ঢাকা: রান সংগ্রহে এমন ধারাবাহিক ছিলেন যে একসময় তিনি ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ এমনকি ‘রান মেশিন’ খ্যাতি পেয়ে যান। ব্যাটিংয়ে টপঅর্ডার ভেঙে পড়লে দল ‘ডিপেন্ডেবলের’ ওপর ভরসা করে থাকতো, রান সংগ্রহে গতি পড়ে গেলে সতীর্থরা চেয়ে থাকতেন ‘রান মেশিনের’ ব্যাটের দিকে।
ক্রিকেটের এসময়ের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানদের তালিকা করলে এখনও প্রথম দিকেই থাকবেন মুশফিকুর রহিম। কিন্তু তার ‘অতীত’র এই অর্জনকে ‘পিছিয়ে’ দিচ্ছে অচেনা ‘বর্তমান’। গত নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের পর থেকে ক্রমে এমনই ‘ভীষণ অচেনা’ হয়ে উঠছেন মুশফিকুর রহিম।
নিজেদের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির পর ওই সিরিজের পরের দুই ম্যাচে মুশফিকের ব্যাটে আসে ২১ ও ২৮। এরপর গত ১০টি ম্যাচে (এশিয়াকাপসহ টি-টোয়েন্টি) তার রান যথাক্রমে ২, ৯, ২৬, ২৪*, ১৬*, ৪, ৪, ১২, ৪ ও ০।
২০০৫ সালে ওয়ানডে, ২০০৬ সালে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত মুশফিকুর রহিম এ পর্যন্ত তিন ফরম্যাটে খেলেছেন যথাক্রমে ১৫৮, ৪৮ ও ৫২ ম্যাচ। ওয়ানডেতে ৩১.৬১; টেস্টে ৩২.৩১ এবং টি-টোয়েন্টিতে ১৭.৮১ ব্যাটিং গড় নিয়ে খেলে আসা মুশফিকুরের নামের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক রান সংগ্রহের এই চিত্র কতোটা বেমানান তা দুর্দান্ত ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও তার পরের পাকিস্তান-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজই বলে দিচ্ছে।
বিশ্বকাপের ছয় ম্যাচে মুশফিকের সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে ৭১, ৩৬, ৬০, ৮৯, ১৫ ও ২৭। আর পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজে সংগ্রহ ছিল ১০৬, ৬৫ ও ৪৯*। একেবারে দৃষ্টিকটূ রান আসেনি ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজেও।
সেই দুর্দান্ত মুশফিকের ব্যাট হঠাৎ কেন এমন রঙ হারালো? কী কারণে কথা নেই তার ব্যাটে? কেন উইকেটের পেছনের ভূমিকা নিয়েও কথার বৃত্তে বন্দি দেশের ইতিহাসের সেরা এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান?
ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বড় কোনো বিতর্কের আঁচড় লাগেনি ক্রিকেটের অন্যতম ব্যক্তিত্ববান এ ক্রিকেটারের গায়ে। তবে বিভিন্ন সময়ে তাকে চাপে ফেলতে চেয়েছে অভিশপ্ত চোট। সর্বশেষ চোট লেগেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সেই ওয়ানডে সিরিজের পর খুলনা টেস্টে। কিন্তু তারপরও তো দারুণভাবে উতরে গেছেন মুশফিক। তবে?
তবে কি সেই উত্থান-পতনের ‘পরীক্ষার’ মুখে পড়েছেন মুশফিকুর রহিম। যে উত্থান-পতনের সাঁকো পার হতে হয়েছে ভারতের ক্রিকেটঈশ্বর খ্যাত শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার শের্ন ওয়ার্ন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যার ভিভ রিচার্ডস, ভারতেরই মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও রবি শাস্ত্রীর মতো ক্রিকেটারদের।
ইতিহাস বলছে, এই ক্রিকেটারদের মধ্যে ছন্দপতনের পর আর উত্থান হয়নি রবি শাস্ত্রীর। চোটের অভিশাপ আর ১৯৯২ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দলের হারের কারণ হওয়ার অপবাদ নিয়ে ক্রিকেট ছাড়তে হয়েছে তাকে। ভারতের বেশিরভাগ তারকা ক্রিকেটার যেখানে ১৪-১৬ বছর দলে খেলে গেছেন, সেখানে রবিকে বিদায় নিতে হয়েছে ৪-৬ বছর আগেই। ১৯৮১ সালে টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেকের পর দুই ফরম্যাটে তিনি খেলেছিলেন যথাক্রমে ৮০ ও ১৫০ ম্যাচ। দুই খেলায় তার গড় ছিল ৩৫.৭৯ ও ২৯.০৪; উইকেট নিয়েছিলেন ১৫১ ও ১২৯।
ছন্দপতনের পর ফেরা হয়নি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যার ভিভ রিচার্ডসেরও। ১৯৮৮-৮৯ এর দিকে ভারতীয় অভিনেত্রী নীনা গুপ্তের সঙ্গে লুকোচুরি প্রেমের সম্পর্ক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আগে তুমুল ছন্দে ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ মৌসুমে ২১ ওয়ানডে খেলে যেখানে রিচার্ডসের ব্যাটিং গড় ছিল ৪৯, সেখানে ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ মৌসুমে যথাক্রমে ১৪, ২২, ৪ ও ৮ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় নেমে যায় ২৬.৭৫; ৩২.৮০; ১৯.৬৬ এবং ৩১.৪২ এ। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ মৌসুমে যথাক্রমে ৬ ও ১১ টেস্ট খেলে যেখানে তার গড় ছিল ৪২.৮৫ ও ৫১, সেখানে ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ মৌসুমে যথাক্রমে ৬, ৩ ও ১০ টেস্টে তার রানগড় নেমে যায় ৩৫.৮৭; ২৮.২০ ও ২৯ দশমিক ২৮ এ। শেষ পর্যন্ত আর ক্রিকেট ধরে রাখতে পারেননি রিচার্ডস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানাধর্মী বিতর্ক ও মানসিক চাপে ব্যাটও মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ১৯৯১ সালেই অবসরে চলে যান ক্রিকেটের এই ক্ষনজন্মা প্রতিভা।
তবে, এ দু’জনের চেয়ে ঈর্ষণীয়ভাবে আলাদা ছিলেন ক্রিকেটের ভারতীয় লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার। টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা টেন্ডুলকারের ব্যাটিং গড় ছিল ৪৬৩ ওয়ানডেতে ৪৪.৮৩; আর ২০০ টেস্টে ৫৩.৭৮। ক্যারিয়ারের মাঝগগনে ব্যাটিংয়ে ছন্দ হারাতে হারাতে একটি সিরিজে সেটা ৯ এ পর্যন্ত ঠেকে (২০০৫ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪ ম্যাচ সিরিজে শচীনের রানগড় ৯ হয়েছিল)। কিন্তু সেই জায়গা থেকে দুরন্তভাবে ফিরেছিলেন ক্রিকেট ঈশ্বর। এরপরও কম আলোচনায় থাকতে হয়নি তাকে। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে ফের শচীনের পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অনেকে তাকে অবসরের পরামর্শ দেন। সেটার জবাব টুর্নামেন্টে ৫৩ গড়ে রান তোলার মাধ্যমে দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েই দিয়েছিলেন ক্রিকেট ঈশ্বর।
পতনের পর উত্থানের এমন নজির রেখে গেছেন ‘ড্রাগ’ ধাক্কা খাওয়া অস্ট্রেলিয়ার ঘূর্ণি জাদুকর শেন ওয়ার্ন এবং অভিনেত্রী সঙ্গীতা বিজলানীর সঙ্গে প্রণয় ও পরিণয়ঘটিত বিষয়ে মানসিক ধাক্কা খাওয়া ভারতের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনও।
তবে, সেজন্য তারা বরাবরই বলেছিলেন, ক্রিকেটে পুরোপুরি মনোসংযোগ রাখতে হয়েছে। নিজের সঙ্গে নিজেকে লড়তে হয়েছে, স্বরূপ ফিরে পাওয়ার লড়াই। এই লড়াইয়ে বাইরে রাখতে হয়েছে অন্য জগত এমনকি ব্যক্তিজীবনকেও।
ব্যাটের ব্যর্থতা আর উইকেটের পেছনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার বৃত্তে থাকা মুশফিকুর রহিম কি পারবেন তার যে ছোটখাট বিজ্ঞাপনী-প্রচারণা জগত আছে, সেটাকে আলাদা রেখে একান্ত মনোসংযোগ দিয়ে শচীন টেন্ডুলকার-শের্ন ওয়ার্ন-মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনদের মতো দুরন্তভাবে ফিরে আসতে? নাকি রবি শাস্ত্রী-ভিভ রিচার্ডসদের মতো হার মেনে যাবেন ‘নিয়তি’র কাছে? তার উত্তর এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই আসুক না মিস্টার ডিপেন্ডেবল’র ব্যাট থেকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
এইচএ/আইএ
** ‘কোথায়’ হারালেন সাকিব আল হাসান?