হাজারো সংকটে উপকূলের শৈশব। এখানে শৈশবের ডানা মুখ থুবড়ে মরে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়।
উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: যে হাতে থাকার কথা ছিল বই, সে হাতে ইলিশের জাল। যে হাতে রঙ-পেন্সিলে ছবি আঁকার কথা ছিল, সে হাতে বইতে হচ্ছে মাছের বোঝা। যে চোখ স্বপ্ন দেখতো এক সোনালী আগামীর, সে চোখ শুধুই রোজগারের পথ খুঁজে বেড়ায়। শৈশব-কৈশোরের উল্লাস-উচ্ছ্বাসের আনন্দ ওদের কাছে ম্লান। মাত্র ৭-৮ বছর বয়সেই শুরু হয় বৈঠার প্রশিক্ষণ।
উপকূলের শিশুদের একটা বড় অংশ এভাবেই বেড়ে ওঠে। শৈশব এই শিশুদের জীবনে নিয়ে আসে না কোন রঙিণ স্বপ্ন। ভোলার দৌলতখান, ইলিশা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, হাতিয়ার বুড়িরচর, কোড়ালিয়া, কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী, গাঙচিল কিংবা কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে এমন অগণিত শিশুর দেখা মেলে। জেলে পল্লী ঘুরে স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের খুব একটা দেখা মেলেনি। কেউ কেউ হয়তো প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, এরপর কাজে নামতে হয়েছে। আর সে কাজটা হচ্ছে মাছ ধরা।
ভর দুপুরে ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর থেকে বেড়িবাঁধ ধরে চৌকিঘাট মাছ আড়ত এলাকার দিকে যাওয়ার পথে বহু শিশু-কিশোরের দেখা মেলে। সবচেয়ে ছোট যে ছেলেটি মাছ ধরতে যায়, তার বয়স ৭ বছর। দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে অনেক আগেই। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কাজ ফেলে দুপুরের খাবার খেতে এসেছে ক্ষুদে জীবনযোদ্ধারা।
একজন শহিদ। মো. ইদ্রিসের ছেলে। বয়স ১৩ বছর। সাত বছর ধরে মাছ ধরে। অর্থাৎ মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই শহিদ তার বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া শুরু করেছে। মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। জীবিকার টানে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বড় ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেছে। এই বয়সে শহিদকে তিন জনের সংসার চালাতে হয়। লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকলেও শহিদের সে সুযোগ নেই।
মো. বাবুল মিয়ার ছেলে ইব্রাহিম। বয়স মাত্র ৯ বছর। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে ইব্রাহিম সবার বড়। তাই রোজগারের ভার তার মাথায়। মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও অভাব অনটনের কারণে তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দুই বছর ধরে পুরোপুরি মাছধরা পেশায়। ইব্রাহিমসহ আরও দুই শিশু একটি জেলে নৌকায় মাছ ধরে। দিন শেষে মাছ বিক্রি করে যা পাওয়া যায়, তা তিনজনে ভাগ করে নেয়।
নূরুল ইসলামের ছেলে মিলন। বয়স ১৫ বছর। এই বয়সেই সে দক্ষ মাঝি। তিন ভাইয়ের মধ্যে একজন মাছের আড়তে কাজ করে, একজন মাছের মোকামে আর মিলন নদীতে মাছ ধরে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল মিলন। এখনও রোজগারে নামতে হয়েছে বলে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ার কোড়ালিয়া গ্রাম। মেঘনার তীর ধরে বহু জেলে পরিবারের বসবাস। মেঘনায় মাছ ধরেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। শিশুকাল থেকেই ছেলেদের মাছ ধরতে পাঠায়। মেঘনা থেকে উঠে আসা কোড়ালিয়ার কাটাখালী খালের মোহনায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই বেশ কয়েকটি ছোট সাইজের মাছ ধরার নৌকা এসে ভিড়লো ঘাটে। নৌকায় যারা আছে, সবাই শিশু।
কোড়ালিয়া জেলে পল্লীর অভিভাবক হরিপদ চন্দ্র বলেন, আমরা যেমন বাপদাদার পেশায় থেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছি, আমাদের ছেলেদেরও এই কাজই করতে হবে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ আমরা। মাছ না পেলে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নদীতে না গেলে তো জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য নেই।
হাতিয়ার বুড়িরচর, জাহাজমারা, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন ঘুরে স্কুলে না যাওয়া বহু শিশু কিশোরের দেখা মেলে। স্কুলে যাচ্ছে না বলে কারও কোন অবসর নেই। অনেকেই পৈত্রিক পেশার সূত্র ধরে মাছ ধরছে। অনেকে আবার সংসারের কাজে সহায়তা হিসাবে কাঠ কুড়ানো, মাটিকাটাসহ অন্যান্য কাজে যুক্ত হচ্ছে।
বুড়িরচর ইউনিয়নের ইউপি মেম্বার নিজামউদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, একদিকে প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। অন্যদিকে অভিভাবকদের মধ্যে নেই সচেতনতা। এর ওপর পরিবারে আর্থিক অনটন তো আছেই। এইসব কারণেই জেলে পরিবারের শিশুরা স্কুলে না গিয়ে কাজে যায়।
কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপের শিশুদের যেন স্কুলে যাওয়া বারণ। বাবা-মা কেউই স্কুলে যেতে বলেনি। গোটা সমাজেই নেই লেখাপড়ার পরিবেশ। তাইতো বই হাতে স্কুলে যাওয়ার বদলে ওরা নেমেছে কাজে। কেউ বাবার কাজের সাহায্যকারী, কেউ আবার নিজেই দক্ষ মাঝি। বারোতেই শিশুর হাতে উঠে বৈঠা।
দ্বীপের ক্যাম্প পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে আবদুল রকিম (১৬), তাহারা বেগম (৮), মোহাম্মদ হোসেন (৬) কখনোই স্কুলে যায়নি। স্কুলের সময়ে ওরা ধূলো লাগিয়ে রাস্তায় খেলাধূলা করে কিংবা কাজে যায়। স্কুল কী, স্কুলে কী হয়, সে সম্পর্কে এই শিশুদের কোন ধারণাই নেই। খেলার সাথীদেরকেও ওরা কখনো স্কুলে যেতে দেখেনি।
এই শিশুদের মা ফরিদা বেগম বললেন, তিন বেলা খাবার যোগাড়ের কষ্ট, পানি উঠলে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে থাকার কষ্ট, এত সমস্যার মাঝে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারি না। সহায় সম্পদ সব হারিয়ে গেছে। এখন বাড়ির ভিটেটুকু আছে। এরপর কোথায় যাব জানি না। এত সমস্যার মাঝে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা ভাবি কিভাবে?
এতো গেল এক ঘরে কয়েকজন শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কথা, দ্বীপের নাফ নদীর তীরে গিয়ে স্কুলে না যাওয়া অসংখ্য শিশুর দেখা মেলে। কেউ নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত, কেউবা ব্যস্ত জাল গোছাতে। ৬-৭ বছর বয়স থেকে শুরু ১৪-১৫ কিংবা ১৭-১৮ বছর বয়সী শিশুরা বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। অনেকে আবার বাবার সঙ্গে না নিজেই কাজের নেতৃত্ব দেয়। ১০-১২ বছর বয়সেই ওরা কাজ শিখে যায় পুরোপুরি।
শুধু জালিয়া পাড়া নয়, দ্বীপের সবখানেই কর্মজীবী শিশুদের দেখা মেলে। কেউ শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত, কেউ পানি টানে, কেউ রিকশা চালায়, কেউ মাঠে কাজ করে আবার কেউবা রাস্তার কুড়ানি। এই চিত্র দেখে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের প্রায় শতভাগ উপস্থিতির ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। শাহপরীর দ্বীপের অধিকাংশ অভিভাবক স্কুলে পাঠানোর চেয়ে ছেলেমেয়েদের কাজে পাঠানোকেই বেশি লাভজনক মনে করেন।
স্কুল শিক্ষক আল-আমীন বলেন, শহরের ছেলেমেয়েদের পেছনে অভিভাবকরা যতো সময় দেন, এখানে সেটা নেই বললেই চলে। ওরা বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলে যাচ্ছে কীনা তা তো দেখার কেউ নেই। দূরের শিক্ষকরা এখানে এসে বেশিদিন অবস্থান করেন না এটা ঠিক, তবে অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উন্নয়নে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০১০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৫
উপকূল থেকে উপকূল
উপকূলে সংকটে শৈশব-১
সাতেই হাতেখড়ি বৈঠায়
রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।