ঢাকা: ‘একজন মেধাবী বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ও স্পিনার। বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বজনবিদিত সেরা ক্রিকেটার তিনি।
কিন্তু এই সাকিব সম্প্রতি যেন কোথায় হারিয়ে গেছেন। ব্যাটে-বলে বাংলাদেশ দলের হাল ধরে অভ্যস্ত অলরাউন্ডারকে গত বছরের জুনে অনুষ্ঠিত ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পর থেকেই চেনা যাচ্ছে না।
২০০৬ সালে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অভিষেক এবং পরের বছর টেস্ট অভিষেকের পর সাকিব জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১৫৭ ওয়ানডে, ৪২ টেস্ট ও ৪৯টি টি-টোয়েন্টি। এরমধ্যে ওয়ানডেতে ছয়টি সেঞ্চুরি ও ৩০টি হাফ সেঞ্চুরিসহ তার রানগড় ৩৫.১৮, উইকেট ২০৬টি; টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি ও ১৯টি হাফ সেঞ্চুরিসহ রানগড় ৩৯.৭৬, উইকেট ১৪৭ এবং টি-টোয়েন্টিতে পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরিসহ রানগড় ২২.৭৬, উইকেট ৫৭টি।
কিন্তু এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে জুনে ভারতের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজের পর সাকিবের টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলার হিসাব মেলানো দায়। ওই সিরিজের পর থেকে সাকিব সব মিলিয়ে ১৮ ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে তিনি ব্যাট করেছেন ১৭টিতে। তাতে তার রান যথাক্রমে ৩৫ (টেস্ট); ৪৮, ০*, ১৬ (ওয়ানডে); ২৬, ৮, ২০*, ২৭*, ৩, ৪, ৩, ১৩, ৩২, ৮, ২১, ৫ ও ০* (এশিয়াকাপসহ টি-টোয়েন্টি)। পুরো ১৮ ম্যাচে সাকিবের উইকেট ২১টি। পরিসংখ্যান মেলালে বাংলাদেশ দলের মিডলঅর্ডারের অন্যতম প্রধান স্তম্ভের রানগড় অথবা বোলিং অ্যাটাকের সেরা ভরসার উইকেট নেওয়ার হিসাবটা কোথায় ঠেকবে তা সহজেই অনুমেয়। এরমধ্যে এশিয়া কাপ এবং তার আগে অনুষ্ঠিত জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের টি-টোয়েন্টি সিরিজের রানগড়টা উল্লেখ করা যায়। এই তিন টুর্নামেন্টে সাকিব আল হাসানের রানগড় ছিল যথাক্রমে ১৫.৪০; ২৭ ও ১৭।
ক্রিকেটের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আসর ওয়ানডে বিশ্বকাপে টাইগার সমর্থকদের নজর সাকিবের ওপর থাকলেও সেখানেও ততোটা উজ্জ্বল ছিলেন না তিনি। গ্রুপ পর্বের প্রথম দিকে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে কিছু রান পেলেও শক্তিশালী ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে সাকিবের রান ছিল যথাক্রমে ২ ও ২৩। আর গুরুত্বপূর্ণ কোয়ার্টার ফাইনালে সাজঘরের পথ ধরেছিলেন মাত্র ১০ রান করেই। বিশ্বকাপের ওই ছয়টি ম্যাচে তিনি উইকেট নিয়েছিলেন ৮টি।
দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সাকিব কয়েক দফায় সব ফরম্যাটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের আসন দখলে রেখেছিলেন ঠিক। কিন্তু এই লম্বা সময়ের ছন্দপতনে তিনি ইতোমধ্যে টি-টোয়েন্টি ও টেস্টে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের আসন খুইয়েছেন, দুলছে তার ওয়ানডে সেরার আসনও।
এই ‘দোলাদুলিতে’ সাকিব ও তার দলের মতো সমর্থকদেরও নখকাটা অপেক্ষা, ‘সাকিব স্বরূপে ফিরতে পারবেন তো?’ ক্রিকেটে যদি ‘উত্থান-পতন’ থাকে, তাহলে সাকিবের এখন কী চলছে? ক্রিকেটের অতীতের ‘সেরা’দের উত্থান-পতনের চিত্রইবা কী বলে?
ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যার ভিভ রিচার্ডস ১৯৭৪ সালে টেস্ট ও ১৯৭৫ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর খেলেছেন যথাক্রমে ১২১ ও ১২৭টি ম্যাচ। টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ছিল ৫০.২৩। আর ওয়ানডেতে ছিল ৪৭। ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে রিচার্ডস ভারতীয় অভিনেত্রী নীনা গুপ্তের সঙ্গে লুকোচুরি প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে তার পারফরম্যান্সে দারুণ ছন্দপতন ঘটে। ১৯৮৭ মৌসুমে ২১ ওয়ানডে খেলে যেখানে রিচার্ডসের ব্যাটিং গড় ছিল ৪৯, সেখানে ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ মৌসুমে যথাক্রমে ১৪, ২২, ৪ ও ৮ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় নেমে যায় ২৬.৭৫; ৩২.৮০; ১৯.৬৬ এবং ৩১.৪২ এ।
১৯৮৭ ও ১৯৮৮ মৌসুমে যথাক্রমে ৬ ও ১১ টেস্ট খেলে যেখানে তার গড় ছিল ৪২.৮৫ ও ৫১, সেখানে ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ মৌসুমে যথাক্রমে ৬, ৩ ও ১০ টেস্টে তার রানগড় নেমে যায় ৩৫.৮৭; ২৮.২০ ও ২৯.২৮ এ। শেষ পর্যন্ত আর ক্রিকেট ধরে রাখতে পারেননি রিচার্ডস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানাধর্মী বিতর্ক ও মানসিক চাপে ব্যাটও মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ১৯৯১ সালেই অবসরে চলে যান ক্রিকেটের এই ক্ষণজন্মা প্রতিভা।
সর্বসকালের সেরা স্পিনারখ্যাত অস্ট্রেলিয়ার শের্ন ওয়ার্ন ১৯৯২ সালে টেস্ট ও ১৯৯৩ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর ম্যাচ খেলেছেন যথাক্রমে ১৪৫ ও ১৯৪টি। দুই ফরম্যাটে তার উইকেট সংখ্যা যথাক্রমে ৭০৮ ও ২৯৩। গ্রেটদের মধ্যে ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন সম্ভবত ওয়ার্ন। ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে ২০০৩ সালে তাকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সব বিতর্ক ও মানসিক চাপ উড়িয়ে ২০০৪ মৌসুমে আরও রুদ্ররূপে ফেরেন ওয়ার্ন। ২০০২ মৌসুমে তার ১০ টেস্টে উইকেট শিকারের সংখ্যা যেখানে ছিল ৬৭, ২০০৪ মৌসুমে এসে তিনি ১২ টেস্ট খেলে ঝুলিতে ভরেন ৭০ উইকেট; পরের বছর ওয়ার্ন হয়ে ওঠেন আরও বিধ্বংসী, ১৫ টেস্টে উইকেট নেন ৯৬টি। তবে, নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ওঠার পর আর ওয়ানডে খেলা হয়নি ওয়ার্নের।
ওয়ার্নের মতো ‘ড্রাগ’ ধাক্কা না খেলেও রিচার্ডসের মতো মানসিক ধকল গেছে ভারতের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ওপর। তবে তিনি রিচার্ডসের মতো ভেঙে পড়েননি। ওয়ার্নের মতো দুর্দান্তভাবে সামলেছেন অভিনেত্রী সঙ্গীতা বিজলানির সঙ্গে তার প্রণয় ও পরিণয়কে ঘিরে ওঠা আলোচনা। ১৯৯৬ সালের আগে ‘বিজলানী-আজহারউদ্দিন’ প্রসঙ্গে বলিউড ও ক্রিকেটপাড়ায় আলোচনার বিষয় থাকলেও ওই বছর বিজলানীকে বিয়ে করে তা অনেকটাই থামিয়ে দেন সাবেক এ অধিনায়ক। ১৯৮৪ সালে টেস্ট ও ১৯৮৫ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর যথাক্রমে ৯৯ ও ৩৩৪ ম্যাচ খেলা আজহারউদ্দিনের শুরুর দিকে যে রানগড় (দুই সিরিজে ৫২ ও ৪৬.৭৫) ছিল, সেই ধারাবাহিকতা তার থেকেছে বিজলানীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাধার পরও (তিন সিরিজে ১৮৫; ৭০.৩৩ ও ৪৯.২৫)। যদিও বয়সের ভারে ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে ছন্দ হারিয়েছিলেন।
রিচার্ডস-ওয়ার্ন-আজহারউদ্দিনদের ‘উত্থান-পতনের’ এমন গল্প সামনে আনে বিভিন্ন সময়ে সাকিব আল হাসানের বিতর্কে জড়ানো ও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ার বিষয়ও। কিন্তু সব বিতর্ক ও নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ওঠার পর তিনি তো স্বরূপেই ফিরেছেন। তাহলে এখন আবার ‘কোথায়’ হারালেন সাকিব?
ক্রিকেটবোদ্ধারা বরাবরই বলে থাকেন, ক্রিকেট মনোসংযোগের খেলা। এখানে খেলার টেকনিকের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ‘মনোসংযোগ’।
তবে কি বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসানের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে? কোনো কিছুতে হতাশ অথবা বিষণ্ন তিনি? কোথায় তার মনোসংযোগ?
একটি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, দেশের সবচেয়ে ধনী খেলোয়াড় সাকিবের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ২৭৫ কোটি ৬১ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ টাকা। বিশ্বের প্রায় সব বড় লিগে খেলা সাকিব বেতনের পাশাপাশি আয় করছেন পেপসি, ক্যাস্ট্রল, নর্টন অ্যান্টিভাইরাস, বুস্ট, লাইফবয়, লা রিভ, লেনেভো, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, বাংলালিংক, রানার মোটরসাইকেল, জান এন জি আইসক্রিম, টিফিন বিস্কুটস, সিঙ্গার ইলেকট্রনিকসসহ অনেক পণ্যের বিজ্ঞাপনী দূত হয়ে। এমনকি তিনি নিজেও কসমেটিকস, রেস্তোরাঁ ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায় জড়িত।
কোনো কাজে জড়িত হওয়া মানে স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর বাড়তি মনোযোগ দেওয়া। সেই কাজের খোঁজ খবর নেওয়া। ভালো খবরে উৎফুল্ল হওয়া, খারাপ খবরে হতাশ হওয়া। ক্রিকেটার সাকিব কি তাহলে এই ‘বিজ্ঞাপন-ব্যবসায়’ আটকে যাচ্ছেন?
কিন্তু এমন পণ্যের বিজ্ঞাপনী দূত তো ভারতীয় ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনি-বিরাট কোহলিরাও, ব্যবসাপাতি তো বিশ্বের প্রায় সব ক্রিকেটারেরই আছে। তাহলে?
এই ‘তাহলে’র জবাব সাকিবের বল-ব্যাটেই চাইছেন তার সমর্থক-ভক্তরা, সেটি তারা চাইছেন ভারতে চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৬
এইচএ/আইএ
** এ কোন মুশফিকুর রহিম?