শেরপুর থেকে ফিরে: ‘আমাগো খোঁজ কেউ রাহে না(রাখে না), আমরা খুব কষ্টে আছি। কেমুন কইরা যে দিন যায়, হে আমরাই জানি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামের স্বামীহারাদের প্রায় সবারই এই একই কাহিনী।
নিজের কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে বেয়ে আসা পানি আধময়লা শাড়ির আঁচলে বারবার মুছছিলেন জবেদা বেওয়া। তার বয়স এখন ৫৮। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ১৭ বা ১৮।
৫৫ বছর বয়সী জরিতন বেওয়াও সুর মেলালেন তার সঙ্গে। বললেন, ‘মতিয়া আপা যদি আমগোরে এট্টু দেখতেন, তাইলে এট্টু শান্তিতে দিন কাডাইতে পারতাম। আমগো কষ্টের কুনু শেষ নাই। ’
অগ্নিকন্যা বলে খ্যাত বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কথাই বলছিলেন জরিতন বেওয়া।
রাষ্ট্রের অবহেলা নিয়ে দিন কাটানো এ নারীদের রয়েছে এমন হাজারো আক্ষেপ। তারা সবাই বিধবা। তাই সোহাগপুরের নামই হয়ে গেছে বিধবাপল্লী।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৮৭ পুরুষ ও শিশুকে সেদিন র্নিবিচারে গুলি করে ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তারা।
আর সব দিনের মতোই পুরুষরা সেদিন কাকডাকা ভোর থেকে ক্ষেতে আমন ধান রোপনে ব্যস্ত। সকাল ৭টার দিকে তাদের উপর নেমে আসে আকস্মিক আক্রমণ। স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় একদল পাক-হানাদার গ্রামে ঢুকে পড়ে । ঘিরে ফেলে তিন দিক দিয়ে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী যাকে যেখানে যে অবস্থায় পেয়েছে সেখানেই হত্যা করেছে। রেহাই পায়নি শিশুরাও। আর নারীরা শিকার হয় পাশবিক নির্যাতনের। তবে, বাইরের চাপ আর লোকলজ্জার ভয়ে কেউই এখন তা স্বীকার করতেন চান না।
জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের সোহাগপুরের সেদিনের সেই গল্প এভাবেই বলছিলেন জবেদা বেওয়া।
পাশে বসে থাকা নসিমন বেগম, করিমন বেওয়া, উম্মে কুলসুম, দিনমণির চোখমুখের ভাষাও যেন এক।
কৃষকের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে এমনই অভিযোগ ছিল রাজাকারদের।
জরিতন বেওয়া বললেন, ‘দেহি (দেখি), গ্রামের এইহানে-ওইহানে( এখানে-ওখানে) পুরুষ আর বাচ্চাগো লাশ পইড়া আছে। ফিইরা আসা গ্রামবাসী মশারি, পরনের কাপড় আর কলাপাতা দিয়া পেঁচাইয়া লাশগুলা মাডিচাপা দিয়া রাখে। ’
স্বাধীন দেশে সোহাগপুর গ্রামের নারীদের শুরু হয় আরেক সংগ্রাম, বেঁচে থাকার। স্বামী-সম্ভ্রমহারা নারীরা কঠিন এক জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ গ্রামের নাম হয়ে যায় বিধবাপল্লী। এখনও সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন ৩৪ জন বিধবা।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এগিয়ে এসেছিলেন তাদের দিকে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সহায়তায় বছরে এক হাজার ২০০ টাকার ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া প্রতি বিধবাকে ২টি করে ছাগল ও কাপড় এবং ধান ও ডাল দিয়ে সাহায্য করেন তিনি। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ভাতা বন্ধ করে দেয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যৌথবাহিনী ও জেলা প্রশাসকের যৌথ উদ্যোগে পাওয়ার টিলার বিতরণ, মাশরুম চাষ ও বনায়নের জন্য তিনটি প্রকল্প চালু হয়। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে এগুলো কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায় বলে বাংলানিউজকে জানান স্থানীয় সাংবাদিক আদিল মাহমুদ উজ্জল।
এখন এ বিধবা নারীদের সংসার চলে বয়স্ক ভাতা আর ব্র্যাকের কাছ থেকে পাওয়া মাসিক ১০০ টাকা দিয়ে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বামী-সন্তান আর সম্ভ্রম হারানোর মতো সর্বোচ্চ বিসর্জন দেওয়া সোহাগপুর বিধবা পল্লীর এ নারীদের আকুলতা একটাই--- খেয়ে-পড়ে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চান তারা।
জরিতন বেওয়া, জবেদা বেওয়া, জরিমন বেওয়াসহ বেশ ক’জন বিধবা নারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই প্রকল্পগুলো আবারও চালু করে সঠিকভাবে তদারকির ব্যবস্থা করতে বাংলানিউজেরর মাধ্যমে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান।
‘শহরের মাইনষের মতো আমরা ভালা খাইতে চাই না, ভালা কাপড় চাই না, আমরা চাই দুই বেলা মোডা চাউলের ভাত আর বছরে দুইডা কাপড়। সরকারের কাছ থে কী আমরা হেইডাও পাইতাম না?’ --আক্ষেপে প্রশ্ন ছুড়ে দেন জবেদা বেওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১০