ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

পেরু থেকে রিসালাত খান

জলবায়ু সম্মেলনে আশা-হতাশার খেলা

রিসালাত খান, পেরু থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪
জলবায়ু সম্মেলনে আশা-হতাশার খেলা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জলবায়ু সম্মেলন (লিমা) পেরু থেকে: সোমবার পেরুর রাজধানী লিমায় জাতিসংঘের ২০তম জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন শুরু হয়েছে। প্রতি বছরের মত এবারও হাজারো সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি একত্র হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।

এই সম্মেলনের ভেতরে না থাকলে এর বিশালত্ব এবং জটিলতা অনুমান করা কঠিন।

আমি এখানে এসেছি একজন তরুণ অংশগ্রহণকারী ও পর্যবেক্ষক হিসেবে। দু’সপ্তাহের জন্য আমার কাজ এই জটিলতাকে প্রথমে অনুধাবন করা এবং তারপর সেটাকে কিছুটা হলেও সহজগম্যভাবে উপস্থাপন করা। বেশ দুষ্কর অভিপ্রায় অবশ্যই।

প্রায় দু’যুগ ধরে বার্ষিক আলোচনা ও প্রচেষ্টার পরও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমরা হাস্যজনকভাবে পিছিয়ে। সারা বিশ্বের যেকোনো দিকে তাকালেই এখন তা বোঝা যায়। ইউরোপ-এশিয়ায় বন্যা, আফ্রিকা-আমেরিকায় খরা, দ্বীপ ও উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোতে সাইক্লোন-টাইফুন- সারা বিশ্বে খাবার উৎপাদন সংকট, সুপেয় পানির স্বল্পতা।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল আমাদের পরিমিত ইতিহাসের মধ্যে (১৮৮০ পরবর্তী) সবচেয়ে উষ্ণ বছর। আর আমাদের নিজেদের দেশে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব তো বলার অপেক্ষা রাখে না। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বাংলাদেশি মানুষ দেখলেই এমন একটি মুখভঙ্গী করেন যেন মনে হয় একটি পঙ্গু পথকুকুর চোখে পড়লো!
peru_01
তাই অনেকেই মনে করেন যে, এবার লিমা সম্মেলনেও আশা রাখার কোন সুযোগ নেই। এরকম নেতিবাচক আচরণের পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। বিশ্বের উত্তর-দক্ষিণ দেশগুলোর মতামতের মধ্যে অনেক ফারাক এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ এসে এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের হাতে কোন সময়ই নেই।

তাদের ভাষ্যমতে, এই দশকের মধ্যেই মানবসমাজের কার্বন নিঃসরণ দ্রুত শূন্যের দিকে নামাতে হবে। মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাই সবাইকে দৃঢ় প্রত্যয়ে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে।

ইতস্তত করে হলেও বলছি- সেই সুবাতাস বোধহয় কিছুটা বইছে। কারণ ২০১৪-২০১৫ সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- ২০১৫ এর ডিসেম্বর মাসে প্যারিসে সব দেশের মাঝে একটি সার্বজনীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার কথা। এই সময়কে কেন্দ্র করে তাই সবার মাঝে বেশ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এই উপলব্ধিটুকু সবারই ভালভাবে হয়েছে যে সময়ক্ষেপণ করা মানে সমস্যাটিকে আরও ধ্বংসকারী, আরও ভয়ানক হওয়ার সুযোগ দেওয়া। এবং ঘড়ির কাঁটা ১২টার কাছাকাছি - তাই বেশিরভাগ দেশই অবশেষে একটি সমাধানের দিকে আগাতে ইচ্ছুক।

গত এক মাসের মধ্যেই আমরা তার কিছু নমুনা পেলাম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে- তারা ২০৩০ সালের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চায়না - বিশ্বের সবচেয় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ দুটো- যারা পূর্ববর্তী সম্মেলনগুলোতে সবসময় একে অপরকে দোষারোপের পিলো-পাসিং খেলে এসেছে। একই সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা তাদের নিঃসরণ কমাবে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এখন ৯৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমিতে এসব নতুন প্রতিশ্রুতির তাৎপর্য খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
peru_02
তবে যা প্রতিশ্রুত হয়েছে, এবং বৈজ্ঞানিক ভাষ্যে যা করণীয়, তার মধ্যে এখনো প্রকাণ্ড ফারাক- কারণ ছাড় দিতে সবারই অনাগ্রহ। দীর্ঘ কালের নিষ্ক্রিয়তার ফলে এখন অত্যন্ত দ্রুত প্রশমন (মিটিগেশন) করা প্রয়োজন - বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর জন্য। যে কোন সরকারের পক্ষেই তেমন দৃঢ় কর্মসূচি হাতে নেওয়া কঠিন। বিশেষত যখন অর্থনৈতিক মন্দা পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বে ডানপন্থি শাসন ও সমর্থনের ঢেউ বইছে। তাই অনেক কঠিন পথ সামনে বাকি।

তবে আশার বিষয় এই যে- সারা বিশ্বে জনগণ এবং সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ এবং চাপ জোরালো থেকে জোরালোতর হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে আমরা দেখলাম, সারা বিশ্বে বাংলাদেশসহ ১৬৮টি দেশের ৬ লাখের বেশি মানুষ রাজপথে নেমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শক্তিশালী অগ্রগতির দাবি জানালো। এ ধরনের জনসচেতনতা আগে ছিল না- যার ফলে রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার জবাবদিহিতা ছিল কম।

যে ধরনের পরিবর্তন আমাদের প্রয়োজন, সেটা ইতিহাসে কখনো সামাজিক আন্দোলন ছাড়া শুধু রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে সম্ভব হয় নি।

তাই শুধু একটা কথাই হলফ করে বলতে পারি- ২০১৫ হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল একটি বছর। সারা বিশ্বের জন্য অবশ্যই- কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বিশেষ করে। লিমা সম্মেলন সবে শুরু হলো- পরবর্তী দু’সপ্তাহে হয়তো কিছুটা আঁচ করা যাবে যে কোথাকার পানি কোন দিকে গড়াবে। সেই পানির উপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা এবং ফলস্বরূপ মানুষের পরিণতি।

উত্তর-দক্ষিণ দেশগুলোর মাঝে বিভিন্ন আলোচনা শুরু হয়েছে- মূলত প্যারিসের খসড়া চুক্তি, অভিযোজন, প্রশমন ও নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অর্থায়ন ও সহযোগিতা এবং প্যারিসের পথে অগ্রগতির একটি রোডম্যাপ নির্দিষ্ট করা। আশা করছি এবারের সম্মেলনে সব দেশ একটি গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে অংশগ্রহণ করবে এবং অতীতের ভূতকে ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার জীবাশ্ম জ্বালানি যোগাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।