অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে : ‘সাইজ ডাজ ম্যাটার’- কথাটাই সত্যি হলো বিশ্বকাপ ফাইনালে। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের আকৃতির বিশালতা আর গ্যালারির জনসমুদ্রে রীতিমতো হাবুডুবু খেলো নিউজিল্যান্ড! গ্যালারির হল্দে রঙের ঢেউ দেখার পরও লিখতে হচ্ছে—‘বিবর্ণ এক ম্যাচ’! অস্ট্রেলীয়রা যে ম্যাচটাকে একেবারে একপেশে বানিয়ে জিতলো, তাকে দুর্দান্ত ফাইনাল বলবেন কিভাবে? তেইশ বছর আগে এরকম এক মার্চের রাতে যে ফাইনাল জিতেছিলেন ইমরান খান, সেখানে উত্তেজনা, নাটকীয়তার কমতি ছিল না।
২০০৩-এ জোহানেসবার্গের ফাইনাল কিংবা ১৯৯৯-এ লডর্সের ফাইনালে ভারত আর পাকিস্তানকে যেমন দুমড়ে মুচড়ে কাপ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া ঠিক সেই অবস্থাই হলো নিউজিল্যান্ডের। ২০০৭-এ বার্বেডোজে শ্রীলংকার অবস্থা যে খুব ভাল ছিল তা-ও কিন্তু নয়। ইতিহাসের এই পরম্পরায় নিউজিল্যান্ডের জন্য একটা আশার আলো ঝিলিক দিয়েছিল। সেটা বত্রিশ বছর আগে ১৯৮৩-র ফাইনাল। ভারত যেখানে নিউজিল্যান্ডের মতো আগে ব্যাট করে ১৮৩ রান করেছিল।
যাদের হারিয়ে ঐ ম্যাচে ভারত জিতেছিল, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসও দেখলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট সাম্রাজ্যের পতনের পর যারা ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে বেশি দাপট দেখাচ্ছে সেই অস্ট্রেলিয়া পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতলো। ক্রিকেট-গ্রহে অন্য কোনো দলের যে এমন রেকর্ড নেই! আসলে রেকর্ড তো অস্ট্রেলিয়া টানা তিনবার বিশ্বকাপ জিতে আগেই গড়েছিল। এবার তারা ধরাছোঁয়ার আরো বাইরে চলে গেলো।
হ্যাঁ, চলে গেলেন আরো একজন। বলে-কয়ে এভাবে বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে এর আগে কেউই যেতে পারেন নি। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন কোনো অধিনায়ক কি আগে কখনো বলেছিলেন ,‘ কাল আমি শেষ ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি!’ না, কোন অধিনায়কের নামই মনে করতে পারলেন না অস্ট্রেলিয়ার সিনিয়র ক্রিকেট লিখিয়েরা। পারলেন মাইকেল ক্লার্ক। তিনি যখন ওয়ানডে থেকে অবসরের ঘোষণাটা দিলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের অনেকে বলাবলি শুরু করেন ,‘ রং টাইমিং’! কিন্তু আসলেই কি টাইমিংয়ে ভুল করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক? ফাইনাল শেষে বলতেই হচ্ছে, না, পারফেক্ট টাইমিং ক্লার্কের।
মাঠে এবং মাঠের বাইরে। ‘ব্যাটে রান নেই, রান নেই’ বলে যারা চিৎকার শুরু করেছিলেন তাদের চুপ করিয়ে দিলেন ফাইনালে রান করে। প্রথম রানটার জন্য যদিও ক্লার্ককে খেলতে হয়েছিল ৬ বল। কিন্তু তারপর কি আর পেছনে ফিরে তাকিয়েছেন তিনি! ৫৬ বলে তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের ৫৮তম হাফ সেঞ্চুরি। করলেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৪ রান। খেললেন ৭২ বল। হেনরির বলে বোল্ড হয়ে যাওয়ার পর ব্যাট উঁচিয়েই প্যাভিলিয়নে ফিরলেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলা ক্লার্ক। সেঞ্চুরি নয়, তারপরও যেভাবে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাটটা উঁচু করে এমসিজি ছেড়ে গেলেন, তাতে বুঝতে অসুবিধা হলো না এই ইনিংসটাকে তিনি মনে মনে উৎসর্গ করে গেলেন বন্ধু টিমমেট ‘ক্রিকেটশহিদ’ ফিল হিউজকে। যাকে হারানোর শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি লম্বা সময় ধরে। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে ‘ পি .এইচ’ অক্ষর দুটো লেখা কালো আর্মব্যান্ড পরেই খেলছেন তিনি এবং তাঁর জনাকয় টিমমেট। তবে বন্ধুকে স্মরণ করার সেরা উপলক্ষ বোধ হয় ছিল বিশ্বকাপটা জেতা।
তিনি জিতলেনও। এবং স্টিভওয়াহ-রিকি পন্টিংদের সরণিতেই নিজের নামটাকে অক্ষয় করে রেখে গেলেন। ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন। অবশ্য আরো একজন চলে গেলেন জিওফ মার্শ সরণিতে। তিনি ড্যারেন লেম্যান। ক্রিকেটার এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতলেন। তবে তারপরও মার্শ থেকে গেলেন একটু আলাদা জায়গায়। মার্শ-পরিবারের দুই প্রজন্ম বিশ্বকাপ জিতলো। জিওফ মার্শের পর ছেলে মিচেল মার্শ বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে পিতা-পুত্রের কাপ জয়ের রেকর্ড আর নেই। অস্ট্রেলিয়ার মার্শ-পরিবারে অন্যরকম এক রেকর্ডের মালিকানা চলে গেলো।
তবে পরিবার নয়, অস্ট্রেলিয়া কাপটা জিতলো সেরা দল হিসেবে। অনেকে বলেন, ক্রিকেটে সব সময় সেরা দল জেতে না! কিন্তু তাকেও ভুল প্রমাণ করলো অস্ট্রেলিয়ার এই দলটা। এবারের বিশ্বকাপে ফাইনালের আগে অপরাজিত থাকা একমাত্র দলটাকেও তারা হারালো। সেই সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে নিউজিল্যান্ডের কাছে ১ উইকেটে হারের প্রতিশোধ নিলো তারা পড়শীকে ৭ উইকেটে হারিয়ে। তাসমান সাগরের উত্তর পাড়েই বিশ্বকাপটাকে রেখে দিলো তারা। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ৯৩ হাজার ১শ ১৩জন দর্শককে স্বাক্ষী রেখে কাপ-হাতে বিদায় নেবার চেয়ে ভাল মঞ্চ আর কি হতে পারতো মাইকেল ক্লার্কের জন্য! ক্লার্কের বিদায়ী ম্যাচে শুধু কি দর্শক, এমসিজিতে হাজির অনেক সামুদ্রিক পাখিও। স্পাইডার ক্যামেরার জন্য যাদের মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল। তারাও যেন এমসিজিতে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল ক্লার্ক আর তাঁর দলকে। জবাবে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি। আর কাপটাকে উৎসর্গ করলেন সেই বন্ধু ফিল হিউজকে।
অভিনন্দন আসলেই অস্ট্রেলিয়ার প্রাপ্য। গোটা মৌসুমজুড়ে ভাল ক্রিকেট খেললো যারা সেই দলটার হাতেই বিশ্বকাপ মানায়। কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তান, সেমিফাইনালে ভারতকে হারাল তারা। সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে যারা হারালো, তারাতো সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। ক্লার্ক নিজেও বললেন ,‘ সেমিফাইনাল জেতার পরই মানসিকভাবে আমরা কাপ জয়ের পথে আরো এগিয়ে যাই। ’ নিউজিল্যান্ডকে হারানোটা মনে হলে তাদের জন্য কাপটা হাতে নেয়ার নিছক আনুষ্ঠানিকতা। অবশ্য সেই অনুষ্ঠানটা যেভাবে হলো, সেখানে ছোট একটা প্রশ্ন থেকে গেলো। কাপটা কি বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের আইসিসি’র চেয়ারম্যানের হাত থেকে নেয়ার কথা ছিল, নাকি কাপ দেয়ার কথা আইসিসি প্রেসিডেন্টের? আইসিসির ঐতিহ্য আর গঠনতন্ত্র অবশ্য বলছে, শ্রীনিবাসন একেবারে গায়ের জোরে ‘দাদাগিরি’ দেখিয়ে কাপ তুলে দিলেন মাইকেল ক্লার্কের হাতে!
এমসিজির মায়াবি রাত মাইকেল ক্লার্ক আর তাঁর দলকে যেমন মনে রাখবে, হয়তো মনে রাখবে এন শ্রীনিবাসনকেও। তবে একেবারে ভিন্ন কারণে।
বাংলাদেশ সময়: ২২৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৫
** অস্ট্রেলিয়ার আগে কিউইদের এমসিজি দখল | অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** এসসিজিতে ভারতের হার, এমসিজিতে ট্র্যান্স-তাসমান ব্যাটেল | অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** ভারতীয়দের প্রশংসায় অস্ট্রেলিয়া!॥ অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** সিডনিই বলে দেবে বিশ্বকাপটা সত্যিই ‘আউট সাইড এশিয়া’ কিনা! | অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** মহাতারকাদের ক্রিকেট আড্ডায়ও বাংলাদেশ। । অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** আবেগ মেলবোর্নে, যুদ্ধটা সিডনিতে॥ অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** তবু ‘চোক’ শব্দটাকে এড়ানো যাচ্ছে না | সিডনি থেকে অঘোর মন্ডল
** জয়ের চেয়ে ভাল প্রস্তুতি আর কি হতে পারতো!| অঘোর মন্ডল, সিডনি থেকে
** বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হ্যাডলিও || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** মাহমুদুল্লাহর ইনিংস টেনে আনলো মার্টিন ক্রো-কে। । অঘোর মন্ডল, হ্যামিল্টন থেকে
** ক্লাস অব জিরো এইট! || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অ্যাডিলেডে শরতের রংও যেন লাল-সবুজ | অঘোর মন্ডল, অ্যাডিলেড থেকে
** ওয়ানডে-তে বোলাররা এখন শ্রমিকের ভূমিকায়! অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অনেক নাটক জন্ম দিতে পারে ইডেন পার্ক ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইয়র্কার এখন বিরল ডেলিভারি!॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** বিশ্বকাপের রান উৎসবে বাংলাদেশও ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** নেলসনে টাইগারদের তিন ‘ল্যান্ড’ হার্ডল ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইংল্যান্ড পারলে বাংলাদেশ কেন নয়? । । অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে