কলকাতা থেকে: ধর্মশালায় বাছাই পর্বের হিসাব চুকে ১৪ মার্চ ভোরে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা মিনিবাসে, সঙ্গে সহকর্মী শোয়েব মিথুন। হিমাচল থেকে কলকাতায় আসতে পরিকল্পনাটা ছিল, বাসযোগে দিল্লি, দিল্লি থেকে উড়োজাহাজে কলকাতা।
ধর্মশালার হোটেল থেকে যখন যাত্রা হলো, তখনও সূর্য দেবতা পৃথিবীর বুকে তাঁর আলো ছড়াতে শুরু করেনি। সেজন্য ভয়-রোমাঞ্চ দু’টিই কাজ করছিল মনে। ভয় এ কারণে যে, অন্ধকারে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট উঁচু পথ দিয়ে যাওয়ার সময় চালক এতটুকু অসতর্ক হলে গাড়ি একেবারে গিরিখাদে। আর রোমাঞ্চটি দিনের আলোয় ভারতবর্ষের সৌন্দর্য দেখার। হিমাচলে রাতের বেলায় আসার কারণে চোখ বোলানো যায়নি প্রকৃতির পাতায়।
নির্ধারিত সময় বাস ছাড়ার পর হিমাচলের উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে বাস ছুটছিল দিল্লির উদ্দেশে। উত্তরের এ রাজ্য থেকে কেন্দ্র দিল্লিতে যেতে পাড়ি দিতে হয় তিনটি রাজ্য, চন্ডিগড়, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা।
শেষ ম্যাচ দেখার পর হোটেলে ফেরা এবং বাস ধরার ব্যস্ততায় রাত কেটেছে নির্ঘুম। সে কারণে হিমাচলের পাহাড়ের নির্মল সবুজ দেখতে দেখতে চোখে নামলো রাজ্যের ঘুম। ঘুম ভাঙতেই কানে বাজতে থাকলো ‘ঝম ঝম...ঝম ঝম...’ বৃষ্টির তান। এ ঝুম বৃষ্টিতে মহাসড়কের ওপর থেকে বাহন মিনিবাসটি পাঞ্জাবী একটি ধাবার সামনে থামবে বলে হাইওয়ে থেকে মোড় নিচ্ছে। ‘ধাবা’ হিন্দি শব্দ, ইংরেজিতে রেস্টুরেন্ট, আর বাংলায় খাবার ঘর। সে ধাবার নাম ‘শের-ই-পাঞ্জাব ধাবা’। সময় তখন বেলা ১১টা।
ঘুমের ঘোরে চন্ডিগড় না দেখার যে খানিক কষ্ট ছিল তা উবে গেল পাঞ্জাবের সুসজ্জিত এই রেস্টুরেন্ট দেখে। নাস্তা পর্ব শেষে গাড়িতে ওঠে এবার পাঞ্জাব-দর্শনের পালা। সুঠামদেহী পাঞ্জাবের মানুষগুলোর মাথায় পাগড়িসহ স্থানীয় পোশাক তাদের আভিজাত্য প্রকাশ করছিল। মহাসড়কের দু’পাশে বিস্তীর্ণ গম ক্ষেত ও আর অন্য ফসলী জমি পরিচয় দিচ্ছিল তাদের ভূমির উর্বরতার।
পাঞ্জাবের শেষ মাথায় টোল প্লাজা। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে প্রবেশে যে কর দেওয়ার রীতি, তা দিতে হলো এখানেও। মিনিবাস প্রবেশ করলো হরিয়ানায়। সময় তখন দুপুর ১টা। ভোর ৫টা থেকে ঘণ্টায় ৮০-৮৫ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে সাত ঘণ্টায় দু’টি প্রদেশ অতিক্রম করায় চালকের মুখে তখন তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠছিল।
হরিয়ানা-দর্শনে বোঝা গেল কৃষির পাশাপাশি এ রাজ্যের মানুষ মটর ও ভারী শিল্পেও মনোযোগী এবং উন্নত। হরিয়ানার শহরগুলোর রাস্তার দু‘পাশে টয়োটা, মার্সিডিস, পিজিয়ট, রেনল্ট ও হোন্ডার শো সে কথাই যেন প্রতিষ্ঠিত করে।
এই গতিতে চার ঘণ্টা চলতে থাকার পর আবার মিনিবাসের সামনে পড়লো টোল প্লাজা। অর্থাৎ সামনে দিল্লি। ঘড়িতে সময় তখন বিকেল ৫টা। এই ক্ষিপ্র গতির মধ্যেও মাথায় ঘুরছিল ফ্লাইটের চিন্তা। সন্ধ্যার মধ্যে দিল্লি পৌঁছাতে না পারলে কলকাতার প্লেন ধরতেও দেরি হবে। সেক্ষেত্রে টাইগারদের ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে ঠিক সময়ে পৌঁছানোটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা ৭টায় মিনিবাস প্রবেশ করলো দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিমানবন্দরে ঢুকে প্রথমেই কলকাতার প্লেনের টিকিটের খোঁজ লাগালেও পড়তে হলো বিড়ম্বনায়। ইন্ডিগো নামে একটি এয়ারলাইন্সের রাত সাড়ে ১১টার টিকিট মিললেও বলা হলো, এখান থেকে বেশ দূরে ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে ফ্লাইটে চাপতে হবে। ইন্ডিগো-কর্মীরা বলে দিলেন, ট্যাক্সি অথবা শাটল বাসে চেপে ডোমেস্টিক টার্মিনালে যেতে হবে। অগত্যা শাটল বাসে চেপে রাত সাড়ে ৮টায় সেই টার্মিনালে পৌঁছাতে হলো।
খানিকটা সময় ঘোরাঘুরির পর সময় হলো প্লেনে চড়ার। কিন্তু প্লেনটাকে প্লেন মনে হলো না। ভোগান্তির বাহন বলতে হলো। না আছে এসি, না সিট ফোল্ড করা যায়, না পর্যাপ্ত আতিথেয়তা। প্লেন উড়াল দেওয়ার পর রাতের আকাশ থেকে আলো ঝলমলে দিল্লি দেখেও সেই ভোগান্তি মন থেকে যাচ্ছিল না। ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট এভাবে গরমের মধ্যে জায়গায় বসে থেকে কাটানোর পর রাত ১টা ৩০ মিনিটে কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলো ইন্ডিগো।
একদিন আগেই সময় কেটেছে হিমাচলের হিমশীতল অচেনা পরিবেশে। কলকাতায় নেমে মনে হলো, এই বুঝি পরিচিত পরিবেশ, চেনা আবহাওয়া।
‘চেনা পরিবেশে’ ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে কলকাতার নিউমার্কেটের উদ্দেশে যাত্রা। মধ্যরাতে পুরো কলকাতাও যদি কোনো কারণে ঘুমায়, জেগে থাকে এই নিউমার্কেট, জেগে থাকে মার্কেটটির হোটেলগুলো। তাই রাতটি যাপনে নিউমার্কেটের দিকেই যাত্রা।
যাত্রাপথে বড় বড় রাস্তাঘাট আর ফ্লাইওভার কলকাতা নগরীর বিশালতার পরিচয় দিচ্ছিল। এই মুগ্ধতায় নিউমার্কেটে পৌঁছালেও মিললো না হোটেল। শেষতক গ্র্যান্ড স্ট্রিটে মিললো। এই হোটেলে খেয়েই ঘুম।
ঘুম যখন ভাঙলো, ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। নাস্তা সেরে দ্রুত রওয়ানা করতে হলো ইডেন গার্ডেন্সের দিকে। দুপুর ২টায় ইডেনে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলন।
নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থার কলকাতার ভবন ও সড়কের সঙ্গে ঢাকার শাঁখারী বাজার ও তাঁতিবাজারের খানিক মিল খুঁজতে খুঁজতেই পথ শেষ হলো ইডেন গার্ডেন্স গেটে। দু’দলের সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর ফের হোটেলের উদ্দেশে যাত্রা।
রাতের খাবার হলো ‘খালিক’ নামে এক মুসলিম হোটেলে। সেখানে দেখা মিললো বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদকর্মীও। প্রায় সবাই এসেছেন এই হোটেলের বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, পাতলা ডাল, ডিম আর মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার লোভে।
খাবার শেষে আবার হোটেল, তারপর ঘুম। সকালে বিছানা ছেড়ে আবার ছুট ইডেন গার্ডেন্সে। তারপর খেলার মাঠ আর গ্যালারির উন্মাদনায় ডুব। এই উন্মাদনা কাটিয়ে হোটেলে ফিরতে হলো রাত ১১টায়।
পরদিন বাংলাদেশ দল চলে যাবে বেঙ্গালুরুতে। সেজন্য সকালে ওঠার তাগাদায় দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়তে হলো। সকালে উঠেই বাংলাদেশ দলের হোটেল আইটিসি সোনার কলকাতায় ছুট। এই ছোটাছুটিতেও মুগ্ধতায় ডোবালো কলকাতার শুভ্র ও নির্মল সকাল।
আইটিসি সোনার কলকাতায় মাশরাফি বিন মুর্তজাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রতিবেদন তৈরি করে এবার শুরু বেঙ্গালুরু যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পালা। কলকাতার প্রথম ধাপের মিশন শেষে আগামী ২১ ও ২৩ মার্চ বেঙ্গালুরুতে খেলবে বাংলাদেশ দল। ডুবে থাকতে হবে সেখানে। আপাতত কলকাতার প্রথম ধাপের মিশন শেষে বেঙ্গালুরুর ট্রেন ধরতে ছুটতে হচ্ছে।
স্থানীয় সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, ১৭ মার্চ ২০১৬
এইচএ/