ঢাকা: নারগিস, ডলি, ঝিলিক, গুলপাশা, গুলশান, চামেলী। বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে এগুলো আবেদনময়ী কোন ঊর্বশী রমণীর নাম মনে হতে পারে।
নারগিস, ডলিদের সঙ্গে আছে কিছু পুরুষ ঘোড়া। এদেও আছে বাহারি আর গালভরা নাম: হারকিউলিস, অশোক, সাইক্লোন, সম্রাট, পর্বত, গোর্কি, পলাশ ইত্যাদি। এদের মধ্যে পর্বত হচ্ছে কমান্ডার।
অতিথি আপ্যায়নে এরা সবসময়ই জন্য অপেক্ষায় থাকে। এদের চিকিৎসাসেবায় নিযুক্ত আছেন একজন সরকারি পশুচিকিৎসক। আর দেখভাল ও প্রশিক্ষণের জন্য আছেন একজন হাবিলদার। যাকে বলা হয় ‘ওসি ঘোড়া’ (অশ্বারোহী)।
তবে এমন পদবীর জন্য মোটেও না-খোশ নন দায়িত্বরত হাবিলদার আবু হাসান মিয়া। তিনি বলেন, ‘মানুষ শখ করে কতো রকমের প্রাণী পোষে। আমি সরকারি খরচে ঘোড়া পুষি। ঘোড়া খুব প্রভুভক্ত প্রাণী। এক যুগ ধরে এদের সঙ্গেই আছি। দীর্ঘ সময়ে এদের সঙ্গে আমার একটা আত্মার সম্পর্ক হয়ে গেছে। ঘোড়াগুলোও আমাকে চেনে। কাছ দিয়ে গেলে হাত-পা মাথা নাড়ায়। অনেক কথা বলে। যা আমি বুঝতে পারি। এদের একটি চিঁহি-হি শব্দে কী কথা প্রকাশ পায়- তা আমার ধরে নিতে মোটেও কষ্ট হয় না। সন্তানের মতোই এদের আদর-স্নেহ-যত্ন করি। ওদের রোগ-শোক-কষ্ট দেখলে আমিও অনেক কষ্ট পাই। ’
তিনি বলেন, ‘ঘোড়ার দায়িত্ব পালনে আমার ভালোই লাগে। দেশের সব পুলিশ সদস্য কিন্তু ঘোড়া পরিচালনা করতে পারে না। আমি পারি। এটা আমার গর্ব। ঘোড়া পরিচালনার ওপর আমার ৭ মাসের স্পেশাল প্রশিক্ষণও নেওয়া আছে। রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে দীর্ঘ ৩ বছর প্রথম শেণ্রীর অনেক কর্মকর্তাকে আমি ঘোড়া চালনাও শিখিয়েছি। ’
আবু হাসান মিয়া জানান, ‘কেবল রাষ্ট্রপতিকে সম্মান জানাতে চৌকস ঘোড়ার এসকর্ট দিয়ে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। তবে পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোড়ার এসকর্ট পেয়ে থাকেন। এর বাইরে ভিন দেশের কোনও রাষ্ট্রদূত যখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রথম পরিচয়পত্র পেশ করেন তখন তাকে ঘোড়ার এসকর্ট দিয়ে রাষ্ট্রপতির দপ্তর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। ’
রাষ্ট্রদূতের চেয়েও অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। কিন্তু তাদের কাউকেই প্রণাম জানাতে পারেনি ডলি, অশোকরা। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্ক সফরে গিয়েছিলেন। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশে সফরে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। সে খবর দেশের সবাই জানে। জানে হয়তো ডলি, পপি, পর্বতরা। বিশ্বের এমন ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা জানাতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করবে পর্বত-অশোকরা। কিন্তু সে ভাগ্য কি এদের হবে? তবু আশায় বুক বেঁধেছে, যদি মরার আগে অন্তত একবার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখার ভাগ্য হয়!
প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ, ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েই রাজ্য জয়ে বের হতেন বীরেরা। সুুদীর্ঘ অতীত থেকেই ঘোড়ার বিচরণ ছিল এই বঙ্গভূমিতে। বৃটিশ আমলে পাক-ভারতে ঘোড়ার ব্যবহারে ব্যাপকতা আসে। তখন ঘোড়াই হয়ে ওঠে চলাচলের একমাত্র দ্রুততম বাহন। সেপাই-সামন্তরা রাজ্য পাহারা দিতেন ঘোড়া নিয়ে। এককালে পুলিশও চোর-ডাকাত, আসামির পিছু ছুটতো ঘোড়ায় চেপেই। রাষ্ট্রীয় সমন জারিতেও ঘোড়াই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু কালের আবর্তে সেই ঘোড়ার ব্যবহার আর নেই। দেশের কিছু এলাকায় দু’চারটে ঘোড়া রয়ে গেছে বংশানুক্রমিকভাবে। কিন্তু রাজারবাগের ঘোড়াগুলোকে নেহায়েত সৌন্দর্যবৃদ্ধি ও ঐতিহ্যকে জানান দেয়ার জন্যই রাখা হয়েছে- এমনটাই জানিয়েছেন দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঘোড়াগুলোর তদারকির দায়িত্বে থাকা আবু হাসান মিয়া আরো জানান, ঘোড়ার বহুমুখি উপকারি-উপযোগিতা রয়েছে। দাঙ্গা দমনে ঘোড়ার বিকল্প নেই। যদিও আমাদের দেশে তা ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। গত বছরের শেষের দিকে হওয়া বৃটেনের দাঙ্গায় ঘোড়া ব্যবহার করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছিল। যেকোন জনগোলযোগ থামাতে ঘোড়া সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। গেল বছরে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ঘোড়া নিয়ে টহল দেয়া দেয়া হয়েছিল স্টেডিয়াম এলাকায়। এতে কয়েক ধরণের উপকার হয়েছে- প্রথমত, ঘোড়ার ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা গেছে। দ্বিতীয়ত জনতার ভিড় ও ঝামেলা ঠেকাতে সুবিধা হয়েছে।
কীভাবে ঝামেলা ঠেকানো হয়েছে জানতে চাইলে আবু হাসান মিয়া জানান বলেন, ঘোড়াকে দেখে অনেকে ভয় পায়। যে রাস্তা দিয়ে ঘোড়া যায় সেখানে আর কেউ থাকে না। ফলে কোথাও যদি গ্যাঞ্জাম বা লাইন বাঁকা থাকে ঘোড়ার পাহারা গেলে লাইন তরতর করে সোজা হয়ে যায়। আবার অনেকে শখ করে ঘোড়ার সঙ্গে পোজ দিয়ে দুয়েকটা ছবি তুলেও আনন্দ পায়।
পুলিশের একটি পদ হচ্ছে ওসি। যিনি সাধারণত থানার প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ‘ওসি ঘোড়া’ বললে নিজের মধ্যে কোনও হীনমন্যভাব কাজ করে কিনা জানতে চাইলে আবু হাসান মিয়া জানান, ‘বিভিন্ন অফিসার থানায় থেকে পদোন্নতি পেয়ে ওসি হন। তাদের অনেক ব্যস্ততা থাকে। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কিন্তু সত্যিকারের প্রেম থাকে বোবা প্রাণীর মধ্যে। তাকে ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু শেখাতে হয়। কোনও থানার ওসি না হয়ে ঘোড়ার ওসি হওয়ার দায়িত্ব পেয়েছি- এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ দায়িত্ব পালনে আমার ভালোই লাগে। এখানে কারো ওপর বলপ্রয়োগ করতে হয় না। যা কিছু সবটুকুই ভালোবাসা আর কৌশল দিয়েই আদায় করতে হয়। সব অর্জনের মূলে আছে শুধুই আন্তরিকতা আর নিখাদ পশুপ্রেম। ’
তবে তিনি বলেন, ‘আগে ঘোড়া দেখভালের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি জাতিসংঘ শান্তি মিশনে গেছেন। তিনি আসা পর্যন্ত আমিই ওসির দায়িত্বে আছি। ’
এখানকার ঘোড়াগুলোর মধ্যে বাহাদুর সবচেয়ে ভালো রাইডিং ও জাম্প করতো। এটি ছিল আবু হাসানের প্রিয় ঘোড়া। এর পিঠে প্রশিক্ষণ ও কসরত দেখাতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার পড়ে গেছেন। আঘাত পেয়েছেন। এখনো ডান কাঁধের ব্যথাটা বেড়ে গেলে বড় কাবু হয়ে যান তিনি।
তিনি বলেন, ‘বাহাদুর মারা যাওয়ার পর আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেকদিন ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়াও হয়নি। বারবার বাহাদুরের কথা মনে পড়তো। ’
ঘোড়াগুলোকে দিয়ে বিশেষ মহড়ার দিনে বিশেষ যতœও নেয়া হয়। এমন দিনে সুগন্ধি সাবান আর স্বচ্ছ পানি দিয়ে গোসল করানো হয়। খুর, চান্দি ও পালানে (স্যাডেলে) দেওয়া হয় দামি তেল। এতে তাদের চেহারার ঔজ্জ্বল্য আরো বাড়ে। নিয়মিত নোক্তা (লাগাম) পরিষ্কার করা হয়।
তিনি জানান, অনেক সময় ঘোড়া কামড়ও দেয় মানুষকে। এ জন্য ঘোড়ার কাছে গেলে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। বছর দুয়েক আগে তাদেরই এক কর্মচারীর পিঠে কামড়ে ধরেছিল একটি ঘোড়া।
কমান্ডার পর্বত
রাজারবাগের ১৯টি ঘোড়ার মধ্যে একটির নাম ‘পর্বত’। এটি সব ঘোড়ার কমান্ডার। ওসি বলেন, পর্বতের বয়স ২০ ছাড়িয়েছে। বয়সের হিসাবে পর্বত বৃদ্ধ। কিন্তু এখনো তাগড়াই আছে। ভালো রাইড করে এবং দ্রুত সঙ্কেত বুঝতে পারে। রাইডিংয়ে নিয়ে গেলে সবার আগেই প্রস্তুত হয়ে যায়। শক্তিও গায়ে বেশ! এ কারণে এটাকে কমান্ডার বানানো হয়েছে। ’ তিনি এ কমান্ডারকে একটু বেশিই পছন্দ করেন- কথার ফাঁকে ফাঁকে সে কথাও বলে ফেলেন।
যারা আছে রাজারবাগে
১৯ টি ঘোড়া নিয়ে ব্যস্ত আছেন রাজারবাগের ওসি। এটা তার বাহিনী। বাহিনীর সদস্যরা হচ্ছে- গুলশান, গুলপাশা, পর্বত, হারকিউলিস, উর্বশী, নারগিস, চামেলী, আলেকজান্ডার, সাইক্লোন, গোর্কি, পলাশ, অশোক, শিমুল, তমাল, হিজল, কদম, ডলি, পপি এবং ঝিলিক। এদেও মধ্যে নারগিস পিএইচপি পানির পাম্পের বিজ্ঞাপনে অ্যারাবিয়ান হর্সের মডেল হয়েও উপস্থাপিত হয়েছে।
যা খায় রাজারবাগের ঘোড়ারা
রাজারবাগের প্রতিটি ঘোড়ার জন্য খাদ্য বরাদ্দ দেয়া আছে। একটি ঘোড়ার জন্য আড়াই কেজি গমের ভুষি, ১ কেজি ছোলা, ৬৫ গ্রাম আয়োডিনযুক্ত লবণ, ৫০ গ্রাম ক্রিস্টাল লবণ, ২০ কেজি কাঁচা দুর্বা ঘাস এবং পরিমিত পরিষ্কার পানি। এ ছাড়া পরিচর্যা হিসেবে বিচালি বা শুকনো খড়, নারিকেল ও সর্ষের তেল দেওয়া হয়। সব ধরণের খরচ মিলিয়ে প্রতিমাসে একটি ঘোড়ার পেছনে ১৫-২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
অপবিত্রতা বুঝতে পারে ঘোড়া
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে আবু হাসান মিয়া বলেন, ঘোড়া পবিত্রতা-অপবিত্রতা বুঝতে পারে। কেউ যদি নাপাক অবস্থায় ঘোড়ার কাছে যায় বা পিঠে চড়ে তাহলে তার কপালে সেদিন দুর্ঘটনা অনিবার্য। অপবিত্র অবস্থায় পেছনের দিক গেলে ঘোড়া ‘পিছাটি’ (লাথি) মারে। এ জন্য প্যারেডে অনেক অফিসারকে আগে থেকেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়। বিশেষ করে মহিলাদের।
ওসির কষ্ট
রাজারবাগে ১৯ টি ঘোড়ার মধ্যে দুটি ঘোড়া অসুস্থ দীর্ঘদিন ধরে। এদের মধ্যে গত ডিসেম্বরের শেষের সপ্তায় ১৩ বছর বয়সী আলেক্সান্ডার মারা গেছে। চামেলীও মারাত্মক অসুস্থ। জন্মগত কিছু ত্রুটির কারণে শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল এদের। চামেলীর গায়ে টিউমার উঠেছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে ঘা হয়ে গেছে। ফেটে গেছে খুড়গুলোও। চামেলী না পারছে হাঁটতে, না পারছে ঠিকঠাক খেতে। দিন দিন তার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। আলেকজান্ডার যৌবনকালে ভালো রাইডিং করতো। রাইডিংয়ে কয়েকবার পড়ে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত হয়ে যায়। শত চিকিৎসা করেও তাকে বাঁচানো গেল না।
আবু হাসান মিয়া বলেন, ঘোড়াগুলো আমার সন্তানের মতো। রুগ্নদশার কারণে ঘোড়াগুলোর জন্য আমার মধ্যে সবসময়ই অস্থিরতা কাজ করে। প্রতিদিন সকালে এসেই আগে এদের খোঁজ নিই। আলেক্সাজান্ডার মারা গেছে। চামেলীকে সারিয়ে তুলতে সব ধরণের তদবির চালানো হচ্ছে। হয়তো সেও বাঁচবে না। কিন্তু চোখের সমনে ধুঁকে ধুঁকে তার মৃত্যুও দেখতে পারবো না। উপায়ন্তর না পেয়ে একদিন হয়তো চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করেই তাকে চিরনিদ্রায় পাঠানো হবে। কথাগুলো বলার সময় ধরে আসে জনাব আবু হাসানের গলা। এমনটি মোটেও সহ্য করতে চান না তিনি। তিনি চান, রাইডিংয়ে না আসুক, সুস্থ হয়ে অন্তত আস্তাবল আলো রাখুক চামেলী।
চিকিৎসক যা বললেন
ঘোড়ার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ডা. মো. ইদ্রিস আলী জানান, প্রাকৃতিকভাবেই ঘোড়া অনেক শক্তিশালী। তাদের শক্তির ওপর ভর করেই বিভিন্ন শক্তির নির্দেশ করা হয়। তিনি বলেন, অন্য প্রাণী থেকে ঘোড়ার মাসল্ (পেশী) এবং প্রতিটি জোড়া ব্যতিক্রম। কোষগুলোও শক্ত। এ কারণেই ঘোড়া এতো শক্তিশালী। তবে তিনি রাজারবাগের ঘোড়াগুলো বাসস্থান নিয়ে কিছু সমস্যার কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ঘোড়াকে মাসে ১৫ দিন মাটিতে রাখা উচিত। কিন্তু এখানে সে ব্যবস্থা নেই। সবসময়ই তাদের টিনের শেডে রাখা হয়। এ কারণে অনেক সময় সঠিকভাবে মুভ করতে পারে না ঘোড়াগুলো। আবার কোনও ঘোড়া অসুস্থ হলেও তার উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। কয়েকটি বিনোদন পার্ক এবং বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য স্বল্পমূল্যে অসুস্থ ঘোড়াগুলোকে দেওয়ার ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কারো পক্ষ থেকেই আন্তরিক আগ্রহ পাওয়া যায়নি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, ১৫ জানুয়ারি ২০১২