ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

উড়িরচরে খোকার চ্যালেঞ্জের মুখে নিজাম ডাকাত

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১২
উড়িরচরে খোকার চ্যালেঞ্জের মুখে নিজাম ডাকাত

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা।

তার ওপর জলে-স্থলে দস্যুদের অতর্কিত হানা এখানকার মানুষকে রাখে চরম অনিরাপত্তায়। পুরোটাই এক সন্ত্রাসের উপকূল। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক পক্ষকাল চষে বেড়িয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধর। সেখান থেকে তুলে এনেছেন সন্ত্রাসের ওই জনপদের অনেক সচিত্র কাহিনী। শনিবার দ্বিতীয় কিস্তি ...

আতঙ্কে দিন কাটছে উড়িরচরের ৩০ হাজার অধিবাসীর। একদিকে বর্তমানে চরের দখল নিয়ে আছেন নিজাম বাহিনীর উড়িরচর কমান্ডার ইব্রাহীম ব্যাপারী, অন্যদিকে হারানো স‍াম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া মাকসুদুল আলম খোকার নেতত্বাধীন খোকা বাহিনী।

প্রায় প্রতিদিনই চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে খোকাবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং খোকার ছোট ভাই নূরুন্নবী মামুন। অভিযোগ আছে, খোকা বাহিনীকে সহায়তা করছে কোস্টগার্ড এবং র‌্যাব। তবে র‌্যাবের এক গোয়েন্দা সূত্র বাংলানিউজকে বলেন, র‌্যাব এ বাহিনীকে ব্যবহার করছে নিজাম বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য। এ ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সফল। যেমন, গত মাসেই সদ্য বিলুপ্ত নাসির বাহিনীর কয়েকজনকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছে র‌্যাব। তাদের এ যৌথ আক্রমণে নিহত হয়েছে নিজাম বাহিনীর সে সময়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড জয়নাল ও নিজামের এক দেহরক্ষীসহ তিনজন (ক্রসফায়ারে)।

উল্লেখ্য, র‌্যাব এ অভিযানে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার করার জন্য ঠিকাদার হিসেবে নিজাম বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা চায়।

গত ২ মার্চ কোস্টগার্ড এবং র‌্যাব উড়িরচরে এক অভিযান চালায়। এ অভিযানে কোস্টগার্ডের সঙ্গে খোকা বাহিনীর জিপুল, জাবেদ, সাহেদও অংশ নেয় বলে বাংলানিউজকে জানান উড়িরচরের একজন জনপ্রতিনিধি। যদিও কোস্টগার্ড বিষয়টি অস্বীকার করে।

তবে উড়িরচর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ নাইম উদ্দিন বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমিও বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু এ সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। ’

বর্তমানে উড়িরচরে নিজাম বাহিনীর নেতৃত্বে আছে ইব্রাহীম মাঝি, মান্নান ওরফে মনাইয়া, তাহের, মোস্তফা ও রামগতীর জাহাঙ্গীর। এদের স্থানীয় এজেন্ট ইসলাম ব্যাপারী এবং মানিক মেম্বার, বাহার মেম্বার, জাসু প্রকাশ জাইস্যা। এদের হাতে আছে চট্টগ্রামের মাকসুদ বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা শতাধিক আধুনিক অস্ত্র এবং কিছুদিন আগে নাসির বাহিনীর ফেলে যাওয়া ৪৬টি বন্দুক ও এক ট্রাঙ্ক কার্তুজ।

এদিকে এ বাহিনীকে হটাতে প্রস্তুত হচ্ছেন খোকাবাহিনীর খোকা। নাসির বাহিনীর প্রধান নাসির কেরানি র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বর্তমানে এ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন খোকা। খোকাবাহিনীর সদর দফতর উত্তর উড়িরচরের খায়রুল আলম চেয়ারম্যানের বনবিভাগের বন কেটে তৈরি ৫০০ একরের খামার বাড়িতে। কিন্তু খোকাসহ দলের বেশিরভাগ সদস্যই এখন আশ্রয় নিয়েছে কোম্পানিগঞ্জের হযরত নিজাম উদ্দিনের (রহ.) মাজারে। এ বাহিনীর বর্তমান সদস্যরা হলেন- উড়িরচরের সোরাব, শাহীন, ছোট্টন, আকতার হোসেন, শাহীন, করিম উল্লাহ ভাসানী, রোবেল, সুমন, আব্দুল হাই, হাফেজ আহাং, মোহাব্বত, কাশেম প্রকাশ জাবেদ, দুলাল ব্যাপারী ওরফে দুলাল মেম্বার, কালাপানিয়ার সিরাজ, নূরুন নবী প্রকাশ মামুন, মিলাদ, মাছুম, উড়িরচরের মাসুদ, নুর আলম, এয়াকুব, নূর নবী, মো. কাশেম, হেলাল উদ্দিন, আকতার, সেলিম, দিলদার, আলাউদ্দিন, ইউসুফ, জসীম, হাসেম, জিপুল, রাসেদ, হাসান, জামাল প্রমুখ।

খোকা বাহিনী সম্পর্কে নিজাম বাহিনীর প্রধান নিজাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘চার দলীয় সরকারের আমলে খোকা সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদকে ধর্মের বাবা ডেকে তার সহযোগিতা নেয়। পরবর্তী সময়ে নাসিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোকা পুরো উড়িরচরকে নরকে পরিণত করে। ’

উড়িরচরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম আজ নতুন নয়। স্থানীয়দের মতে চরের শুরু থেকেই দু’ বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনীগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় শুরু থেকেই নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামের বিভিন্ন জলদস্যু গ্রুপকে চরে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই পরে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। যেমন, বর্তমানে উড়িরচরে নিজাম বাহিনীকে নিয়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গীর মেম্বার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এবং জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষ ইব্রাহীম ব্যাপারী এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেন।

এলাকাবাসীর মতে, শুরুতে উড়িরচরে খায়রুল আলম এবং আসাদুল হক চৌধুরী ওরফে সাহেব মিয়ার নেতৃত্বে ২টি গ্রুপ গড়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালে জমি দখলকে কেন্দ্র করে উড়িরচরে প্রথম খুন হয় মুক্তিযোদ্ধা মোস্তান শের। এ মামলার আসামি হন বর্তমান চেয়ারম্যান (মৃত) খায়রুল আলম। খায়রুল উড়িরচরে বহিরাগত জলদস্যু এবং সন্ত্রাসীদের মদদ দিতেন। খায়রুল আলমের আদি নিবাস সন্দ্বীপের কালাপানিয়া। উড়িরচরে তিনি বনবিভাগের ৫০০ একর বনভূমি দখল করে খামারবাড়ী গড়ে তুলে বসবাস শুরু করেন এবং এক সময় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে তিনি কখনোই উড়িরচরের ভূমিহীনদের নিজের লোক হিসেবে গ্রহণ করেতে পারেননি।

খায়রুল আলমের বড় ছেলে মাকসুদুল আলম খোকা এখন খোকা বাহিনী (অধুনালুপ্ত) নাসির বাহিনীর প্রধান। খোকা ২০০৪ সালে উড়িরচরে প্রথম পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময় খোকা কোম্পানিগঞ্জের সংসদ সদস্য এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং তার মদদপুষ্ট হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। এ ছাড়া এ সময় খোকা সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশার সমর্থনও আদায় করেন।

এ সময় সংসদ সদস্যর রোষানলে পড়ে সন্দ্বীপের আওয়ামী লীগ নেতা হারিচ সন্দ্বীপ থেকে উড়িরচরে এসে আশ্রয় নেন। হারিচ উড়িরচরে খায়রুল আলমের বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ করেন এবং একটি গ্রুপ তৈরি করেন। বেশিরভাগ বহিরাগতদের নিয়ে গড়া এ গ্রুপ উড়িরচর থেকে চেয়ারম্যান খায়রুল আলমকে বিতাড়িত করে। পরে কৌশল গ্রহণ করেন খায়রুল আলম। হারিচকে শান্তিচুক্তির কথা বলে ডেকে নেন কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহীর চর বালুয়ায়। এখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় হারিচকে। যার মামলা নম্বর ১৯/জিআর-১২৭/২০০৬/ কোম্পানীগঞ্জ।

এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয় নিহত হারিচের ভাই জুনায়েদ আলি ওরফে জাবেদ। হারিচ হত্যার ৯০ দিনের মাথায় জাবেদ খুন করে খায়রুল আলম চেয়ারম্যানকে। এ হত্যা মামলাও হয় কোম্পানীগঞ্জে। যার মামলা নম্বর জিআর ২৬৭/২০০৭/ কোম্পানীগঞ্জ। এ হত্যায় সাহায্য করে হাতিয়ার জলদস্যু সম্রাট ও বর্তমান সন্দ্বীপ পৌর মেয়র জাফর উল্লাহ্ টিটুর (এক সময়ের বিখ্যাত টিটু বাহিনীর প্রধান) নৌকার মাঝি। কিন্তু খায়রুল চেয়ারম্যান হত্যা মামলায় প্রকৃত খুনিদের আসামি না করে সাধারণ ভূমিহীনদের আসামি করা হয় বলে অভিযোগ সাধারণ চরবাসীর।

এরপর থেকে খোকা বাহিনী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আড়াই বছর পর্যন্ত উড়িরচর নিয়ন্ত্রণ করছে। এ বাহিনীকে সহায়তা করেন এক সময়ের বাশার মাঝির কেরানি ও নাসির বাহিনীর প্রধান নাসির। এরপর নিজাম বাহিনীর সঙ্গে নাসির বাহিনীর জাহাইজ্জার চরে কয়েক দফায় বন্দুক যুদ্ধ হয়। এরপর নাসির এ চর ছেড়ে উড়িরচরে আশ্রয় নেয়। নিজাম এখানেও তাকে আক্রমণ করে। এরপর নিজাম চট্টগ্রাম এলাকায় চলে যায় এবং ফেনী ও চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের নিয়ে নতুন বাহিনী গড়ে তোলার সময় পথে র‌্যাবের হাতে আটক হয়।

উড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মানিক মেম্বার (মানিক সওদাগর) বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা সারাক্ষণ আতংকের মধ্যে আছি। এক বাহিনী যায় তো আর এক বাহিনী আসে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সময় হলো, যখন এক বাহিনীকে অন্য বাহিনী হটানোর জন্য লড়াই শুরু করে। ’

মোবাইল চার্জ দেওয়া ছাড়া বের হয় না উড়িরচরের পুলিশ
উড়িরচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থিত উড়িরচর পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থান করছেন ২৫ পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে একজন এএসআই, একজন নায়েক এবং একজন হাবিলদার। ভয় ও উৎকণ্ঠায় সময় কাটে তাদের।

এ ফাঁড়িতে থাকা কনেস্টবল জুয়েল ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানকার অবস্থা ভালো না। আমরা সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকি। আতংকের মধ্যে থাকি। মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা, জোয়ারভাটা নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা, সন্দ্বীপ থেকে ২ ঘণ্টার নৌপথে যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় আমাদের হেল্প করারও কেউ নেই। ’

তিনি বলেন, ‘এ কারণে চোখের সামনে কিছু ঘটতে দেখলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। কোথাও কিছু ঘটলেও পরে কেউ মুখ খোলে না। ’

জুয়েল জানান, এ ফাঁড়িতে তাদের কোনো কার্যক্রমও নেই। কেউ কখনো কোনো অভিযোগ নিয়েও আসে না। মাঝে মাঝে দিনে টহল দিলেও উত্তরচরে খোকা বাহিনীর ঘাঁটি থাকায় সেদিকে যেতে উপরের নিষেধ আছে।

তিনি বলেন, ‘সব সময় এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। ফাঁড়ির বেতার যন্ত্রটিও কতদিন ধরে নষ্ট তা কেউ বলতে পারবে না। ফলে আক্রান্ত হলে সাহায্য করারও কেউ নেই। ’

জুয়েল জানান, ২/৩ মাস পর সন্দ্বীপ থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এলেও বছরে ২ বার আসেন সার্কেল কমকর্তা।

তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্যই সন্ধ্যায় বাজারে যাই, আর সকালে বাজারের কাজে। এ ছাড়া ব্যারাকের বাইরে যাই না তেমন। ’

অন্য পুলিশ কনেস্টবল আবদুল হালিম বলেন, ‘এটা একটা ভয়ের জায়গা। আমরা এসেছি এখানকার মানুষের নিরাপত্তা দিতে, কিন্তু এখানে আমাদেরই জীবনের নিরাপত্তা নেই। ’

ফাঁড়ির দায়িত্বরত এএসআই নাঈম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাইরের অতিরিক্ত ফোর্স এলেই আমরা টহলসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করি। এ ছাড়া এখানকার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের লড়াই করার মতো শক্তি নেই। ’

বাংলাদেশ সময় : ১৮৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১২

সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।