ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে গত ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের হাজারো ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়। এ ঘটনা পরিক্রমায় ১৭ বছর ধরে একটানা শাসন করতে থাকা, এক স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন ঘটে।
একই দিনে লাখ লাখ মানুষ গণমিছিলে যোগ দিয়ে গণভবন ও সংসদ ভবনে গণসংযোগ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। তবে, এই বিশাল জনসমাগমের মাঝে ঘটে যায় বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। দলে দলে ছুটে আসা লাখ লাখ মানুষের মধ্যে কিছু মানুষ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে গণভবন এবং সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক লুটপাট, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে, যা দেশের জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, আন্দোলনে অংশ নেওয়া কিছু ছাত্র-জনতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ‘গণভবন সংস্কার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা’ কার্যক্রমের আহ্বান করে। তাতে সাড়া দিয়ে ঢাকা এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ উদ্যোগে অংশ নেয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণ, সংস্কার এবং পরিষ্কার অভিযানে তাদের কর্মস্পৃহা এবং দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ সবার নজর কাড়ে।
গত ৬ আগস্ট থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমে হাজারো ছাত্র-জনতা অংশগ্রহণ করে গণভবন পরিষ্কার এবং সংস্কারের কাজ শুরু করে। এ কার্যক্রমে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন শাকিব আরিফিন ও হাফিজ উদ্দিন, সিনিয়র সমন্বয়ক হিসাবে মৌসুমী আক্তার বাঁধন। সমন্বয়ক হিসেবে আনিসুর রহমান, মাহমুদুল হাসান মুঈন, সাকির আহমেদ, আব্দুল আজিজ, ইকরা ইসলাম এবং উপদেষ্টা হিসাবে রাওমান স্মিতা, ড. কিশোর আলমসহ অনেকেই এ কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
সোমবার (১৯ আগস্ট) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় সাধারণ মানুষের লুটকৃত মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় সেগুলো রেখে দিয়ে তা সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বাড়াতে ঢাকা শহর জুড়ে লুট হওয়া মালামাল ফেরত দেওয়ার জন্য প্রচারণা চালালে ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকা থেকে হাজারো মানুষ স্বেচ্ছায় লুট হওয়া জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে যায় এবং তা স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে গণভবনে পুনরায় সংরক্ষণ করা হয়।
এ উদ্যোগের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মালামাল পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
উল্লেখ্য যে ফেরতকৃত বা উদ্ধারকৃত মালামালের মধ্যে বিপুল পরিমাণে আসবাবপত্র যেমন সোফা, টেবিল, চেয়ার, খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, বুক সেলফ ইত্যাদি পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগই ব্যবহারযোগ্য। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ও ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন মোবাইল, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, এসি, কম্পিউটার মনিটর, সিসিটিভি ক্যামেরা, সিপিইউ, হার্ড ড্রাইভ, মোটর সাইকেল, ইত্যাদি বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, গণভবনের দলিল, বই, খাতা, দামি শাড়ি-কাপড়, পর্দা এবং মূল্যবান কাচের জিনিসপত্রও বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ পুনরুদ্ধারের সফল প্রচারণার ফলে বেশ কিছু মানুষ ফেরত দিয়ে গেছেন গণভবন থেকে নিয়ে যাওয়া গাছপালা ও গৃহপালিত প্রাণী।
এ কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক শাকিব আরিফিন জানান, ‘গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুথানে ঘটে যাওয়া লুটপাট ও ভাঙচুরের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে; তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুনরুদ্ধার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের হারানো সুনাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ’
এ কার্যক্রমের যুগ্ম প্রধান সমন্বয়ক হাফিজউদ্দিন মুন্না বলেন, ‘দীর্ঘ দিন আন্দোলনের পরে বিজয়ের দিনে গণভবনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেই গণভবন সংস্কার করবো, একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার মাধ্যমে গঠিত ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ’ নামক আমাদের এ ইয়ুথ নেটওয়ার্কটি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে গণভবনের মালামাল ফেরত নেওয়া, রাস্তা ঘাটের ট্রাফিক কন্ট্রোল করা, পাড়া মহল্লায় সচেতনতা বাড়ানোসহ বৃক্ষরোপণের মত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত করছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়তে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থাসহ দেশের ছোট ছোট সিস্টেম এর সংস্কার দরকার। আমরা ছাত্র-জনতা মিলে নবনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী একটি দেশ গড়া সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। ’
এ কার্যক্রমের সিনিয়র সমন্বয়ক মৌসুমী আক্তার বাঁধন বলেন, আমাদের দেশের এই উত্তরণের ক্রান্তিলগ্নে কয়েকজনের অনিয়ন্ত্রিত আচরণের জন্য পুরো বাঙালি জাতির নামের সঙ্গে অসভ্য, নির্লজ্জ, বেহায়া, অমানুষ ইত্যাদি ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিরাই যে এই থমকে যাওয়া ভীত দেশের হাল ধরে তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করছে, এমনকি অসভ্যতা করা মানুষ গুলোও যে অনুতপ্ত হয়ে তাদের ভুল শুধরে ফেলছে সে কথাও সবার জানা প্রয়োজন। ‘
এই কার্যক্রমের অন্যতম সহযোগী সংগঠন গ্লোবাল ল থিংকার্স সোসাইটির ফাউন্ডার রাওমান স্মিতা বলেন, বাংলাদেশের মতো অতি ক্ষুদ্র দেশের, নানা সীমাবদ্ধতায় বেড়ে ওঠা তরুণেরা আজ কেমন দেশ চায় তা দেখিয়ে দিচ্ছে। গণভবন পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট এবং অতি উৎসুক ও উত্তেজিত জনগণ যে মালামাল নিয়েছে তা সংগ্রহ ও জমা দেবার মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছি দেশের সম্পদ ও দেশের প্রতি শ্রদ্ধা।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বকে জানাতে চাই আমরা শান্তি প্রিয় তবে অন্যায় রোধে আমাদের কণ্ঠ জোরালো।
এ কার্যক্রমের উপদেষ্টা ড. কিশোর আলম বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা পৃথিবীতে বারে বারে ছাত্রদের রক্তদানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এবার ছাত্র-জনতা এ দেশের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিয়েছে। এদেশের প্রতিটি মানুষ প্রতিটি সম্পদ এবং প্রতিটি স্থাপনায় আমাদের সবার গর্ভের স্থান, তাই এগুলো রক্ষা করতে আমাদের ছাত্র-জনতাকে এগিয়ে এসে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
গণভবন সংস্কারের এ কার্যক্রমে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ, বিএমএসএস, নটরডেম কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, স্কলার্স ইউনিভার্সিটি, তেজগাঁও কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তা মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়, মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, গুলশান কমার্স কলেজ, এন আই টি আর, সরকারি শ্রীনগর কলেজ, ভিকারুন্নেসা, সিভিল এভিয়েশন, লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ, আবুজর গিফারী কলেজ, আলহাজ্ব মকবুল হোসেন কলেজ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, বিইউপি, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসা এবং আরো অনেক সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন জিএলটিএস, ইএমকে সেন্টার, মোমেন্টাম, বিএনসিসি, স্কাউট, গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশন, রোভার স্কাউট, বিএইচই ইউনি এবং প্রত্যয় ট্রেডিংসহ বিভিন্ন কর্মজীবী এবং পেশাজীবী মানুষ অংশ নেয়।
এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের কাজকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করা।
পাশাপাশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের যে সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে, দেশের মানুষের সংস্কার কার্যক্রম ও মন-মানসিকতার বাস্তবচিত্র প্রকাশের মাধ্যমে তা সারা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। এ কর্মযজ্ঞ শেষে এর একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে গণভবন হস্তান্তর করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০২৪
আরআইএস