চর নিজাম, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে: বাপদাদার ভিটে হারিয়ে কেউ ভাঙণ কিনারে ক্ষুদ্র ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন। কেউবা বাড়িঘর হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নৌকায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার চর নিজাম ও চর কলাতলীতে নি:স্ব মানুষদের ঠাঁই মিলছে না। ভাঙণ কবলিত আন্দিরপাড়, রামনেওয়াজ, সাকুচিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ অতিকষ্টে দিন যাপন করছেন। এক জীবনে সর্বোচ্চ ১৪ বার পর্যন্ত বাড়ি বদলেছেন। তবুও আসেনি স্থিতিশীলতা। নানামুখী দুর্যোগে বিপন্ন উদ্বাস্তু মানুষ এখন আর কোথাও যাওয়ার স্থান পাচ্ছেন না। যাদের কিছু অর্থকড়ি আছে, তারা জমি কিনে অন্যত্র বাড়ি করতে পারলেও যাদের সেই সামর্থ্যটুকু নেই, তারা পড়ে আছেন এখানেই।
নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বহু মানুষ সব হারিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে এখানে সেখানে।
বিশেষজ্ঞরা এদেরকে জলবায়ু স্থানচ্যুত বলে চিহ্নিত করেছেন। অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্লাইমেট রিফিউজিস (এ.সি.আর) এবং ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে ইতিমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানচ্যুত হয়েছে। মনপুরার এই উদ্বাস্তু মানুষ তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।
মনপুরা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব আন্দিরপাড়। গত কয়েক বছরে এই এলাকার বহু মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে নি:স্ব হয়েছেন। এলাকাটি ঘুরে চোখে পড়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে বাড়িঘরে, নদীপাড়ের বহু ভিটে থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বাড়ি। হাঁটাচলার রাস্তা, হাটবাজার, পুরানো গাছপালা, সান বাঁধানো পুকুর, স্বজনদের কবরস্থান সবই বিলীন হয়ে যাচ্ছে মেঘনায়। একটি বড় এলাকা বাইরে রেখে তৈরি হচ্ছে নতুন বেড়িবাঁধ। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কিছু অসহায় উদ্বাস্ত মানুষ বসবাস করছেন আন্দিরপাড়ে।
আন্দিরপাড় ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন। বয়স ৭০ পেরিয়েছে। সম্পদশালী গৃহস্থ ছিলেন। মাছের ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া এই মানুষটিকে এখন দিনের রোজগার দিনেই করতে হয়। আন্দিরপাড়ে মেঘনার ভাঙণ কিনারে ছোট্ট দোকান দিয়েছেন। এতেই কোনমতে সংসার চলে তার। চরের খাসজমি পেতে অনেক টাকা প্রয়োজন। সে টাকা নেই তার।
আন্দিরপাড় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুর রহমান। বাড়িঘর হারিয়ে এখন নৌকায় জীবন কাটছে তার। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, মাছধরা সবই নৌকায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের দূরে বেড়িবাঁধের ধারে ছোট্ট ঝুপড়িতে থাকার জায়গা করে দিয়েছেন। চরে খাসজমির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মেলেনি। পরিবার পরিজন নিয়ে আগামীদিনে কোথায় স্থান হবে জানেন না রহমান।
মনপুরা ইউনিয়নের রামনেওয়াজ ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী ১৪ বার ঘর বদল করেছেন। একই ঘরে তার পরিবার পরিজন নিয়ে থাকা আর হোটেলের ব্যবসা। প্রত্যেকবার ঘর বদল করতে তার খরচ হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। ধারদেনা করে জমি কিনে জীবিকার প্রয়োজনে এই ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন তিনি।
স্থানীয় সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে আন্দিরপাড় ও রামনেওয়াজ এলাকা থেকে অন্তত দশ হাজার পরিবার নি:স্ব হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু মানুষ এলাকায় আছে। অনেকে আবার জীবিকার তাগিদে অন্যত্র ছুটেছে। এই এলাকাটি ভেঙ্গে মেঘনার বুকে চর কলাতলী জেগে উঠলেও সেখানে ঠাঁই মিলছে না অনেকেরই। এই তালিকায় কাঞ্চন মাঝি, জাহেদ মাছি, খালেক ব্যাপারী, মহিউদ্দিন মাঝি, জাহাঙ্গীর ব্যাপারী, হিরণ মিস্ত্রিসহ অনেকের নামই রয়েছে।
মনপুরার কলাতলী গ্রাম ভেঙ্গে গিয়ে মেঘনার বুকে জেগেছে চর কলাতলী। এই চর সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেলো, চরের জমি নিয়ে এখানে রয়েছে নানামুখী রাজনীতি। কেউ বিভিন্ন কৌশলে অনেক বেশি জমি দখল করে আছেন। কেউ মোটেই পাচ্ছেন না। প্রভাবশালীদের দখলদারিত্বও রয়েছে চরের কোথাও কোথাও। এখানকার জমি বেচাকেনা হয়; কিন্তু কোন কাগজপত্র নেই।
চর কলাতলীর আবাসন বাজার, মনির বাজার ও কবীর বাজারে আলাপ হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। এরা জানালেন, চরের জমিতে নি:স্ব মানুষদের অধিকার সবার আগে। কিন্তু সে অধিকার এখানে মিলছে সামান্যই। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চর কলাতলী ও পার্শ্ববর্তী ঢালচরে এসে নি:স্ব মানুষ ঘর বাঁধে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য চরের বাসিন্দারা জমি বন্দোবস্তের জোরালো দাবি জানালেন।
চর কলাতলী মনপুরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, ২০১২ সালে চর খালেক নামে কলাতলীর চরের ১২০০ একর জমির ম্যাপ ভোলা জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে অনুমোদন পায়। ২০১৩ সালে কাজীর চরের আরও ১৫৫০ একর জমির ম্যাপ অনুমোদিত হয়। চর কলাতলী-১ ও চর কলাতলী-২ নামে আরও ২৪০০ একর জমির ম্যাপ অনুমোদনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও জমি বন্দোবস্তের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, চরের জমি বন্দোবস্ত না হওয়ায় একটি কুচক্রি মহল এর সুযোগ নিচ্ছে। অথচ প্রশাসন একটু উদ্যোগী হয়ে খাসজমি বন্দোবস্ত দিলে সরকার চর থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে পারতো। উদ্বাস্তু মানুষদেরও ঠাঁই হতো চরের জমিতে।
সমুদ্র মোহনায় মনপুরার আরেকটি দ্বীপ চর নিজাম। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে এখানে জনবসতি শুরু হলেও এখানে উত্তাস্তু মানুষের অধিকার মেলেনি। এই চরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি পড়ে থাকলেও তা উদ্বাস্তুদের মাঝে বন্দোবস্তের কোন ব্যবস্থা হয়নি। ১৯৮৫ সালে এই চরে ৭০টি নি:স্ব পরিবার তিন একর করে খাসজমি বন্দোবস্ত পায়। তার এর দখল বুঝে পেয়েছে। কিন্তু ২০০৪ সালে বন্দোবস্তকৃত আরও ৪৫০টি পরিবার তাদের দখল বুঝে পায়নি। অথচ তাদের কাছে বন্দোবস্তের কাগজপত্র রয়েছে।
চর নিজামের সাবেক ইউপি মেম্বার মো. আবু শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, ৪৫০ পরিবারকে দেড় একর করে জমি বন্দোবস্ত দেয়া হলেও জমির দখল পায়নি। অথচ প্রায় ৪০ বছর আগে বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এই মানুষগুলো এখানে এসেছেন। বন বিভাগ এই জমি দখলে বাধা দিচ্ছে বলে তার অভিযোগ।
তবে এ বিষয়ে স্থানীয় বন বিভাগের বিট অফিসার আওলাদ হোসেন পালোয়ান বাংলানিউজকে বলেন, চর নিজাম সংরক্ষিত বন হিসাবে স্বীকৃতি পায় ২০০২ সালে। এখানকার কিছু মানুষকে এই চরের জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয় ২০০৪ সালে। সংরক্ষিত বন এলাকায় বন্দোবস্ত হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি তার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনপুরা ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নদীর বুকে জেগে ওঠা খাস জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। অন্যতম সমস্যা হচ্ছে পাল্টাপাল্টি মামলা। এ কারণে কিছু এলাকায় বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ থাকছে। তবে চরের খাসজমিতে নি:স্ব এবং উদ্বাস্তু মানুষ স্থান পাচ্ছে।
জলবায়ু স্থানচ্যুত মানুষের অধিকার ও পুনর্বাসন নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা ইপসার এইচএলপি প্রোগ্রামের টিম লিডার মোহাম্মদ শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের সরকারের জলবায়ু স্থানচ্যুতি নীতিমালা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বর্তমানে যে বিষয়টি প্রচলিত তা হল জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমগুলো অস্বচ্ছ ও দুর্নীতির শিকার। দ্রুততার সাথে এই বিষয়গুলোর সমাধান করা খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এ ক্ষেত্রে সক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী বিশেষত দাতা দেশগুলোর দুর্নীতি দূরীকরণের ও স্বচ্ছতা আনার প্রয়াসগুলোকে সাহায্য করা উচিত। জলবায়ু স্থানচ্যুতির নীতিমালা ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তহবিল প্রদানই যথেষ্ট নয়। তহবিলের তদারকি বাঞ্ছনীয় এবং কার্যক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০১০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৪