দোলন অব্যাহত থাকায় ১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৪ সদস্যের একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং ২ ডিসেম্বরের সকালের মধ্যে তদ্ন্ত রিপোর্ট দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সাথে ঈশানের চিকিৎসাব্যয় বহন করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রশিদ সরকার (আহ্বায়ক), একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল ইসলাম, তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম শহীদুল হাসান এবং সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান।

তদন্ত কমিটি পরদিন ২ ডিসেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটির ধারা অনুযায়ী আগের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে সাইফুল্লাহ সিকদার মিঠুন এবং সুজিত সাহাকে আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। এর আগে কমিটি অভিয্ক্তু ছাত্রদের সাক্ষ্যগ্রহণ করে।

বুয়েট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা:

বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গেলে বুয়েট কতৃপক্ষের অসহযোগী মনোভাব ছিল প্রথম থেকে। শাস্তিপ্রাপ্ত, শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাওয়া এবং আহত ঈশানের ঠিকানাসহ বেশ কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং সেখানকার একজন কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরে গেলে এসব তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানায়। ভিসি ভবন থেকে ছাত্রকল্যাণ ভবনে গেলে সেখানে সেখানকার পরিচালককে পাওয়া যায়নি। প্রশাসনিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে এসব তথ্য কোথায় থাকে তিনি জানেন না উল্লেখ করে এ বিষয়ে হলে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দেন। হলে গেলে কর্তৃপক্ষের কেউ নেই বলে জানান একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী।

রেজিস্টার প্রফেসর ড. আবু সিদ্দিকের সাথে কথা বললে তিনি ভিসি’র কাছে লিখিত আবেদন জানাতে বলেন। এপর্যায়ে রেজিস্টার নিজেই ভিসি এস.এম. নজরুল ইসলামের সাথে কথা বলে ছাত্রকল্যাণ থেকে এ তথ্য নেয়া কথা বলেন। সেখানে গেলে ছাত্র কল্যাণের পরিচালক ড. আমিনুল হক তার কাছে এ তথ্য নেই বলে জানান। বেশ কিছুক্ষণ কথাবলার পর তিনি সুজিত এবং মিঠুনের ফোন নাম্বার দেন।

সেখান থেকে ভিসি’র সাথে কথা বলার জন্য ফিরে আসলে রেজিস্টার নিজেই অতিরিক্ত রেজিস্টার মো; গোলাম মোস্তাফার কাছ থেকে নেওয়ার কথা বলেন। সেখানে গেলে গোলাম মোস্তাফা ভিসি’র এবং রেজিস্টারের লিখিত অনুমতি লাগবে বলে জানায়। এর পর রেজিস্টারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার পর তিনি এসব তথ্য দেন।

এদিকে হলে প্রবেশের ব্যাপারেও একে অপরের কাছে যাওয়ার কথা বলে দায় এড়াতে চেয়েছে।

ভিসি’র কাছে অনুমতি চাইলে বলা হয়, হলে ছাত্রের আত্মীয় ছাড়া বহিরাগত কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।

এরই মধ্যে হলে ভাংচুর করা রুম পরিষ্কার ও জানালার ভাঙ্গা কাচ মেরামতের কাজ সেরে ফেলে কর্তৃপক্ষ। এ পর্যায়েও হলে গিয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইলে সরাসরি রাজি হয়নি হল কর্তৃপক্ষ।

অসহযোগিতা সর্ম্পকে ভিসি বাংলানিউজকে বলেন, সদ্য ঘটে যাওয়া সবার মধ্যে ভীতি কাজ করছে। ফলে কেউ মুখ খুলতে চাননি।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৩ ঘন্টা; জানুয়ারী ৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।